অনেক প্রতীক্ষার পর নাম ঘোষণা করা হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কনজারভেটিভ পার্টির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। পুরো নাম মেরি এলিজাবেথ ট্রাস। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুলাই ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন কেনেথ এবং প্রিসিলা মেরি ট্রাসের ঘরে জন্মগ্রহণ। ছোটবেলা থেকেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন এলিজাবেথ নামে। তার বাবা ছিলেন লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। মা-ও ছিলেন শিক্ষক। ট্রাসের বয়স যখন চার বছর, তখন তার পরিবার চলে আসে স্কটল্যান্ডে। অক্সফোর্ডের মেরটন কলেজে পড়াশোনা করেছেন ট্রাস। সেসময় লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন তিনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি লিবারেল ডেমোক্র্যাটসের প্রেসিডেন্ট এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট যুব ও ছাত্রদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন লিজ ট্রাস। তবে ১৯৯৬ সালে স্নাতক হওয়ার পর যোগ দেন কনজারভেটিভ পার্টিতে।
বামপন্থি পরিবারে জন্ম নেয়া ট্রাস প্রথমে লিবারেল ডেমোক্র্যাট ছিলেন। তবে ২০১০ সালে তিনি কনজারভেটিভ পার্টি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ট্রাস ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ছিলেন। তবে ব্রিটিশরা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিলে তিনি দ্রুতই ব্রেক্সিটের কট্টর সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। এরপর ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লিজ ট্রাসকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গড়া প্রতিনিধি দলের প্রধান করেছিলেন। গতবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ট্রাস।
লিজ ট্রাস যেসব পোশাক পরেন এবং ছবি তোলার জন্য যেসব জায়গা বেছে নেন, যেমন এস্তোনিয়ায় গিয়ে ট্যাঙ্কে এবং মস্কোয় গিয়ে পশমের টুপি পরে ছবি তোলা, ইত্যাদি কারণে অনেকে তাকে প্রথম নারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি রাশিয়ার কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত।
বেশ কিছু কেলেংকারির কারণে গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন বরিস জনসন। এরপরই কনজারভেটিভ দলের নতুন প্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হয়েছে। ভোটার ছিলেন কনজারভেটিভ দলের প্রায় দুই লাখ সদস্য। ভোটে ট্রাস সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে পরাজিত করেন। সুনাক জিততে পারলে তিনি ব্রিটেনের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হতেন। মোট ভোট পড়েছে ৮২.৬ শতাংশ। ট্রাস পেয়েছেন ৮১,৩২৬ ভোট। সুনাক পেয়েছেন ৬০,৩৯৯টি।
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীর উত্থান যেভাবে: ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে বিজয়ী স্বল্প পরিচিত রাজনীতিক লিজ ট্রাসের রাজনৈতিক উত্থান কীভাবে? তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বিভিন্ন সময়ে কীভাবে বদলেছে?
ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাবার ব্রেক্সিট গণভোটে ইউরোপে থাকার পক্ষে সমর্থন দিয়ে প্রচার চালানো লিজ ট্রাস পরবর্তীতে কনজারভেটিভ দলের কট্টর দক্ষিণপন্থী ব্রেক্সিট সমর্থকদের একান্ত প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
একসময় উদারপন্থী লিবারেল ডেমোক্রাট দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন লিজ ট্রাস, ১৯৮০র দশকে মার্গারেট থ্যাচারের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে সোচ্চার ছিলেন। এখন তার দাবি থ্যাচারের আলোকবর্তিকা সমুন্নত রাখাই হবে তার ব্রত। তার কিশোরী জীবনে ছাত্র রাজনীতির দিনগুলোতে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে লিবারেল ডেমোক্রাট দলের সম্মেলনে তিনি আবেগপূর্ণ আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি মনে করেন তার ওই মন্তব্য ছিল ভুল” এবং তিনি বিশ্বাস করেন ব্রিটেনের ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য রানি ও রাজপরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য”। এলিজাবেথ ট্রাস, যিনি রাজনীতির দুনিয়ায় পরিচিতি লিজ ট্রাস নামে, তার রাজনৈতিক যাত্রাপথ বর্ণময় এবং বিভিন্ন সময়ে মতাদর্শ বদলের কারণে বেশ ঘটনাবহুল।
