আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শিরোভাগে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মতের দ্বিনকে সংস্কার করবেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৯১) দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ভারতবর্ষে তেমনি একজন সিংহপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। যাঁর নাম আহমদ, তিনি মুজাদ্দিদে আলফেসানি হিসেবে বেশি প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় আবহে লালিত-পালিত হওয়ায় বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ছাপ ছিল প্রকট। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি দ্বিনের সব বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিকতার জগতেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রভাবশালী বাদশা সম্রাট আকবরের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান সংস্কারক। সে সময় উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমান এক চরম সংকটময় মুহূর্ত পার করছিল। আকবর তাঁর সিংহাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধর্মের মিশেলে এক নতুন ধর্মের আবির্ভাব করেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিন-ই-ইলাহি’।
মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর কর্মজীবন: কর্মজীবনের শুরুতেই এ বিষয়টি (দ্বিন-ই-ইলাহির অসারতা) গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে এই মানুষের জীবনের গতিপথ বদলানো যায়। কারণ এই বিকৃতি সংশোধন করা খুব সহজ কাজ নয়। তখন তিনি ছিলেন আগ্রা শহরে। পরে তিনি আগ্রার শিক্ষকতা ছেড়ে ফিরে যান স্বদেশ সেরহিন্দে। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি মানুষের মাঝে শুরু করেন সংস্কারমূলক কার্যক্রম।
দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি: শুরুতেই তিনি কাজের গতিপথ নির্ধারণ করেন এবং তার সুন্দর একটি সূত্রও পেয়ে যান—রাজা ও রাজার আশপাশের লোকদের সংশোধন ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ব্যাপক বিকৃতি সংশোধন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তিনি ভাবলেন রাজা ও প্রজার সম্পর্ক হলো আত্মা আর দেহের মতো। সুতরাং রাজরূপী আত্মার সংশোধন হলে প্রজারূপী দেহ এমনিতেই সংশোধন হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও আমির-ওমরাদের কাছে তিনি ব্যাপকভাবে চিঠিপত্র লিখতে শুরু করলেন। মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন কোনটা ভ্রান্ত আর কোনটা শুদ্ধ। সুন্নতের উপকারিতা ও বিদআতের ভয়াবহতা তুলে ধরতেন সবার সামনে। তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও চিন্তা-চেতনায় মুগ্ধ হয়ে মানুষজন ভিড় জমাতে শুরু করে তাঁর চারপাশে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যেতে লাগল তাঁর এই চিন্তাধারা। কিন্তু মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর এই চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে সত্যান্বেষী মানুষের দল ভারী হতে দেখে দরবারি কিছু মানুষ রাগে-ক্ষোভে পেটে পড়ল। তারা রুখে দিতে চাইল মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর কার্যক্রম।
শুরু হলো অত্যাচার-নিপীড়ন: এরই মধ্যে আকবরের ইন্তেকালের পর আকবরপুত্র জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তখন মুজাদ্দিদে আলফেসানির বয়স ৪৩। এ সময়ে তিনি তাঁর এই মহান মিশনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র ছড়িয়ে গেল তাঁর এই আন্দোলনের তীব্রতা। এর ফলে স্বার্থান্বেষী মহলে আতঙ্ক দেখা দেয়। নিজেদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা শায়খ আহমদ সেরহিন্দির বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যায়। বাদশা জাহাঙ্গীর পিতার চিন্তা-চেতনার উত্তরাধিকারী ছিলেন এমন নয়, বরং বাবার আদর্শকে অক্ষুণ্নভাবে টিকিয়ে রাখতে ক্ষেত্রবিশেষে আকবরকেও ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন। কুচক্রী মহল মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর বিরুদ্ধে এই অপবাদ দেয় যে তিনি সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সম্রাটের রাজক্ষমতার জন্য হুমকিস্বরূপ। তখন সম্রাট মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করেন।
থেমে নেই দাওয়াতি কার্যক্রম: মুজাদ্দিদে (রহ.)-কে সম্রাটের ক্রোধ, দরবারিদের আক্রোশ, দুর্গের অন্ধকার ও বন্দিত্ব কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি দুর্গে অন্য লোকদের মধ্যে ইসলামের অমীয় বাণী প্রচার করতে শুরু করলেন। কোরআন-সুন্নাহর মনোমুগ্ধকর ব্যাখ্যা শুনে দলে দলে কয়েদিরা তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তাঁর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে চোর, ডাকাত, মদ্যপ, খুনিসহ যত অপরাধী আছে সবার জীবনের গতিপথ অল্প দিনেই পাল্টে যায়। জিন্দানখানা পরিণত হয় ইবাদতখানায়। এমতাবস্থায় জেল সুপার সম্রাটকে চিঠি লিখে পাঠান যে, নবাগত এই বন্দির প্রভাবে এখানকার পশুগুলো মানুষ আর মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়ে গেছে। এ কথা শুনে সম্রাট ঘাবড়ে গেলেন এবং অভিভূত হলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে মুক্তি দিয়ে সসম্মানে দিল্লি নিয়ে আসার আদেশ জারি করলেন। তাঁর ছেলে যুবরাজ শাহজাহানকে পাঠানো হলো তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে নিয়ে আসার জন্য। মুজাদ্দিদ (রহ.) সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সম্রাট ও আমির-ওমরাদের সামনে দ্বিন-ই-ইলাহির অসারতা প্রমাণ করে ইসলামের মূল আদর্শ এবং এর ব্যাখ্যা বলিষ্ঠ কণ্ঠে উপস্থাপন করেন। সম্রাট মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর দাবি মেনে নিলেন। কিন্তু দরবারিদের আক্রোশ থেকে তিনি রেহাই পেলেন না। তারা ভিন্ন অপকৌশল চালাল।
নজরবন্দি জীবন: কুচক্রীরা সম্রাটকে এ কথা খুব ভালোভাবে বোঝালেন, এই লোকটির প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক জনসমর্থন আছে। তাতে সে যেকোনো সময় সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসতে পারে। অতএব তাকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দেওয়া যায় না। সম্রাট তাদের কথার জালে আটকে মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে রাজ অতিথির সম্মানে সেনা ছাউনিতে নজরবন্দি করে রাখলেন। সেখানেও তিনি তাঁর আদর্শকে বিলকুল ভোলেননি। সে সময় তাঁর সঙ্গে বাদশার প্রতিদিন আলাপ-আলোচনা হতো। সেনাপ্রধান, দরবারের আমির-ওমরাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়ে ওঠে। তিনি সম্রাটের কাছে প্রতিনিয়ত ইসলামের মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান ও ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। এভাবেই তিনি রাজাকে পরিবর্তন না করে রাজার নীতি পরিবর্তন করে সফলতার পথ দেখেন। এভাবেই তিনি রাজপরিবারে দ্বিনের হাওয়া চালু করেন। যার সর্বশেষ ফল হচ্ছে বাদশা আলমগীরের মতো ন্যায়পরায়ণ খোদাভীরু শাসক। তথ্যসূত্র : তারিখে দাওয়াত ও আজিমত, শানদার মাজি, তাহরিকে দেওবন্দ