শেষমেশ খুলে দেয়া হচ্ছে লোটাস টাওয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে অবজারভেশন ডেক। শ্রীলংকার মাটিতে চীনা ঋণে নির্মিত সবুজ ও বেগুনি রঙের বিশাল টাওয়ার। সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে পরিবারের সঙ্গে বেইজিংয়ের যে দহরম-মহরম সম্পর্ক তারই প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী খেতাব পায় শ্রীলংকার ‘সাদা হাতি’ নামে। গত সোমবার টাওয়ারটি খুলে দেয়ার খবর নতুন করে শিরোনাম হয় বিশ্ব মিডিয়ায়। খবর দ্য স্ট্রেইটস টাইমস। ‘সাদা হাতি’ শব্দযুগলের পেছনে আলাদা তাৎপর্য আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো অ লগুলোয় সাদা হাতিকে পবিত্রতা এবং আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। একসময় রাজারা পুষতেন এ হাতি। কোনো কারণে রাজার কাছ থেকে সাদা হাতি উপহার পাওয়া ছিল একই সঙ্গে প্রাপ্তি আর বিড়ম্বনা। প্রাপ্তি হলো এ হাতি রাজার সুদৃষ্টির প্রমাণ। আর বিড়ম্বনা হলো এ হাতি পবিত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে পার্থিব কাজে লাগানো যাবে না। উপরন্তু হাতিটির খাওয়া-দাওয়ার জন্য বেড়ে যাবে পারিবারিক খরচ। শ্রীলংকার মতো দেশের জন্য লোটাস টাওয়ার তাই বিশ্ব মিডিয়ার বয়ানে অনেকটাই সেই সাদা হাতি।
লোটাস টাওয়ারের উচ্চতা ৩৫০ মিটার। এশিয়ায় ১১তম এবং বিশ্বে ১৯তম উঁচু টাওয়ার। কলম্বোর যেকোনো প্রান্ত থেকেই দৃশ্যমান। নির্মাণে খরচ হয়েছে আনুমানিক ১১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলে ২০১২ সালে নির্মাণ শুরু হয় টাওয়ারের। প্রথম থেকেই নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম জড়িয়েছে এ নামের সঙ্গে। মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং তার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে বেশকিছু বিলাসী প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে সেই ‘সাদা হাতি’ প্রজেক্টগুলোর ভূমিকা কম নয়। গত মে মাসে গণবিদ্রোহে ক্ষমতা হারান মাহিন্দা রাজাপাকসে। জুলাইয়ে গদি ছাড়তে হয় গোতাবায়া রাজাপাকসেকেও।
লোটাস টাওয়ার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির নির্বাহী প্রধান প্রসাদ সমরসিংহে বলেন, ‘আমরা একে বন্ধ রাখতে পারি না। দেখাশোনার খরচই অনেক। সেই অর্থটুকু আমরা আপাতত বের করে আনতে চাই। চাই টাওয়ারকে বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করতে।’ টাওয়ারের সঙ্গে দোকান এবং অফিসগুলো ভাড়া দেয়া হবে। ভাড়া দেয়া হবে অবজারভেশন ডেকের ঠিক নিচেই অবস্থিত ঘূর্ণায়মান রেস্টুরেন্টটি। সেখান থেকে উপভোগ করা যাবে রাজধানী ও ভারত মহাসাগরের সৌন্দর্য। তবে দ্বীপ রাষ্ট্রটির অনেক কিছুই দেখা যাবে না এখান থেকে। সোমবার স্থানীয় মিডিয়া সেটার সমালোচনা করেই মন্তব্য করেছিল, ‘অহংকার আর অপচয়ের অতিকায় এক গল্প’। কেউ অবশ্য টাওয়ারটিকে চীনের সেন্ট্রাল রেডিও অ্যান্ড টিভি টাওয়ারের ব্যর্থ অনুকরণ মনে করতে চান। বেইজিংয়ে অবস্থিত সেই টাওয়ারের উচ্চতা ৪০৫ মিটার।
মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন ২০০৫-১৫ সাল পর্যন্ত। গোটা সময়জুড়ে ব্যাপকভাবে ঋণ নেয়া হয় চীনের কাছ থেকে। হাতে নেয়া হয় একরাশ ব্যর্থ প্রকল্প। তাদের মধ্যে একটা গভীর সমুদ্রবন্দরও ছিল। ২০১৭ সালে সমুদ্রবন্দরটির পরিচালনার দায়িত্ব ৯৯ বছরের জন্য বেইজিংয়ের হাতে দিয়ে দেয় রাজাপাকসে সরকার। শ্রীলংকায় চলমান অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে অন্যতম নিয়ামক সেই চীনা ঋণ। কলম্বোর বর্তমান বিদেশী ঋণ ৫ হাজার ১০০ কোটি, যার ১০ শতাংশই চীনের কাছ থেকে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল শ্রীলংকাকে বিশেষ শর্তে ২৯০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এ ঋণ নির্ভর করবে শ্রীলংকার সরকার ঋণদাতা দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি পুনর্গঠন করে কিনা তার ওপর। অন্যদিকে বেইজিং এখনো দিয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত ঋণের প্রস্তাব। শ্রীলংকার এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই গত সোমবার লোটাস টাওয়ার খুলে দেয়ার ঘোষণা এল।