আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আমাদের জাতীয় জীবনধারার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ মহৎ ব্যক্তিত্ব। প-িতপ্রবর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার অনুসন্ধিৎসা ও নিষ্ঠার তুলনা করেছেন জার্মান প-িতদের সাথে। বস্তুত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত প্রাচীন পুঁথিসমূহ যেমন আমাদের ঐতিহ্য এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বহু নতুন উপাদানের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তেমনি সে-সব পুঁথি সম্পর্কে তার বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনা-সমালোচনা আমাদের ঐতিহ্য-চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু সাহিত্যবিশারদের এই অসাধারণ অবদান সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যথোপযুক্ত সচেতনতা ও ধারণার অভাব রয়েছে। তার প্রজ্ঞা, সাধনা ও নিষ্ঠার যে স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিল, আজো তা পরিপূর্ণভাবে হয়েছে বলে মনে হয় না।”
ওপরের কথাগুলো বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুণ-উর-রশিদের। তার এ অভিমত স্মরণ করে আমারও মনে পড়ে লালন শাহর সেই গানের কথা- ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা এক পড়শি বসত করে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বাড়ি আমাদের (লেখকের) বাড়ি হতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে পটিয়া উপজেলার সূচক্রদ-ী গ্রামে। আমার জন্ম তার মৃত্যুর তিন বছর পর। কাজেই তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু বড় হয়ে কলেজে পড়ার আগে পর্যন্তও তার সম্পর্কে এলাকায় কোনো আলাপ-আলোচনা বা সভা-সমাবেশে সূধীজনের মুখে কিছু শুনতে পাইনি, এটা ছিল আমার জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। পরবর্তী সময়ে তার জ্ঞান-প্রতিভা, অনুসন্ধিৎসা, লেখনিশক্তি, দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে যেটুকু পড়েছি, জেনেছি তাতে এই মহত ব্যক্তি সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত কিছু লেখা সম্ভব নয়। তাই তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গুণীজনদের কথা ও লেখা থেকে নিংড়ে নেওয়া কিছু তথ্য দিয়ে এ লেখাটি সাজানোর চেষ্টা করেছি।
আসলে পল্লীর মানুষ ও তার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অমরত্ব দান করতে হলে তাদের ভালবাসতে হয়, নিজের মধ্যে থাকতে হয় স্বজাত্যবোধ। জানতে হয় স্বজাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস, উপলব্ধি করতে হয় তাদের চাহিদা। সর্বোপরি সব কাজেই নিজেকে শ্রেণিনির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয় একজন সাধক পুরুষের। এমনই একজন সাধক মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। মুন্সি তার বংশগত উপাধি এবং সাহিত্যবিশারদ হচ্ছে সুধী সমাজের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া উপাধি।
জন্ম ও পারিবারিক তথ্য: আবদুল করিমের জন্ম ১৮৭১ সালে পটিয়া উপজেলার (বর্তমান পৌর এলাকা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের উত্তর পাশে) সবুজে ঘেরা সুচক্রদ-ী গ্রামের এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে।
