বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ায় মুসলিম বিশ্ব ও জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতার কারণে সরকার সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। তা ছাড়া পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবেও মুসলিম বিশ্বে একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সেই মর্যাদার আসন থেকেও ছিটকে পড়েছে। বিশেষ করে ভারতের ওপর ভর করে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল করার পর ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো সৌজন্যতামূলক সম্পর্কের বাইরে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাদের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং শ্রমিক স্বার্থ ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে চাপ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়নযোগী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো সরকারের ওপর নাখোশ। বিশেষ করে মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ওপরের সাবেক ও বর্তমান ৭ জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর তা প্রকাশ্যে এসেছে এবং পরিধি বাড়ার ভয়ে আছে। কারণ পরিধি বেড়ে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার দিকে মোড় নিলে দেশের প্রধান রফতানি খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তারা প্রতি বছর যে অর্থ ছাড় দেয় তা বন্ধ করে দিলে এবং শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা আছেন তাতেও টান পড়ার আশঙ্কা আছে।
ভারত এদেশে গণতন্ত্র হত্যায় সহযোগিতা করে বর্তমান সরকারের এতটাই প্রিয়ভাজন হয়েছে যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দুই দেশের সম্পর্ককে ‘স্বামী স্ত্রী’ এর মধুর সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারত এবং ঋণ নিয়ে উন্নয়নের নামে লুটপাট করতে বিশ্বের অন্যতম স্বৈরাচারী রাষ্ট্র চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব বলে জঙ্গিবাদ ট্রামকার্ড দেখিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এভাবে প্রতারণার চাদরে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের একনায়কতান্ত্রিক চরিত্র বেশি দিন ঢেকে রাখতে পারবে না, বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ ইতোমধ্যেই তাদের আসল চেহারা দিনের আলোয় আসা শুরু হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া গণতান্ত্রিক দেশের তালিকা থেকে অনেক আগেই বাংলাদেশকে বাদ দিয়েছে। এখন আসতে শুরু করেছে নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর লাল সতর্কবাতা।
দুঃখজনক হলেও সত্য ভারত নির্ভরতা এতটাই সীমা ছাড়িয়ে গেছে যে, একটি স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সাহায্য প্রাথর্না করছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন প্রকাশ্যে এ ধরনের মন্তব্যই দেশের জন্য ‘অসম্মানজনক’ এবং ভারত বা তৃতীয় কোনো দেশের এ বিষয়ে কিছু করারও নেই বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিভাবে প্রত্যাহার হতে পারে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে এবং সে কারণেই ভারত বা অন্য কারও এতে কোনো কিছু করার সুযোগই নেই। একই ধরনের মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক দিয়েই এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। প্রসঙ্গত, গত বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার অনুরোধ করা হলেও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন, ‘জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ছাড়া র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তার দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।’ গত বছরের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞার খবর জানিয়ে তখন মার্কিন অর্থ দফতর বলেছিলো যে তাদের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট দশটি প্রতিষ্ঠান ও পনেরো জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে-যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই তালিকাভুক্তদের অন্যতম হলেন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান প্রধান বেনজীর আহমেদ ছাড়াও র্যাব ও এর ছয়জন কর্মকর্তা। বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ৬০০-এরও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। কিছু রিপোর্টে আভাস পাওয়া যায় যে এসব ঘটনায় বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছে- বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তুমুল শোরগোলের মধ্যে গত ২৬শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ওই বিবৃতিতে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য বারোটি এনজিওকে দায়ী করেন তিনি। তার মতে, ‘১২টি আন্তর্জাতিক এনজিও জাতিসংঘের পিসকিপিংয়ের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলকে একটি চিঠি লিখেছে। তারা চিঠিতে বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডা ও স্পেকুলেশন তুলে ধরে বলেছেন, র্যাব বিভিন্ন রকম হিউম্যান রাইটস ভঙ্গ করছে।’ তিনি বলেন, ‘সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে।’ র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সরকার কাজ করছে বলেও সংসদকে অবহিত করেন মিস্টার মোমেন। তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিস্টার মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র যায় এবং সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠে আসে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ‘বেগবান’ করতে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেয়ার কথা জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি জানান, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
