সময়ের সীমারেখা শেষ হতে তখনো এক মুহূর্ত বাকি, তবে অপেক্ষার বাঁধ আর বেঁধে রাখতে পারেনি ষোল কোটি বাঙালি। রেফারি তখনো বাশি ফুঁ দিয়ে সারতে পারেনি, গর্জে উঠে সমস্বরে সবাই একসাথে, ‘আমরা পেরেছি, আমরা জিতেছি’ স্লোগানে। হাজারো মাইলের দূরত্বে, তাতে কী যায় আসে! আহ! কী শান্তি, কী তৃপ্তি, কী তার অমৃত সুধা যে! দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব আমাদের, শিরোপা আমাদের; আমরাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের রানি।
ড্রেসিংরুম থেকে সতীর্থরা ছুটে আসছেন, কোচ ম্যানেজমেন্টও তাদের পিছু নিয়েছেন। কেউ হয়তো কাউকে জড়িয়ে ধরছেন, চেপে ধরে কেঁদে উঠছেন। তবে এই কান্না ব্যথার নয়, এই কান্না শোকের নয়, এই কান্না ব্যর্থতার নয়। এই কান্না আনন্দের, এই কান্না সুখের, এই কান্না শিরোপা জয়ের। কেউ হয়তো সিজদাহ্য় লুটিয়ে পড়ছেন সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞক্তায়, কেউ বা মুখে হাত চেপে নির্বাক ভাবনায়। কেউ যেন পারলে ডানা মেলে উড়ে, উড়ে আসে লাল-সবুজের নিশান উড়িয়ে প্রিয় জন্মভূমিতে। এই ডানা মেলে উড়া তো তাদেরই মানায়, বাংলাদেশের রাতের আকাশও যে আজ আলোকিত তাদের আলোতে।
সানজিদা যে বার্তা দিয়েছিলেন ম্যাচের আগে, ফেসবুকের নীল জগতে। তখনই বোঝা গিয়েছিলো বাঘিনীরা লক্ষ্যে অনড় দৃপ্ত শপথে, দৃঢ় মনোবলে। ওই মনোবল একটিবারের জন্যও দুর্বল হয়নি, বরং সময়ের সাথে সাথে দুর্লভ হয়েছে প্রতিপক্ষ নেপাল, তাদের মাঠ, তাদের আবহাওয়া, তাদের পক্ষে জনসমর্থনের জোয়ার। মাঠের এগারোর সাথে দশরথ রঙ্গশালার ১৫ হাজার জনতাও যেন খেলছিল নেপালের সাথে। তবে সেই জোয়ারে ভাটা পড়ে ১৪ মিনিটেই। শামসুন্নাহারের গোলে স্তব্ধ হয়ে যায় সকলে। যখন মনে হচ্ছিল হয়তো খানিকটা রঙ ফিরে পেতে চলেছে নেপাল, তখনই ফের বাংলাদেশ খুঁজে পেল জাল। এবার ত্রাতা কৃষ্ণা রাণী সরকার। উদ্দীপনা আর উদ্দমে উজ্জীবিত বাংলাদেশ যদিও একবার চমকে গেছে, তবে ফের খেলায় ফিরেছে কৃষ্ণায় ভর দিয়ে। আসলে এই বাংলাদেশকে থামাবে কে? ওদের রক্তে তো জোয়ার উঠেছে। যে জোয়ার উঠিয়ে দিয়েছিলেন সানজিদা তার লেখায়, বাংলাদেশ যেন জিতে গেছে তাতেই। ২০০৩ সালে শেষবার সাফ শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ পুরুষ দল। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এর পর আর পারেনি কেউ আর। পরের গল্পটা শুধুই হতাশার, ধূসর মলিন প্রতিটি অধ্যায় তার। ক্রিকেটের জয়গানে ফুটবল যেন হারিয়ে চুপসে গিয়েছিল ব্যর্থতার চোরা স্রোতে। তবে ফুটবল যে বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তা বোঝা যায় এমনি কিছু কিছু মুহূর্তে। আজ যেন গোটা বাংলাদেশ এক হয়ে গেছে, একই সুতোয় নিজেদের গেঁথেছে, সবাই তাকিয়ে ছিল দশরথে, অপেক্ষায় ছিল শেষ বাঁশি কখন বাজবে!