তার বাবার নাম মুন্শী নুরউদ্দীন (১৮৩৮-৭১) এবং মায়ের নাম মিস্রীজান। তার মা ছিলেন হুলাইন গ্রামের প্রাচীন প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে। অপুত্রক মাতামহের নাম ছিল মুশাররফ আলি। বাবা মারা যাওয়ার তিন মাস পর আবদুল করিমের জন্ম হয়। ১৮৮৮ সালে ১৭ বছর বয়সে মাকেও হারান তিনি। ১৮৮২ সালে আবদুল করিমের দাদা-দাদী তাদের ছেলে আইনউদ্দীনের (আবদুল করিমের চাচা) বড় মেয়ে নয় বছর বয়স্ক বদিউননিসার সঙ্গে এগারো বছরের করিমের বিয়ে দেন। করিম ১৯২১ সাল পর্যন্ত চাচার সঙ্গে যৌথ পরিবারেই ছিলেন। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও আবদুল করিম ও তার পরিবার জীবদ্দশায় আর্থিক সংকটে পড়েন। এ বিষয়ে জীবেন্দ্রকুমার দত্তের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, “তার পিতৃব্য মুনশী আইনউদ্দীন ছিলেন রাশভারী জেদী মানুষ। তিনি জজকোর্টে নকলনবীশ ছিলেন। মধ্য বয়সে চাকুরিচ্যুতও হয়েছিলেন সেরেস্তাদারের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহারজাত অবাধ্যতার দরুণ। ওই জেদের জন্যেই মুখ্যত তিনি নানা ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলায় জড়িয়ে পড়েন এবং জমিদারি তালুক ও বহু খাস জমি হারিয়ে পরিবারকে ক্রমে দারিদ্র্য কবলিত করেন। এর ফলে যৌবনোন্মেষ-কালেই আবদুল করিমের পরিবার আর্থিক প্রাচুর্যজাত সাচ্ছল্য-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন এবং ১২৫৯ মঘী সালের তথা ১৮৯৭ সনের প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে তাদের ঘর-বাড়ি বই-পত্রসহ প্রায় সমস্ত আসবাব তৈজস বিনষ্ট হয়, এর পরেও বহু বছর ধরে মামলা মোকদ্দমার জের চলে ও আর্থিক সঙ্কট বাড়তে থাকে।’
পড়ালেখা: কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি ১৮৯৩ সালে প্রথম এন্ট্রান্স পাস করেন। তিনি ১৮৯৫ সন পর্যন্ত এ অঞ্চলের একমাত্র এফএ পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি এফএ পরীক্ষার পাঠ শেষ করতে পারেননি।
তার লেখাপড়া সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, “বাড়ির দহলিজেই (দেউরী নামে আখ্যাত) হয় আবদুল করিমের আরবী-বাঙলা-ফারসীতে হাতে খড়ি। তারপর তিনি ভর্তি হন সুচক্রদ-ী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। সেখানে একবছর পড়ে ভর্তি হন বাড়ির অদূরে অবস্থিত পটিয়া উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে। সেখানে থেকেই ১৮৯৩ সনে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেলার অর্ধাংশে প্রথম মুসলিম ইংরেজী শিক্ষিতের অসামান্য গৌরব অর্জন করেন। সম্ভবত স্কুলে মৌলবী শিক্ষকের অভাবেই আবদুল করিমকে সংস্কৃত পড়তে হয়। চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফএ পড়ার পর পরীক্ষার পূর্বে সান্নিপাত (টাইফয়েড) রোগাক্রান্ত হন, ফলে পরীক্ষা দেওয়া হল না, উচ্চ শিক্ষারও ইতি ঘটে এখানেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পিতৃব্য আইনউদ্দীনেরও ইংরেজী অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় ছিল এবং তার সব সন্তানই ইংরেজী শিক্ষিত শিক্ষক ও কেরানী ছিলেন বিভিন্ন অফিসে।”
পুঁথি সংগ্রাহক ও সাহিত্য সাধক: শিক্ষকতা করতে গিয়ে মানস চক্ষু প্রসারিত করে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের স্বকীয়তা ও স্বজাত্যবোধের অভাব উপলব্ধি করেন। এই অভাববোধই তাকে সাহিত্য সাধনায় উদ্বুদ্ধ করে। পুঁথি সাহিত্যকে আপন সন্তানের মতো ভালবাসতেন তিনি। চাকরি জীবনে অঢেল খাটুনির পর তিনি পূঁথি সংগ্রহ ও সাহিত্য সাধনায় জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন। (অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ) শুধু পুঁথি সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি। অনেক পূঁথির লেখা ছিল অস্পষ্ট, অগোছালো। সেগুলোর পাঠোদ্ধার, অর্থ নির্ণয়, টীকা লিখন এবং সম্পাদনার মাধ্যমে পাঠোপযোগী করে সংগ্রহকে পূর্ণতা দেন তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রায় আড়াই হাজার পুঁথি সংগ্রহ করেন যা আর কারো একক বা দলগত প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি। প্রায় দেড়শ প্রাচীন ও বিস্মৃত কবিকে তিনি সুধী সমাজে পরিচিত করার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেন। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় তার প্রচুর প্রবন্ধ ছাপা হতো। মুসলমানদের বাঙালিত্ববোধ জেগে ওঠার পেছনে তার রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রভাব অপরিসীম। তার কাজ ও গুণের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দূর-দূরান্তের সাহিত্য সভা-মজলিসে তার ডাক পড়তে থাকে। উল্লেখ করা দরকার, আবদুল করিমের পূঁথি সংগ্রহের আগ্রহ এবং শুরু উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে। সে সময় থেকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলেন। “আবদুল করিম গৈরলাবাসী দুই সহপাঠীকে সাপ্তাহিক ‘অনুসন্ধান’-এর গ্রাহক হতে দেখে নিজেও নবম [সেকালের দ্বিতীয়] শ্রেণীর ছাত্র থাকাকাল থেকেই নানা পত্রিকার গ্রাহক হতে থাকেন। স্কুল ছাত্র হিসেবেই তিনি উইকলি ‘হোপ’ সাপ্তাহিক ‘প্রকৃতি’ এবং আটখানা মাসিক পত্রের গ্রাহক হন। ক্রমে তিনি বিভিন্ন ধরনের চল্লিশখানি পত্রিকার গ্রাহক ও পাঠক হয়েছিলেন। দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক পত্রিকা পড়ার আগ্রহ বা নেশা তার সারা জীবন অব্যাহত ছিল।”
কর্মজীবন: জীবনের নানা বাঁকে সাহিত্যবিশারদ শিক্ষকতা, চট্টগ্রাম জজ আদালত ও স্কুল ইন্সপেক্টরের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষাসমূহের বাংলার পরীক্ষক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সূচক্রদ-ী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রায় ১০ বছর। অসুস্থতার কারণে এফএ পরীক্ষা না দিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ছাড়ার পর আবদুল করিম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সীতাকু- মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে।
ড. আহমদ শরীফ আবদুল করিমের কর্মজীবনের ফিরিস্তি দেন এভাবে: ১. চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষক- কয়েক মাস ১৮৯৫ সন। ২. সীতাকু- মধ্য ইংরেজী স্কুলে প্রধান শিক্ষক- এক বছর, ১৮৯৫-৯৬ সন। ৩. জজ আদালতে অ্যাপ্রেন্টিস [শহরে ও পটিয়ায়], ১৮৯৬-৯৭ সন। ৪. কমিশনার অফিসে ক্লার্ক-১৮৯৮ [জানুয়ারি থেকে] সন। ৫. আনোয়ারা মধ্য ইংরেজী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ১৮৯৯-১৯০৫ সন। ৬. বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর অফিসে ক্লার্ক-১৯০৬-৩৪ সন। সার্টিফিকেট অনুসারে ৫৬ বছর বয়সে [অতিরিক্ত এক বছর চাকরি করে] এবং বাস্তবে ৬৫ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তখন তিনি মাসিক বেতন পেতেন ১২০ টাকা, অবসর ভাতা পেতেন ৬০ টাকা এবং ১৯৩৯ সন থেকে সরকার প্রদত্ত সাহিত্যিক বৃত্তি পেতেন ৬০ টাকা। আমৃত্যু মাসিক আয় ছিল ১২০ টাকা।’ নিয়মিত চাকরি থেকে অবসরের পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আবদুল করিমকে প্রথমে প্রবেশিকার ও পরে বিএ-র বাঙলার পরীক্ষক নিয়োগ করেন। ১৯৪৭ সন পর্যন্ত তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ পরীক্ষার বাঙলা ভাষাসাহিত্যের পরীক্ষক ছিলেন। ১৯৫১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও বাঙলা অনার্সের একটি পত্রের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। অবসর নেওয়ার পর সাহিত্যবিশারদ গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করতেন। এলাকার লোকজনের অনুরোধে তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য হন এবং বোর্ড ও বেঞ্চের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দশ বছর (১৯৩৫-৪৫) সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পটিয়া আঞ্চলিক ঋণ সালিশী বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