যদিও বিশ্লেষকরা সবসময়ই বলে আসছেন যে এ বিষয়টির সাথে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত আছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের উপর আমেরিকার একটি ‘চাপ সৃষ্টি’র কৌশল। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ ভারতের সমর্থন চেয়েছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর, আমরা তাদের (ভারতের) সাহায্য চেয়েছিলাম। তারা আমাদের প্রতি খুব আন্তরিক। তারা (ভারতীয় পক্ষ) বলেছে তারা এ বিষয়ে আলোচনা করবে।’ সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেশ দুটি একযোগে কাজও করছে। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বারবার বলেছে যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জটিল প্রক্রিয়া। এটি চাইলে কী করতে হবে সেটিও তারা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে। এ অবস্থায় তৃতীয় দেশের এখানে কিছু করণীয় আছে বলে তারা মনে করেন না।
‘অদ্ভুত’ ও ‘সম্মানজনক নয়’: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসির সাক্ষাৎকারে বলছেন এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের কাছে সহযোগিতা চাওয়াটাই অদ্ভুত মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি বলছেন যে আমেরিকানরা তো আগেই বলেছে যে তারা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখতে চায়, সেখানে ভারত বা অন্য কোনো দেশ আর কী করতে পারে। বাংলাদেশের সাথে তো যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সম্পর্ক না যে অন্য দেশকে মধ্যস্থতা করতে হবে। যেমন ধরুন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ ইরানে থাকলে হয়তো তারা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ইরানের সাথে কথা বলে- কারণ দেশটির সাথে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাংলাদেশের তো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অ্যাকটিভ সম্পর্ক আছে।
তৌহিদ হোসেন আরো বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ভারতের সাথে সহযোগিতা চাইতে হবে কেন? আর তারাই বা কিভাবে সহযোগিতা করবে সেটা বোঝা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির অবশ্য বলছেন, অনেক দেশ অনেক সময় কূটনীতির বাইরেও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকের সহযোগিতা নেয় কিন্তু সেটা সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না। ‘এখানে আনুষ্ঠানিক কূটনীতিতে ভারতের কাছ থেকে এ ধরনের সহযোগিতা চাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। এটা সম্মানজনকও না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির মাধ্যমেই এর সমাধান খুঁজে পেতে পারে।’
গণতান্ত্রিক দুনিয়া হতে নির্বাসিত: বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সম্পর্ক কেমন? বিশেষ করে আধুনিক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে কোন চোখে দেখে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলোর বিশ্লেষণ করা জরুরি বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। যেমন: ব্রিটেন ও আমেরিকার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদন। এতে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ অনেক আগেই ছিটকে পড়েছে। আর এর সূচনা হয়েছে, আজ নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সরকারও এই বদনাম মুক্ত নয়। কারণ গণতান্ত্রিক যে চেতনাকে ধারণ করে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তারা একটি স্বতন্ত্র ভূ-খ- এবং পতাকা পেয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পায়নি। যেমন স্বাধীনতা পরবর্তী অবস্থা তুলে ধরে Williem Van Schendel wj‡L‡Qb, His party won another large victory in Bangladesh’s first parliamentary Elections in 1973. But lost popular support soon after. In early 1975 Mujib declared a `second revolution’ and installed himself as Bangladesh’s first autocratic ruler.(m~Î : A history of Bangladesh,Williem Van Schendel. Cambridge University Press, page 275). এর পরের ইতিহাস কম-বেশি সবার জানা। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, সময়ের দাবি পূরণ করতে ক্ষমতা দখলকারী একজন জেনারেলের হাত ধরে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকশিত হওয়া শুরু হয়েছিল। তার নাম জিয়াউর রহমান। কিন্তু তা শেষ পরিণতি পাওয়ার আগেই পথ হারিয়ে ফেলে। তারপরও আবার আশার আলো জ্বলে উঠেছিল ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গোলাম আযম প্রণীত নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন এবং নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনারা এই ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফাভাবে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। প্রশ্নবিদ্ধ হয় মানবাধিকার। দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে বাংলাদেশ আসলে কোন ব্লকে তা নিয়ে। চীন, রাশিয়ার মতো স্বৈরতান্ত্রিক না কি ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ। যদিও সরকারের দাবি বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু দেশি-বিদেশি কোনো সচেতন ব্যক্তিই মনে করেন না বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক দেশ নয়। গত ১৪ বছরের মতোই ইআইইউ গণতন্ত্র সূচক ২০২১-এ বাংলাদেশের অবস্থান হাইব্রিড রেজিম। তারপরও পশ্চিমা বিশ্ব ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তারা তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিতই রেখেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার প্রশ্নে র্যাবের সাবেক এবং বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও সরকার ও জনগণের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দেয়া দেশগুলোর একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। করোনা মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি টিকা দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারা বার বার লাল সঙ্কেত দিয়ে বলছে অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনা বিচারে হত্যা, গুম, মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকারের ঘাটতিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক দুনিয়া হতে নির্বাসিত হবে বাংলাদেশ। চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ার কারণে ভারতের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাও কঠিন হবে হবে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে কি বাংলাদেশ চীনের ফাঁদে পা দিয়েছে। তাদের একনায়কতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করবে? নাকি, প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের লেবাস দেখিয়ে রাশিয়ার মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করবে। সম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়েও বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার নয়। অবশ্য রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে রাশিয়ার সহযোগিতা ও বিনিয়োগের কারণে তা সম্ভবও নয়। কিন্তু বিষয়টি আমেরিকা ভালোভাবে নেয়নি। অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিকাই বলে দিবে তারা গণতান্ত্রিক বিশ্ব না চীন-রাশিয়া ব্লকে নিজেরা অবস্থান নিবে। তবে এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক এবং উন্নয়ন সহযোগী মিত্রতাকে উপেক্ষা করলে দেশ বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। যা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হবে। এদিকে চীন ইতোমধ্যে বলেছে যে, কোয়াডে (চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ ইংরেজি: ছঁধফৎরষধঃবৎধষ ঝবপঁৎরঃু উরধষড়মঁব) যদি বাংলাদেশে যোগদান করে তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, চীনের সাথে অতি আন্তরিকতা বাংলাদেশের জন্য বা এক ধরনের বিপদ বয়ে আনছে, বাংলাদেশে চীনের কূটনীতির জালে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হতে বসেছে। এরকম দুটি দেশ হলো শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ। দুটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন নাজুক। সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশের চীন নীতিতে কঠোর অবস্থানে ভারত: সম্প্রতি জার্মানির মিউনিখে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে আলোচনা চলাকালে চীন যেভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটগুলো তেমনটা দিতে পারবে কিনা- বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের এমন প্রশ্নের জবাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বেশ কড়াভাবেই দেন। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয় এমন অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে ঋণ নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে ভাবতে হবে। এ নিয়ে উদ্বেগ না থাকলে ভঙ্গুর অবকাঠামোই তৈরি হবে।’ তিনি শ্রীলঙ্কায় চীনের কিছু বিনিয়োগের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলো তারা চালাতে না পেরে চীনকেই আবার ভাড়া দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের অনেক দেশের ওপর আমরা এখন দেনার বোঝা চাপিয়ে দিতে দেখছি। যে এয়ারপোর্টে একটি বিমানও অবতরণ করবে না, বা যে বন্দরে একটি জাহাজও আসবে না- বাণিজ্যিকভাবেও টেকসই নয় এমন সব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।’ তবে মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন চলছে, এই বাস্তবতায় কী করা উচিত সে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। জনগণও আরো অবকাঠামো চায়।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ চীনের কাছে পাকিস্তানের মতোই বন্ধক হয়ে যায় কিনা এটা নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্নতা আছে। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে তাই তারা কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে আছে। কিন্তু ভারত তো কোনো বিকল্প দিতে পারছে না। তাদের বিনিয়োগ এখানে ১০ বিলিয়ন ডলার। জয়শঙ্কর যে বলেছেন অবাস্তব প্রকল্প, ভারতীরাও তো অবাস্তব প্রকল্প দেয়। তারা এমনভাবে প্রকল্প দেয় যে বালু সিমেন্টও তাদের কাছ থেকে নিতে হয়। এর চেয়ে তো অবাস্তব কিছু হতে পারে না। আমাদের চীনারা সেগুলোই দেয় যেগুলো আমাদের এখানে নেই। ভারত তো আমাদের এমনিতে দিচ্ছে না। আমাদের তো ফেরত দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, চীনের ওপর নির্ভরশীলতা ভালো। ভারতকে আমাদের যা দেয়ার দিয়েছি, এখন তাদের উচিত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা। সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব:) শহীদুল হকও একই ধরনের কথা বলেন। তার কথা, ‘‘ভারত ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবে বিনিয়োগ করেছে কত? এক বিলিয়ন ডলারের বেশি তারা এখনো দেয়নি।’