নকল নির্বাচনে ভরাডুবি: লিজ ট্রাসের বয়স যখন সাত, তখন তার স্কুলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে নকল করে সাজানো এক অনুষ্ঠানে তিনি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের অভিনয় করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৮৩ সালের ওই নির্বাচনে যেখানে মার্গারেট থ্যাচার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, মিজ ট্রাস ওই মক নির্বাচনে কোন সাফল্যই দেখাতে পারেননি। বহু বছর পর সেই দিনের কথা স্মরণ করে মিজ ট্রাস বলেছিলেন: আমি স্কুলে মক নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে অভিনয়ের সুযোগটা লুফে নিয়েছিলাম এবং সাজানো ভোটারদের উদ্দেশ্যে খুবই আবেগময় আবেদন জানিয়েছিলাম আমাকে ভোট দেবার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা ভোটও পাইনি। এমনকি আমি নিজেও নিজেকে ভোট দিইনি।” এর ৩৯ বছর পর লিজ ট্রাস ‘আয়রন লেডি’ নামে খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের পথ অনুসরণ করে আসল প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে নামেন এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে জয়ী হন। কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের পাঁচ দফা ভোটাভুটির প্রত্যেকটিতে লিজ ট্রাস তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন।
বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ে লিজ ট্রাস সবসময় তার পাশে ছিলেন এবং তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন স্তরে অনেক দিন ধরেই তিনি একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যেটা বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন এই দৌড়ে তার জয়ের পথ সুগম করেছে।
‘রাজতন্ত্র অবসানের আহ্বান: অনেক দিক থেকেই লিজ ট্রাসকে অস্থি মজ্জায় জ্ন্মগত টোরি (কনজারভেটিভদের আরেক নাম) বলা যাবে না। রাজনীতিতে তার উত্থান এবং যাত্রা এমন এক পরিবার থেকে যে পরিবার, মিজ ট্রাসের নিজের বর্ণনায়, ছিল বামপন্থী। আপোষহীন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের দাবিতে তার বাবা-মায়ের সাথে প্রচারাভিযানে অংশ নিতেন মিজ ট্রাস। অক্সফোর্ডে ১৯৭৫ সালে জন্ম লিজ ট্রাসের। তার বাবা ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক আর মা নার্স। মিজ ট্রাসের বর্ণনায় দুজনেই ছিলেন বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ক্যাম্পেইন ফর নিউক্লিয়ার ডিসআর্মামেন্ট নামে একটি পরমাণু অস্ত্র বিরোধী সংস্থার প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতেন তার মা। সঙ্গে যেতেন লিজ ট্রাস। মার্গারেট থ্যাচার সরকারের লন্ডনের পশ্চিমে রয়াল এয়ার ফোর্সের গ্রিনহাম কমন ঘাঁটিতে আমেরিকার পরমাণু শক্তিসম্পন্ন সমরাস্ত্র বসানোর অনুমতি দেবার কট্টর বিরোধী ছিল এই সংস্থা এবং নিয়মিত তারা বিক্ষোভ মিছিল করত।
তার চার বছর বয়সে মিজ ট্রাসের পরিবার গ্লাসগোর পশ্চিমে পেসলি নামে একটি অঞ্চলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার ভাই বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন তাদের পরিবারে সবাই দাবা খেলতে ভালবাসতেন, কিন্তু তরুণী মিজ ট্রাস পরাজয় মেনে নিতে পারতেন না। ফলে পরিবার খেলতে বসলে হেরে যাবার ভয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াতেন। খেলার সময় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। পরে তাদের পরিবার চলে যান উত্তর ইংল্যান্ডের লিডসে। সেখানে রাউন্ডহে নামে একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে তিনি পড়ালেখা করেন।
প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য লড়াইয়ের সময় বারবার এই স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতা তিনি টানেন। তিনি বলেন, তিনি ওই স্কুলে দেখেছেন সহপাঠীদের ব্যর্থতা এবং কীভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবে তারা জীবনে এগোতে পারেনি”। তবে, সেসময় তার সাথে ওই স্কুলে সহপাঠী ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন, ওই স্কুলে শিক্ষার মান নিয়ে তার এই মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন সাংবাদিক, যিনি তার সহপাঠী ছিলেন, বলেছেন: তিনি কিছুটা ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছেন, হয়ত সেটা তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, এবং সম্ভবত রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ওই স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের ব্যর্থতার দিকটি সামনে আনতে চেয়েছেন।” তবে, তার স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা ও অর্জন যেমনই হোক, মিজ ট্রাস উচ্চ শিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান এবং সেখানে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।