এছাড়া, পরবর্তী সময়ে (মৃত্যুর আগে পর্যন্ত) পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ভূর্ষি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি: ১৯৪৭ সন পর্যন্ত সাহিত্যবিশারদ ও তার গবেষণাকর্মের বিশেষ মূল্যায়ন ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। তিনি কয়েক বছর পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, একবার সহ-সভাপতি (১৩২৬ সালে, সে বছর সভাপতি ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) ছিলেন। এর আগে তাকে পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য (ঋবষষড়)ি করে সম্মানিত করা হয় (১৯০৩)। চট্টল ধর্মম-লী তার সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯০৯ সালে ‘সাহিত্য বিশারদ’ এবং নদীয়ার সাহিত্য সভা ১৯২০ সালে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
এছাড়া, আরও যেসব সম্মান তিনি পেয়েছিলেন তার মধ্যে রয়েছে: চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি (১৯১৮)। রাউজানে কেন্দ্রীয় মুসলিম তরুণ সঙ্ঘ আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি (১৯২৯)। চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের সম্মেলনে সংবর্ধনা লাভ (১৯৩৩)। ‘পূরবী’ সাহিত্য সমিতির সংবর্ধনা (১৯৩৬)। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তৃতাদান (১৯৩৭)। কলিকাতা মুসলিম সমিতির সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি (১৯৩৯)। প্রগতি সাহিত্য সম্মেলনে সম্মানিত অতিথি (১৯৪৫)। চট্টগ্রামে নিয়াজ স্টেডিয়ামে (বর্তমানে এমএ আজিজ স্টেডিয়াম) অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর সাহিত্য সম্মেলনে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণ (১৯৫০)। চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনে মূল সভাপতি (১৯৫১)। কুমিল্লা সংস্কৃতি সম্মেলনে মূল সভাপতি (১৯৫২)।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক পদও অলংকৃত করেন। সৈয়দ এমদাদ আলি প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘নবনূর’ (১৯০৩ সনে প্রকাশিত), এয়াকুব আলি চৌধুরী প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘কোহিনূর’ (১৩০৯), মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সওগাত’ (১৯১৮), আবদুর রশিদ সিদ্দিকী প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সাধনা’ (১৩২৭) এবং ‘পূজারী’ নামের একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে তার নামাঙ্কিত হয়েই গোড়ার দিকে প্রকাশিত ও সমাজে পরিচিত হয়। আহমদ শরীফের মতে, “সাহিত্য জগতে তার খ্যাতির কারণেই পত্রিকার মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্যেই চার চারটি সাময়িক সাহিত্যপত্রের আত্মপ্রকাশকালে তাকে অবৈতনিক সম্পাদক করা হয়েছিল। বস্তুত আবদুল করিমই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পূর্বকালে ছিলেন একমাত্র মুসলিম লেখক, যিনি হিন্দু-মুসলিম সমাজে সমভাবে ছিলেন পরিচিত, স্বীকৃত, খ্যাত এবং সমাদৃত।”
সম্পাদক হিসেবে সাহিত্যবিশারদের ভূমিকা সম্পর্কে ড. আবদুল করিম তার ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ: জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থের ‘জীবন কাহিনী’ অংশে লিখেছেন, “আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সাংবাদিকও ছিলেন না, বেতনধারী সম্পাদকও ছিলেন না, তিনি সাময়িকী সম্পাদনার কাজ সাহিত্যকর্মরূপেই গ্রহণ করেন। তার সম্পাদিত সাময়িকীর একটি চট্টগ্রাম থেকে এবং অন্যগুলি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রামেই বাস করতেন, ক্বচিৎ কলিকাতায় বেড়াতে বা কোনো কার্যোপলক্ষে গেলেও তা স্বল্প সময়ের জন্য। অতএব তিনি চট্টগ্রামে বসেই সম্পাদনার কাজ করতেন। তার নিকট প্রবন্ধগুলি পাঠিয়ে দেওয়া হত, তিনি সেইগুলি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতেন, যেইগুলি প্রকাশের উপযুক্ত বিবেচিত হত না সেইগুলি বাদ দিয়ে দিতেন। পত্রিকা প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু বাকি কাজগুলো সংশ্লিষ্ট অন্যরা সমাধান করতেন।”
জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক: সাহিত্যবিশারদ খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবোধ-সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম দেখিয়ে দিয়েছেন যে বাংলা আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের ভাষা এবং আমরা বাঙালি মুসলমানদের বংশধর। তার ভাষায়, “আমার এক বিশ্বাস আছে যে, আমার দেশের মৃত্যু নাই, আমার দেশের আত্মা যে জনগণ তারও মৃত্যু নাই, তেমনই অমর আমার এই বাঙ্গালা ভাষা।” সাহিত্যবিশারদ অখ- পাকিস্তানের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না। তার যুক্তি ছিল: “কোথায় পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশ। আর কোথায় বঙ্গদেশ। মাঝখানে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধান। এত দূরবর্তী দুই অঞ্চল এক রাষ্ট্র হয় কি করে?” ‘লড়কে লেংগে পাকিস্তান’ স্লোগান শুনলে তিনি বলতেন- “বুঝেছি, পাঞ্জাবীদের বুট জুতার লাথি খাবার জন্য তোমাদের পিঠ চুলকাচ্ছে।”
আবদুল করিমই প্রথম বাঙলা ভাষাকে নির্ভীক চিত্তে উচ্চকণ্ঠে কেবল মাতৃভাষা বা স্বদেশী ভাষা নয়- মুসলিমদের জাতীয় ভাষা বলে ঘোষণা করেন, যখন অনেক মুসলমানই বাঙলা ভাষা বর্জনের জন্যে প্রচার চালাচ্ছিল। পরে পাকিস্তানে ভাষা-বিতর্কে বাঙলা ভাষার পক্ষে অন্যদের সঙ্গে বিবৃতিতে ও স্মারকলিপিতে সই দিয়েছিলেন। বাঙলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার কথাও বলেছেন, উচ্চশিক্ষার মাধ্যমও বাঙলা করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙলার দাবি জানিয়ে তিনি প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর মনের দর্পণে ছিল বাঙলার ও বাঙালীর মধ্যযুগের জীবনচিত্র, চোখের সামনে ছিল বাস্তব বর্তমান আর কল্পনায় ছিল ভবিষ্যৎ। বাঙলাদেশ, বাঙলাভাষা ও বাঙালী জাতি ছিল সারা জীবন ধরে তার অনুধ্যানের বিষয়।
স্বাধীনতাকামী: সূর্য সেনপন্থি ‘পটিয়ার ভাটিখাইনবাসী হরিপদ ভট্টাচার্য চট্টগ্রামের পুলিশ-সুপার খান বাহাদুর আহসানউল্লাহকে নিজাম পল্টনে ফুটবল খেলার মাঠে হত্যা করেন [১৯৩১ সনের ৩০ অগাস্টের বিকেলে] এবং পলায়নকালে মাঠেই ধৃত হন। এ মামলায় একজন জুরার ছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতাকামী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তিনি হরিপদকে নির্দোষ বলে মত দেন এবং একজন জুরারকে অনুনয় করে স্বমতে আনেন। ফলে সংখ্যাগুরুর মতে হরিপদ নির্দোষ সাব্যস্ত হন, তবু সংখ্যাগুরুর মত অগ্রাহ্য করে ষোল বছর বয়স্ক হরিপদকে ফাঁসির বদলে জেল দেওয়া হল। এদিকে অন্যান্য মুসলিম জুরার এবং শহরের মুসলমানরা আবদুল করিমের প্রতি ক্রুব্ধ হলেন। কয়েক মাস তাকে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়। উল্লেখ্য যে আহসানউল্লাহ হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তথা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনারের গোপন প্ররোচনায় ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মুসলিম গু-ারা হিন্দুর দোকান-পাট লুট করে। কিন্তু প্ররোচনা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধেনি।
স্বভাব ও জীবনাচার: আবদুল করিম ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে, অমায়িক, অতিথিদের প্রতি যতœশীল, শিশুদের প্রতি স্নেহশীল। কষ্টার্জিত অর্থের একাংশ গ্রামের অসহায় দারিদ্র-পীড়িত লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে এবং অসহায় রোগীদের নিজ হাতে ওষুধপত্র এনে দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। চাকর-বাকরেরা চেয়ে নিত না বলে তিনি নিজে বিড়ি কিনে গোপনে তাদের পকেটে রেখে দিতেন। চরম শত্রুকেও ক্ষমা করতে দ্বিধা করতেন না। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী না হলে অপরের চাহিদাকে নিজের চাহিদার মতো করে দেখার এমন দরদী হওয়া নিঃসন্দেহে অসম্ভব।