চীন আসলে কী চায়: চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (ইংরেজি : Quadrilateral Security Dialogue, কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা সংক্ষেপে QSD কিউএসডি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত নিরাপত্তামূলক জোটে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না চীন। গত ১ জুন চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাহবুবুজ্জামানকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক দফতরের মহাপরিচালক লিউ জিনসং বাংলাদেশকে ‘ব্লক রাজনীতি’ প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের এবং আঞ্চলিক স্বার্থের কথা মাথায় রাখবে বলে বিশ্বাস করে চীন। তারা নিজেদের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে এবং স্নায়ুযুদ্ধ ও ব্লক রাজনীতির মনোভাব প্রত্যাখ্যান করবে। এর আগে চীন প্রকাশ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার আঞ্চলিক জোট কোয়াডে যোগ না দিতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছিল। ওই আহ্বানের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক বৈঠকে আবারও একই কথা বললো চীন। এ নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকে মাহবুবুজ্জামানকে লিউ বলেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাল্টিলেটারেলিজম (বহুপাক্ষিকতা) এবং শান্তি ও উন্নয়নের জন্য কষ্টার্জিত পরিবেশকে রক্ষা করা উচিত। গত বছরের মে মাসে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ না দেয়ার কথা বলেছিলেন। ঢাকায় তিনি বলেন, এই চার দেশের জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের জন্য ভালো কোনো বিষয় নয়। কারণ, এটি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সে সময় লি’র এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, চীনের দূতের এ ধরনের মন্তব্য ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ এবং ‘আক্রমণাত্মক’। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আমরাই নির্ধারণ করবো। চীনের থেকে এ ধরনের আচরণ আমরা আশা করিনি। প্রথম থেকেই কোয়াডের বিরোধিতা করছে চীন। দেশটি কোয়াডকে সামরিক জোট ন্যাটোর এশিয়ান সংস্করণ হিসেবে দেখছে। মাহবুবুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সর্বশেষ বক্তব্যের সমালোচনা করেন লিউ। গত ২ জুন যুক্তরারষ্ট্রভিত্তিক জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইডেন প্রশাসনের চীন নীতি উন্মোচন কালে ব্লিঙ্কেন সম্প্রতি দাবি করেন, চীন বিশ্বের একমাত্র দেশ যে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে চায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনই দীর্ঘ মেয়াদে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ, জোট তৈরির মাধ্যমে চীনকে মোকাবেলা করবে। তবে তিনি কমিউনিস্ট দেশটির সঙ্গে সংঘাত কিংবা নতুন স্নায়ুযুদ্ধ এড়ানোর কথাও বলেন।
ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লিউ বলেন, ব্লিঙ্কেনের বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব, বেইজিং এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুতর বিচ্যুতি হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অকাস, কোয়াড এবং সর্বশেষ ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনোমিক ফ্রেমওয়ার্ককে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্ট্রিজম’ এবং ‘এক্সসেপশনালিজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, এ ধরনের আচরণ দেশটির নিজের জন্যই অসম্মান বয়ে আনবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এখানে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কাঠামো রয়েছে তা ধ্বংস করে দেবে এবং দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। লিউ আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে এক দেশের আধিপত্যের পক্ষে কোনো সমর্থন নেই, ব্লকভিত্তিক দ্বন্দ্বের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং অল্প স্থানের জন্য উঁচু দেয়াল তৈরি ভাল কিছু বয়ে আনবে না।
জাপানও বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন দেখতে চায়: বাংলাদেশে অতীতের চেয়ে ভালো নির্বাচন দেখতে চায় জাপান। গত ৭ জুন মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ডিক্যাব) এক ফোরামে এ মন্তব্য করেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেন, আমি আশা করি এখন থেকে শুরু করে আগামী বছরের মধ্যে সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব ধরনের উদ্যোগ হাতে নেবে, যেটি ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে উন্নত হবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন চলাকালীন সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাপান উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি সরকারি কর্মকর্তাদের আরও উন্নতমানের নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বলে যাচ্ছি। আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা অব্যাহত রাখবো। নাওকি আরও জানান, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে তারা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সব ভোটার তাদের পছন্দের ভোটারদের ভোট দিতে পারেন। এখন কী করবে বাংলাদেশ? এখন বাংলাদেশ কী করবে? এই প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর হলো, গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করছে। সেই লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। জনগণকে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দেশের সংবিধানে উল্লিখিত এই নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে: ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা, এ সকল নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এ সকল নীতির ভিত্তিতে- ১. রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে; প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে; এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণ্যবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। ২. রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করতে সচেষ্ট হবে। বিশেষ কোনো একটি দেশের প্রতি বেশি আনুগত্যের নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অন্য কোনো দেশের তাঁবেদারি করার কোনো সুযোগ নেই। এই উপলব্ধি জাগ্রত করা ছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষা করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক harunibnshahadat@gmail.com