শুরু থেকেই মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাব অনুভব করেছে। এসব পেতে তারা সেই তখন থেকেই নিরন্তর সংগ্রাম করে আসছে। আদিকাল থেকে চলে আসা এ সংগ্রাম এখনও চলমান। বুদ্ধিমান আর ভাগ্যবান পরিশ্রমীরা এ সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। জয়ী মানুষেরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সংগ্রামে মানুষ যখনই জয়ী হয়েছে, তখনই তার মনবিলাস প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করেছে। সে প্রকৃতির মধ্যে অপরূপ রূপ-রসের সন্ধান করেছে। পূর্ণিমার চাঁদ তার কাছে প্রেমের সৌন্দর্য রূপে প্রতিভাত হয়েছে। অতঃপর সে সঙ্গীতে-সাহিত্যে এ রূপকে প্রকাশ করেছে। সে কবিতার ছন্দে মনের আনন্দে প্রেমের কবিতা রচনা করেছে। ক্ষুধামুক্ত মানুষটি তখন প্রকৃতির সৌন্দর্যে প্রেমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি ক্ষুধাকে জয় করতে পারেনি, তার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত কঠিন সংগ্রামে জীবনটা তার তিলে তিলে ক্ষয়ে গেছে। সংগ্রামে জর্জরিত মানুষটি প্রকৃতির সুন্দরকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষুধার অন্নই তখন তার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রার্থিত হয়ে দেখা দিয়েছে। তার সমস্ত চেতনা অন্নচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষটি সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য করার বিচারবোধ হারিয়ে ফেলেছে। অপূর্ব এই পৃথিবীটাকে তার কাছে গদ্যের মতো রসহীন কঠোর হয়ে উঠেছে। চারপাশের পরিবেশ তার কাছে অসহ্য যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার জলজলে চাঁদকে তার কাছে এক টুকরো ঝলসানো রুটি মনে হয়েছে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের, ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি,’ এ পংক্তি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তাহলো, ক্ষুধার যন্ত্রণা সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত মানুষের কাছে পৃথিবী কাব্যের মতো কোনো স্বপ্নময় আশ্রয় নয়। বরং গদ্যের মতো রসকষহীন ও একঘেঁয়ে। ক্ষুধার অনুভূতি তীব্র ও প্রচ-। দারিদ্র্যের নির্মম এ অনুভূতি মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয় থেকে রূপ-সৌন্দর্য তুলে নেয়। প্রেমের নান্দনিক বোধগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
আনন্দ-বেদনার সিঁড়ি বেয়ে মর্ত্যরে এ পৃথিবী ধাপে ধাপে উন্নতি সাধন করেছে। উন্নতি আর অগ্রগতিতে ধরনী নানান রূপে সজ্জিত হয়েছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিবর্তনের এ ধারা বহমান নদীর ন্যায় চলমান রয়েছে। উন্নতি আর অগ্রগতির পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেই শুরু থেকে চলে আসা ধনীক শ্রেণীর সংখ্যা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পাশাপাশি বঞ্চিত শ্রেণীর সংখ্যার বৃদ্ধির হার চলমান রয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ধনীক শ্রেণী সমাজকে পরিচালনা করেছে। সমাজের বড় বড় ব্যবসায়ী ও অসাধু প্রগতিবাদীরা ধনীক শ্রেণীতে যোগদান করেছে। সেক্যুলার লেখক, কবি ও সাহিত্যিকগণ তাদের লেখনির মাধ্যমে ধনীক শ্রেণীর হাতকে বেগবান করেছে। ধর্মহীন নাস্তিক ও ধর্মবিহীন বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতাসীনদের টিকিয়ে রাখার নেয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তারা ক্ষমতাসীনদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে প্রবল ক্ষমতাধর গোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে অর্থবিত্তশালীতে পরিণত হয়েছে। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার নৈতিক বল হারিয়ে ফেলেছে। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বাথর্কে মাটি চাপা দিয়েছে। ধনীক শ্রেণীতে চাটুকর ও ধান্ধাবাজদের পাল্লা ভারি হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে ধীরে ধীরে তারা নৈতিকতাকে কবর দিয়েছে। তারা ধর্মহীন জীবজন্তুতে পরিণত হয়েছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হয়েছে। রাষ্ট্রে ধনীরা আরো প্রবল ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ধনীর এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপরীতে ক্ষুধার্ত মানুষেরা উপেক্ষিত জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরিত হয়েছে। দিন দিন তাদের এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাচ্ছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ দেশের উন্নয়ন ও উন্নতি নিয়ে বেসামাল চাটুকারিতায় লিপ্ত রয়েছে। এসব চাটুকার ক্ষমতার মসনদ নিশ্চিত করতে নির্লজ্জ দলবাজিতে ব্যস্ত রয়েছে। তারা সরকারের নানা প্রকল্পের আওতায় টেন্ডার বিজনেসের মালিকানা হাতে পেয়েছে। ক্ষমতার দাপটে মোহাবিষ্ট স্বার্থান্বেষী মহলটি দেশপ্রেমিক বনে গিয়েছে! তাদের হাঁক-ডাকে বিরোধীপক্ষ দেশদ্রোহী গোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে। তাদের গলাবাজিতে নিজ দলের সজ্জন ব্যক্তিরা পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জননেতা উপাধি পেয়ে তারা জনতার মঞ্চ তৈরি করেছে। জনতার মঞ্চে তারা সরব থাকলেও