ছাত্র রাজনীতিতে তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন। তবে তিনি প্রথমে যোগ দিয়েছিলেন মধ্যপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী লিবারেল ডেমোক্রাটিক পার্টিতে এবং তাদের হয়ে ছাত্র রাজনীতি করতেন।
তিনি ১৯৯৪ সালে উনিশ বছর বয়সে লিবারেল পার্টির সম্মেলনে বলেন রাজতন্ত্র শেষ হোক”এই মতের তিনি পক্ষে। এই মতের পক্ষে তিনি যুক্তি তুলে ধরে সম্মেলনে রাজতন্ত্র অবসানের জন্য আহ্বান জানান। তিনি ব্রাইটনের সম্মেলনে উপস্থিত দলের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন: আমরা, লিবারেল ডেমোক্রাটরা, সকলের জন্য সুযোগের আদর্শে বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বাস করি না- শাসন করার এখতিয়ার নিয়ে কেউ জন্মেছে।” তিনি বলেন: গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ইস্যুতে গণভোট নেওয়ায় আমরা বিশ্বাসী। আমরা মনে করি না, জন্মসূত্রে শাসনের অধিকার কারও জন্মায়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে, এমন বিষয় নিয়ে তারা নিজেদের মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন – এমন আদর্শের আমরা বিরুদ্ধে।”
তার ওই ভাষণের ক্লিপ এখন ছড়িয়ে পড়ার পর মিজ ট্রাস বলেন রাজতন্ত্র নিয়ে তার ওই মন্তব্য ছিল “ভুল”। তিনি এনিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, তিনি এখন বিশ্বাস করেন যে, ব্রিটেনের সফল অগ্রযাত্রায় রানি এবং রাজপরিবারের অবদান “অপরিহার্য”।
রক্ষণশীল রাজনীতিতে উত্থান: স্নাতক হবার পর অক্সফোর্ডে থাকাকালীনই ১৯৯৬ সালে মিজ ট্রাস দল বদল করে কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন। স্নাতক হবার পর তিনি শেল ও কেবল অ্যান্ড ওয়ালেস কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টেট হিসাবে কাজ করেন। ২০০০ সালের প্রথম দিকে তিনি তার এক সহকর্মী অ্যাকাউন্টেট, হিউ ওলিয়ারিকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান। মিজ ট্রাস ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর ইংল্যান্ডে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রথম ভোটে দাঁড়ান, কিন্তু হেরে যান। ২০০৫ সালে একই এলাকায় আরেকটি নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও হেরে যান। কিন্তু তারপরেও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে তিনি রাজি ছিলেন না। দক্ষিণ পূর্ব লন্ডনের গ্রেনিচ থেকে তিনি পৌরসভার কাউন্সিলার নির্বাচিত হন ২০০৬ সালে। এরপর ২০০৮ সাল থেকে তিনি সংস্কার বিষয়ে ডানপন্থী একটি গবেষণা সংস্থার হয়ে কাজ শুরু করেন। কনজারভেটিভ নেতা ডেভিড ক্যামেরন তাকে ২০১০ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতার তালিকায় উপরের সারিতে রাখেন এবং দক্ষিণ পশ্চিম নরফোকের একটি নিরাপদ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাকে মনোনয়ন দেন। এরই মধ্যে তার ভোটে দাঁড়ানো হঠাৎ করেই হুমকির মুখে পড়ে যখন একজন এমপির সঙ্গে কয়েক বছর আগে তার প্রেমের একটি মুখরোচক খবর ফাঁস হয়ে যায়। তার প্রার্থী হবার যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
কিন্তু রাজনীতি থেকে তাকে হঠানোর সবরকম চেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেন এবং ২০১০ সালের ওই নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১৩ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতে তিনি প্রথম এমপি হন।
এমপি হবার দু বছরের কিছু পরেই ২০১২ সালে তিনি সরকারের শিক্ষা দপ্তরের একজন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং এর দুবছর পর ২০১৪ সালে ক্যাবিনেটে পূর্ণ মন্ত্রী পদে তার পদোন্নতি হয় এবং তাকে পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে তিনি বিচার মন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য সচিবের দায?িত্ব পালন করেন। বরিস জনসন ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হলে মিজ ট্রাস আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মন্ত্রীর দায?িত্ব পান এবং ২০২১ সালে তিনি সরকারের অন্যতম একটি শীর্ষ পদ- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
কনজারভেটিভ পার্টির পেছনের সারি থেকে যেভাবে সরকারের শীর্ষ পদে লিজ ট্রাসের দ্রুত উত্থান ঘটেছে, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছে। তিনজন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে লিজ ট্রাস ছয়টি মন্ত্রী পদে দায?িত্ব পালন করার পর এবং দীর্ঘদিন কনজারভেটিভ রাজনীতির মুল ধারায় যুক্ত থাকার পরেও ব্রিটেনের বহু মানুষ বলেছেন লিজ ট্রাস তাদের কাছে সেভাবে পরিচিতি একজন রাজনীতিক নন, যেমনটা ছিলেন বরিস জনসন।
