ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মনে গেঁথে দেওয়া হয় আজকের মেয়েশিশু আগামী দিনের নারী, যে কিনা জন্মেছে সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। যে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় তা হলো ক্ষমতা, চিন্তার ক্ষেত্রে সে জন্মগতভাবেই পিছিয়ে থাকবে। নানা ছলচাতুরিতে এ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া, নারী মানে দিয়েই যাবে! মেয়েশিশু ছোটবেলা থেকে পরিবার সমাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষম্য দেখে বড় হতে গিয়ে নানা নিপীড়নের শিকার হয়। আমাদের মেয়েরা এই বৈষম্য মাথায় নিয়ে বড় হয়ে সে যখন মা হয়, তখনও সমাজ তাকে তার অধিকার বুঝে নিতে দেয় না।
এই না-পাওয়া, নির্যাতন, জোর দখলের মধ্যে লড়াই চালিয়ে সেই নারী শিক্ষায়, ক্রীড়ায় সবখানে শীর্ষে পৌঁছে প্রমাণ করেছে তাকে নিয়ে সমাজে যা কিছু নেতিবাচকতা প্রচলিত ধারণা, তা অসত্য। এই বাস্তবতার মধ্যে গতকাল শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) পালিত হলো জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। সারা দেশে ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’ এই স্লোগানে দিবসটি পালন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। অধিকার কর্মীরা বলছেন, এমন দিন আনতে হবে, যখন নারীকে মানিয়ে নিতে বলার আগে তার অধিকারগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।
বাল্যবিয়ে রোধে ভাবনা আছে, কার্যকারিতা নেই: আইন অনুযায়ী, দেশে নারী-পুরুষের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ ও ২১ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। এরমধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের আগে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জরিপ বলছে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
হিসাব যাই বলুক, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূলের যে অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে সরকার, তার কোনও উদ্যোগ যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বাল্যবিবাহ রোধে অধিদফতর নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিলেও সচেতনতার অভাব ও কন্যাশিশু নিয়ে অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীনতার কারণে সেই উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর জরিপের কথা উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ বলেন, ‘করোনাকালে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে বরগুনায়Í১ হাজার ৫১২টি। এরপর কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২টি। বাল্যবিবাহ বন্ধে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি বাড়ানো, গণমাধ্যমের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বাড়াতে হবে।’
কন্যাশিশু ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয়? জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক জরিপের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সারা দেশে ১ হাজার ১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৫৫ জন। এছাড়া ২০০ প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুও এ সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬ জন। এ হিসাবে এক বছরে দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪.৪৪ শতাংশ। ২০২১ সালে মোট ১১৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জন বিশেষ শিশুও রয়েছে।
শিশু ধর্ষণের ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধ কমছে না বলে মনে করেন অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, যদি যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি করা যেতো, শিশু ধর্ষণে বাবা-মা পিছু হটবে না বিষয়টি যদি অপরাধীদের মনে ভয় হয়ে ঢুকে থাকতো, তাহলে অনেক শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পেতো। আমাদের সমাজ কবে মেয়েশিশুর জন্য নিরাপদ হবে প্রশ্নে ‘আমরাই পারি’র সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অধিকারগুলো যেদিন সে উপভোগ করতে পারবে, যেদিন তাদের সেই সুরক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারবো, সেদিন সে নিরাপদ বোধ করবে। এরপর আসে রাষ্ট্রের আইনগুলো বৈষম্যবিরোধী করা। পরিস্থিতি যত নারীবান্ধব হবে, কন্যাশিশু তত নিরাপদ হবে। একইসঙ্গে পরিবারকে কন্যাশিশুর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নাগরিক হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে সমান সুযোগ, সমান সম্মান, খাদ্য পুষ্টি, শিক্ষা নিরাপত্তা, তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এবং এটার শুরু পরিবার থেকে করতে হবে।’
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স: গবেষণা বলছে, একটি মেয়েশিশু তার পরিবারের ভেতরেই প্রথম আপত্তিকর স্পর্শ, আচরণ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু সেটি তার কোনও দোষ নয়। তাকে বোঝাতে হবে, বলতে হবে যেÍসে যদি পরিচিত বা অপরিচিত কারও দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের মুখে পড়ে, তাহলে যেন সেটা পরিবারকে জানায়। এমনকি অনেক সময় অভিভাবকরা ঢেকে রাখতে চান। তাদেরও কাউন্সিলিং দরকার। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে বলেন, ‘শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে। তাহলে সতর্কতা কোথায় দরকার, বুঝতে সমস্যা হয় না। চুপ না থেকে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে হবে।’-বাংলাট্রিবিউন