শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন

৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটি ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া নামে পরিচিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এই অর্থ দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে। এই বোঝা হালকা করতে সরকারকে যেমন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তেমনি বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত টাকাটা গ্রাহকদের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি কেন্দ্রকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতেও থাকছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের করা ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন বা কেনা না হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট হারে অর্থ (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করতে হবে। এই ৯০ হাজার কোটি টাকা সেই অর্থ, যা কম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই পেয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ধারণা ছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোবে, তাতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেভাবে বিদ্যুিভত্তিক উৎপাদন বা শিল্প-কারখানা হয়নি। তাই এখন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তা না হলে, অতিরিক্ত দামের বিদ্যুতের কারণে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তেলভিত্তিক কিছু কেন্দ্র আছে, যেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না, অথবা সারা বছরে অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সেগুলোকে শতকোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এমন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
ম. তামিম বলেন, মূলত বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রিজার্ভ রাখতে হয়। এই কেন্দ্রগুলো যখন বসে থাকবে, তখন শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে। তবে রিজার্ভে রাখার বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করে রাখতে হবে, যাতে কোনোভাবেই অতিরিক্ত না হয়।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া। যদি কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে না রাখা হয়, তাহলে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উঠে গেলে সেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কে দেবে? পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য বাকি সময় অলস বসে থাকার জন্য যে চার্জ দেওয়া হয় তা-ই ক্যাপাসিটি চার্জ।
এলএনজিভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রও ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে
বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে টাকা ব্যয়ের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের এক হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) আরো তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটি নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে।
চলতি বছরের অক্টোবরে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা। বাকিটির উৎপাদনের সময় আগামী বছরের মার্চ নাগাদ শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ব্যাপক বেড়েছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে পিডিবিকে।
এই বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলএনজি কোথা থেকে আসবে, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এলএনজির অভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘এটা একটা মারাত্মক ভয়ের ব্যাপার। সামনে এই কেন্দ্রগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এলএনজি না দিতে পারলে একসময় এমন হতে পারে, দেশের বিভিন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে এগুলোকে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ করতে হতে পারে। গ্যাসসংকটে এখনই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ’ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনও কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলএনজিভিত্তিক এই তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে গ্যাসসংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমন সংকট যে চলে আসবে, তা তো আগে জানার উপায় ছিল না। তবে এই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে আসতে দেশীয় কূপগুলো থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়তে পারে। ’
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র : দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ৪,৫০০ কোটি টাকা
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় এখন কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। কেন্দ্রটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলেও গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ চলতি বছরের ডিসেম্বরেও শেষ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই কেন্দ্র থেকে পুরো বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াই আরো ছয় মাসের বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে।
জানতে চাইলে ম. তামিম বলেন, সঞ্চালন লাইনের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ আনা যাচ্ছে না। কয়েক মাস পর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও উৎপাদনে আসবে। রামপালের বিদ্যুৎও একই সঞ্চালন লাইন দিয়ে আসবে। তাই এই সঞ্চালন লাইন যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে করা না যায় তাহলে পায়রার মতো রামপালকেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
রেন্টাল, কুইক রেন্টালের ‘স্বল্প মেয়াদ’ দীর্ঘ হচ্ছে
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় অতি দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুরু করে। এরপর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। সেই আপৎকালীন ‘স্বল্প মেয়াদ’ আজও শেষ হয়নি। অর্থনীতির ওপর বোঝা তৈরি করার পরও বারবার বাড়ানো হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। বাকি আটটিকে আগের নিয়মে ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের। এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো তা আমি বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরো কয়েকটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে বলে মনে হয়।’
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দাবি করেন, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল এখন আর নেই। এখন যেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে না। বিদ্যুৎ আমদানিতেও ক্যাপাসিটি চার্জ: ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য ভারতের ঝাড়খ-ে আদানি গ্রুপের নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী মাসের শেষ দিকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ইউনিটের ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও সাবস্টেশন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে ৪০০ মেগাওয়াট দেশে আনা হতে পারে। চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে আদানি গ্রুপকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা দিতে হবে। জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে। শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের চাহিদাই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের জন্য করা হয়নি। ব্যবসা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে সরকারের টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com