সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করতে ঢাকায় কর্মরত আশিয়ান বহির্ভূত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের ডেকেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে তাতে অংশ নেননি চীনের রাষ্ট্রদূত লি জি মিং। চীনের এই সাড়া না দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে বিষয়টি তারা ‘নোটিশ’ করেছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমার বিষয়ে চীনের এমন অবস্থানে তারা কষ্ট পেলেও ‘সারপ্রাইজড’ নন।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মঙ্গলবার সকালে হয় এই বৈঠক। এতে রাশিয়া ও ভারতের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত না থাকলেও পাঠিয়েছেন প্রতিনিধি। কেবল অনুপস্থিত থেকেছে চীন।
বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিশর, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল, সৌদি আরব, জাপানসহ প্রায় সব দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
চীনের অনুপস্থিতিকে কূটনৈতিক রীতির বরখেলাপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে এ ঘটনাকে মিয়ানমারের প্রতি চীনের পরিষ্কার সমর্থন বলেও মনে করছেন তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের নোটিশে প্রায় সব দেশের মিশন প্রধানদের ডাকা হলেও তারা বা তাদের প্রতিনিধিরা এসেছেন। তবে চীনের কোনো প্রতিনিধিকে আমরা পাইনি। গুরুত্বপূর্ণ কাজে রাষ্ট্রদূত ব্যস্ত থাকতেই পারেন, কিন্তু তিনি চাইলে কোনো প্রতিনিধি পাঠাতে পারতেন। সেটা না পাঠানোয় আমরা একটু অবাকই হয়েছি। ‘বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি নোটিশ করেছি।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্নে চায়না আমাদের বহুদিনের পরিচিত বন্ধু। তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে।
‘সেই হিসেবে চায়নার রিপ্রেজন্টিভ না আসায় আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি একেবারে অবাক হইনি। কারণ এর মাধ্যমে চায়না আমাদের দুটি ম্যাসেজ দিল। একটা ম্যাসেজ হচ্ছে আমরা এখানে যাব না। কারণ মিয়ানমার তোমাদের চেয়ে আমাদের বড় বন্ধু। বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু, কিন্তু মিয়ানমার আমাদের বিশেষ বন্ধু। তোমাদের চেয়ে সেখানে আমার বেশি স্বার্থ রয়েছে। সেখানে আমাদের বেশি সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চীন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বার্থগত কারণেই মিয়ানমার ইস্যুতে ডাকা এই মিটিংয়ে আমরা আসব না।
‘চীনের ইন্টারেস্ট মিয়ানমারে অনেক অনেক বেশি। সেটা আজ থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে। মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে তারা একটা পোর্ট বানাচ্ছে। সেটা মনে হয় শেষ হওয়ার পথে। যে রকম হাম্বানটোটা বন্দর আছে শ্রীলংকাতে, যেমন জিবুতিতে তারা একটা বন্দর বানিয়েছে, যেমন করে পাকিস্থানের গোয়াদার বন্দর তারা নিয়ে নিয়েছে, তেমনি মায়ানমারেও তারা একটা বন্দর নিয়েছে। মিয়ানমারের এই বন্দর দিয়ে চীন ভারত মাহাসাগর হয়ে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা চলে যাবে। তারা সেই স্বার্থে ছাড় দেবে না। এটা তাদের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন, স্বার্থের অংশ।’
প্রবীণ এই কূটনীতিক বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের সরকার চীনের এই স্পষ্ট মেসেজ আমলে নেবে এবং সেভাবে পরবর্তী স্টেপ নেবে। ‘দ্বিতীয় কারণও এর মধ্যে নিহিত। কারণ চীন মিয়ানমারকে পুষছে। এই পুষতে গিয়ে চীন মিয়ানমারে অনেক ইনভেস্ট করেছে। এখন ওই ইনভেস্ট চীন রক্ষা করতে চাচ্ছে।’ ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের অবকাঠামোয় চীনের যে বিনিয়োগ, তা তাদের ব্যবসা। আমরা তার পাই টু পাই ফেরত দিচ্ছি। আর এ কারণেই চীন মিয়ানমার ইস্যুতে সিরিয়াস নয়। তারা এখনও একজন রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে সহায়তা করেনি। তারা এ বিষয়ে আসলেই সিরিয়াস নয়।’
তবে বিষয়টি নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য ড. দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু বাংলাদেশ কমনলি ইনভাইট করেছে, তাই তারা নাও আসতে পারে। তবে চীনের অবস্থানটা তো আমরা জানি। চীন প্রথম থেকেই মিয়ানমারের জান্তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে।
‘বিষয়টা নিয়ে চীনের নিজেস্ব একটা অবস্থান আছে। এটা আমরা সাবাই জানি এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটোর কারণে এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রস্তাব নেয়া যাচ্ছে না।
‘ফলে আমার কাছে মনে হয়, এই আমন্ত্রণে তারা কেন আসেনি, অথবা চীনের দিক থেকে এ বিষয়ে কী বক্তব্য, সেটা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এটা নিয়ে স্পেকুলেট করাটা আমি ঠিক মনে করছি না। ১০টা মিশনকে আমন্ত্রণ জানালে একটা মিশন না আসার অনেক কারণ থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বলা যায় মিয়ানমার নিয়ে চীনের একটা অবস্থান আছে। রাশিয়ারও একই রকম অবস্থান, কিন্তু রাশিয়া ঠিকই এসেছে। এটার মধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের যে মনোভব এবং মিয়ানমারের জান্তাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক স্পষ্ট হয়েছে। সেই সম্পর্কের কারণেই তারা হয়ত আরও চিন্তাভাবনা করছে। ‘চীনের সঙ্গে আমাদের যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে জায়গা থেকে এ ঘটনাকে অন্যভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। কারণ চীন হচ্ছে আমাদের বড় ব্যবসায়িক পার্টনার। এটা মনে করার কারণ নেই যে, চীন মিয়ানমারকে সমর্থন করে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে যাবে। চীনের বিদ্যমান নীতি আমরা সবাই জানি। তারপরেও তাদের উপস্থিত থাকাটা কূটনৈতিক জায়গা থেকে প্রত্যাশিত ছিল।’