ব্রেক্সিট -ইউ-টার্ন: লিজ ট্রাস পূর্ণ মন্ত্রী হবার দু বছর পরই অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে কার্যত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল ঘটনা- ব্রেক্সিট – ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেন থাকবে কিনা তা নিয়ে গণভোট।
ওই গণভোটে ইইউর সাথে থাকার পক্ষে প্রচারণা চালান লিজ ট্রাস। ব্রিটেনের সান সংবাদপত্রে তিনি লেখেন যে, ব্রেক্সিট হলে সেটা ব্রিটেনের জন্য তিনটি ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনবে- ইইউর কাছে কোন পণ্য বিক্রি করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আসবে আরও আইনকানুন, চলবে আরও ফর্মপূরণের হিড়িক আর তৈরি হবে আরও বিলম্ব।” তবে গণভোটে ব্রেক্সিটপন্থীরা জয়ী হলে মিজ ট্রাস তার মত বদলে ফেলেন। তিনি যু্ক্িত দেখান ব্রেক্সিট বর্তমানে যেভাবে কাজকর্ম হয় তা সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে”।
তার সমর্থকরা এটাকে মত পাল্টানো হিসাবে দেখেন না। তারা বলেন মিজ ট্রাস ২০১৬র গণভোটের ফলাফল মেনে নিয়েছেন এবং ব্রেক্সিটকে আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে কাজে মন দিয়েছেন। কিন্তু তার সমালোচকরা বলেন, তিনি হাওয়া কোনদিকে বইছে সেটা বুঝে নিজের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করেন।
রাশিয়া ও ব্রাসেলসে অজনপ্রিয়তা: মিজ ট্রাস ২০২১ সালে ডমিনিক রাবের স্থলাভিষিক্ত হবার পর ব্রেক্সিট পরবর্তী উত্তর আয়াল্যান্ডের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার জট ছাড়ানোর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে – এবং ইইউর সঙ্গে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্যবস্থা নিয়ে সম্পাদিত চুক্তি ব্রিটেন বাতিল করার কারণে ইইউর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে লিজ ট্রাস নেটো এবং ইউক্রেনের সমর্থনে রাশিয়া ও ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচনা করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ভ্লাদিমির পুতিনের সমস্ত বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে তাড়াতে ব্রিটেন বদ্ধপরিকর। যেসব ব্রিটিশ ইউক্রেনে গিয়ে লড়াই করতে চায়, তাদের প্রতি সরকারের সমর্থন আছে এমন মন্তব্য করে তিনি সামলোচনার মুখে পড়েন। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জোরের সাথে এধরনের কোন সরকারি সমর্থনের কথা অস্বীকার করে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরফ বলেন, এই সংঘাতের পেছনে যে ভৌগলিক কারণ রয়েছে সেটা যে পশ্চিমা দেশগুলো বোঝে না তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন লিজ ট্রাস। ফেব্রুয়ারি মাসে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রস্তভ এবং ভোরোনেয নামে দুটি এলাকা রাশিয়ায় না কি ইউক্রেনে সে নিয়ে মিজ ট্রাস বিভ্রান্ত ছিলেন বলে মন্তব্য করেন মি. লাভরফ। কিন্তু ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলেন মি. লাভরফের কথা মিজ ট্রাস বুঝতে পারেননি এবং এটা আগ্রাসন থেকে দৃষ্টি ফেরাতে ছিল রাশিয়ার প্রচারণা।
তবে লিজ ট্রাসের সঙ্গে বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন যখন ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের পটভূমিতে কূটনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেব্রুয়ারিতে এক আলোচনায় বসেন। আলোচনার পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মিজ ট্রাসকে পোডিয়ামে রেখে মি. লাভরফ বেরিয়ে যান এই বলে যে, মিজ ট্রাসকে কিছু বলা একজন বধিরকে কিছু বলার মত” এবং রাশিয়া তার নিজের এলাকায় কী করবে সেটা তার মাথাব্যথার বিষয় নয়”।
ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন এসব সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেছে প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর মস্কো এবং ইইউর সাথে যেসব ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো লিজ ট্রাস কীভাবে সামাল দেন সেটাই এখন দেখার।
পাশপাশি ব্রিটেনের ভেতরেও তার সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। লিজ ট্রাস এমন এক সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত নিতে চলেছেন, যখন দেশটিতে মূদ্রাস্ফীতি হু হু করে বাড়ছে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ বিরাট সংকটের মুখে পড়েছে।
বিশেষ করে রাশিয়া ইউক্রেন সংকটের ফলে আসন্ন শীত মৌসুমে ইউরোপে জ্বালানি গ্যাসের ঘাটতির কারণে যে সংকট তৈরি হবে, সেটিই নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।