ক্ষুধার্ত জনতা তাদের কাছে উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে। দেশের উন্নতি অগ্রগতি নিয়ে তারা সরব থাকলেও দেশের ক্ষুধাসূচক সমীক্ষার বিষয়ে একবারেই নীরবতা পালন করে চলেছে। সরকার ও বিরোধীপক্ষ নির্বাচনকেন্দ্রিক মাঠ গরমে ব্যস্ত থাকলেও ক্ষুধার্ত মানুষের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়েছে। এতসব কারণে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে দেশে আলোড়ন তৈরি হয় কিন্তু ক্ষুধার্তদের নিয়ে কোনো আলোড়ন তৈরি হয় না। দেশ সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখালেও এখন পর্যন্ত এটা একটা গরিব দেশ হিসেবেই পরিচিত। এখন পর্যন্ত দেশে প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। সেই হিসেবে বর্তমানে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৪ কোটির উপরে! সম্প্রতি বেসরকারি একটি গণমাধ্যমের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি। করোনা মহামারির কারণে তাদের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। এ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৭০ লাখ! অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিশে^ প্রতি ৯ জন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমায়। (দৈনিক ইনকিলাব, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬) এ হিসাব মতে, পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৯ কোটি। পৃথিবীতে ক্ষুধার সমান্তরালে যুক্ত হয়েছে পুষ্টিহীনতা। অর্থনৈতিক অন্য এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে অপুষ্টিতে জর্জরিত মানুষের সংখ্যা আড়াইশ কোটি! এই যখন অবস্থা তখন দেশে-বিদেশে খাদ্য ও অর্থ অপচয় রীতিমত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে বেহিসাব খাদ্য অপচয় হয়ে থাকে। অনেক মানুষের বাড়িতে খাবার উপচে পড়ে। অথচ, তার পাশেই অসংখ্য বনি আদমের হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনেপ ২০২১-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে মোট খাদ্য অপচয় হয় ১ হাজার ৬০ কোটি কেজি, যা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় ৪ বছরের খাবার! তার মানে, দেশের এক বছরের অপচয়কৃত খাদ্য দিয়ে দেশ থেকে স্থায়ীভাবে ক্ষুধা দূর করা সম্ভব। এছাড়া সরকারের নানা প্রকল্প আছে, আছে রিলিফ ও নানা রকম ভাতা। কিন্তু দেশে তার সফল বাস্তবায়ন নাই। জনগণ এসকল ভাতার সুফল ভোগ করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞগণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড়ো বাঁধা হিসেবে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। তারা মনে করেন, প্রকল্পে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অবকাঠামোগত গলদ থাকে। ফলে যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। বিধায় ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত সাফল্য পায় না। বর্তমান পৃথিবীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পৃথিবী বলা হয়। বিগত ৫০ বছরে বিজ্ঞান অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানের এ আবিষ্কার পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ ভূপৃষ্ঠকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে। সাগর, মহাসাগর ও আকাশ জগতকে তারা করায়ত্ব করেছে। মহাশূন্যে তারা স্টেশন নির্মাণ করেছে। এসব আবিষ্কারে বিশ^ মোড়লরা ব্যয় করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে অপচয় ও ক্ষতিকর আবিষ্কার হলো মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র। ২০২১ সালে বিশে^র পরমাণু অস্ত্রের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ২০২০ সালের চেয়ে আট গুণ বেশি। অথচ, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল করতে কাজ করছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু এবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস’। কিন্তু শক্তিধর দেশগুলো এ নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলেছে। এ নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে তারা প্রতি বছর আবিষ্কার করে চলেছে মানব বিধ্বংসী নতুন নতুন মারণাস্ত্র। আর এর পেছনে খরচ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এর পেছনে খরচ করেছে ৪৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। চীন খরচ করেছে ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়া করেছে ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। বৃটেন করেছে ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ফ্রান্স করেছে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ভারত করেছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর পাকিস্তান করেছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর এককভাবে উত্তর কোরিয়া করেছে ৬৪২ বিলিয়ন ডলার! সব মিলিয়ে ৯টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের এক বছরে অস্ত্র নির্মাণের ব্যয় ৭১৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ হলো ৭১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমান বাংলাদেশের ১২ বছরের বাজেটের সমান! (সূত্র: আইসিএএন) উন্নত দেশগুলোতে অপচয়ের এই যখন চিত্র, ঠিক তখনি এক মুঠো অন্ন আর দু’ ফোটা পানির অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে লাখ লাখ বনি আদম। একটি বড় গোষ্ঠি যখন বিলাসে ব্যস্ত, প্রাচুর্য আর অপচয়ের উৎসবে যখন তারা মত্ত, ঠিক তখন তারই অদূরে শোনা যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। ধনাঢ্য পরিবারের একজন শিশুর বিনোদনের জন্য লক্ষ-কোটি টাকাও যেখানে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না, সেখানে পূর্ব আফ্রিকার একদল কঙ্কালসার শরীরের শিশু এক ঢোক পানি আর একটা রুটির জন্য তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে। ভাবতে লজ্জা লাগে, সভ্যতার এ উৎকর্ষের মাঝেও পৃথিবীর চল্লিশ শতাংশ মানুষ এখনও ক্ষুধার্ত! বিশাল এ জনগোষ্ঠি ক্ষুধায় কাতর এবং পুষ্টিহীনতায় ক্লিষ্ট। তাদের চারপাশে কেবলই অভাব-অনটন আর ক্ষুধা-তৃষ্ণার পাহাড়। বাংলাদেশ এ ক্ষুধা-তৃষ্ণার বৃত্ত থেকে আজও বের হতে পারেনি। বিশ^ ক্ষুধাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। বিশ্ব ক্ষুধাসূচক ২০২১ অনুযায়ী, ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। সূচকের স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুধার মাত্রা গুরুতর পর্যায়ে রয়েছে। অবশ্য ২০২০ সালের তুলনায় বাংলাদেশে এ সূচকের উন্নতি ঘটেছে। গোটা বিশ্বের ক্ষুধার সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদ-ে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। উল্টো অনাহার ও খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে। পিপিআরসির জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গরিব মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটির বেশি। সিপিডির মতে, দেশে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশ এরং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৭৭ লাখের বেশি। আর এসব মানুষ ক্ষুধার্ত জনতার অন্তর্ভুক্ত।
আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধির কথা বলছি। কিন্তু গরিবের ঘরে ক্ষুধার তীব্রতার কথা বলছি না। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরেও একটি ছেলের বেকার থাকার কথা বলছি না। আমরা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে টাকা প্রদানের কথা বলছি। কিন্তু গরিবরা তা কেন পাচ্ছে না, তার কারণ বলছি না; বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ও মাতৃত্বকালীনভাতা বিলানোর কথা বলছি, কিন্তু স্থানীয় দলীয় নেতাদের চুরি করার কথা বলছি না। মুক্তিযোদ্ধাভাতা ও প্রতিবন্ধীভাতার কথা বলছি, কিন্তু দালাল আর ধান্ধাবাজ নেতারা তা মেরে খাচ্ছে, এ কথা বলতে পারছি না। এটাই হলো আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাবাহিক চিত্র। এভাবেই আসল সত্যিটা কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। সত্য গোপন করে আজ আমরা উন্নয়নের ফানুস নিয়ে মিথ্যে আনন্দে গদগদ হয়ে পড়েছি। আমরা নানা আমোদে-আহ্লাদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি। কিন্তু আমাদের চোখে গরিবের সংকট ধরা পড়ে না। চোখে পড়ে না গরিব কৃষকের ঘাম ঝরা গল্প। খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষুধা আর অনাহারির আর্তনাদের ইতিবৃত্ত আমাদের নজরে আসে না। ফলে দেশ ক্ষুধামুক্ত হবার পরিবর্তে ক্ষুধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরিব আরও গরিব আর লুটপাটকারী ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। লন্ডন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স’র প্রতিবেদন ২০১৮-তে বলা হয়েছে, বিশ্বেআড়াইশ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক আছে এমন সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে এ সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে, যা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ মোটি ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ! উক্ত সংস্থার ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রয়েছে আরেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে গত এক দশকে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকা দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
বুঝা গেল, দেশে কোটিপতির সংখ্যা কয়েকশগুণ বৃদ্ধি পেলেও দারিদ্র্যের হার বাড়ছে কয়েক হাজার গুণ। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নধ্যবিত্তে এবং নিম্নধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তে অধোক্রম হচ্ছে। একদিকে কিছু লোক অঢেল টাকার মালিক হচ্ছে, অন্যদিকে সিংহভাগ লোকের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে সমাজে বৈষম্য বেড়ে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। বৈষম্যের কারণে সমাজে ন্যায়বিচার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে। তাদের বিত্তবৈভবে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষ। বৈষম্যের পৃথিবীতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা‘ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া,dr.knzaman@gmail.co