দু-একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক মনে করি। আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে দুইজন স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের সন্তান আজিজুর রহমান ও নিশি ঘোষ সাহিত্যবিশারদের খুবই প্রিয়ভাজন ছিল। তিনি চট্টগ্রাম শহরে ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানি হওয়ার পরেও তাদের বিদ্যালয়ের ব্যয় স্বেচ্ছায় বহন করেন এবং আজিজুর রহমানকে এন্ট্রাস পাস করিয়ে তার নিজের অফিসে কেরানি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন এবং নিশি ঘোষও তার অর্থেই বিএ পাস করে সীতাকু- উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। বৃদ্ধ বয়সেও গাঁয়ের দু’একজন গরিব ঘরের সন্তানকে পড়ালেখার জন্য অর্থ সাহায্য দেন সাহিত্যবিশারদ।
তার নিজ গ্রামের এক পুকুর ছিল করিম পরিবারের অধিকারে। গায়ের আরো দুটো পরিবারের পরোক্ষ স্বত্ত্ব ছিল সে পুকুরে। তবে তাদের দখলে ছিল না। তারা দখল পাবার জন্যে আদালতে মামলা করেন এবং আবদুল করিম নিজের স্বার্থে মিথ্যে বলবেন না- এ বিশ্বাস থেকে তাকেই সাক্ষী মানেন। উল্লেখ্য, তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই প্রতিপক্ষ মামলায় জয়ী হয়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের স্বভাব-চরিত্রের, মন-মননের, ভাব-চিন্তাকর্ম-আচরণের কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ড. আহমদ শরীফের লেখায়। যেমন, “তার (সাহিত্যবিশারদের) চাকুরে জীবনে বাসার এবং বাড়ির ব্যক্তিগত ভৃত্যকে তিনি চিরকাল সন্তানের মতো ভালোবেসেছেন এবং তার জীবনে যে-কয়জন ভৃত্য বা গৃহকর্মের লোক ছিল, প্রত্যেককেই তিনি সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করে চাষী হিসেবে কিংবা অফিসে-কারখানায়-দোকানে কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন, সব ভৃত্যকেই তিনি স্বয়ং সাক্ষর করেছিলেন। এক বালক ভৃত্যের আকস্মিক মৃত্যু হলে তিনি তার মা-বাবাকে সামান্য অর্থ সাহায্য করতেন। পরে তার বিধবা মাকে তিনি তার মৃত্যুকাল অবধি ভাত-কাপড় জুগিয়েছেন। আনসার, মুসা খাঁ, আমজু, গণি, সালামত খাঁ, গফুর, আবুলের মা প্রভৃতির নাম গাঁয়ের বৃদ্ধ লোকের এখনো স্মরণে রয়েছে।” আবদুল করিম সাধারণভাবে শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু কখনও কখনও তার এমন অভিমান, রাগ বা জেদ ছিল তা রীতিমতো চমকে উঠার মতো! এ বিষয়ে আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘“তার বাল্যের- যৌবনের বিষয় জানাবার লোক নেই এখন। কিন্তু চারটে ঘটনা আমাদের জানা আছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ইন্সপেক্টর অব স্কুলস ছিলেন তখন প্রখ্যাত লেখক শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ (মুকদুমী আহসানউল্লাহ লাইব্রেরির মালিক)। দ্বিতীয় কেরানী আবদুল করিমকে কোনো ফাইলের বিষয় নিয়ে তিনি বকাবকি করলে ক্রুদ্ধ আবদুল করিম তার গায়ের উপর ফাইল ছুঁড়ে ফেলে অফিস ছেড়ে চলে আসেন। চাকুরি যায় আর কি! তখন সহকারী ইন্সপেক্টর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ-এর অনুরোধে এ প্রখ্যাত লেখককে আহসানউল্লাহ নিজগুণে ক্ষমা করে দেন বটে, কিন্তু আবদুল করিম বেঁকে বসেন, তিনি চাকরি আর করবেনই না। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুর সাধাসাধিতে এবং আবদুল আজিজের উপদেশে অবশেষে তিনি চাকরিতে যোগ দেন এবং আহসানউল্লাহ সাহেবও পরম উদারতায় তার সঙ্গে মালিন্যমুক্ত সৎ ও সদয় ব্যবহার করতে থাকেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তার পিতৃব্য মুনশী আইনউদ্দিনও সেরেস্তাদারের সঙ্গে উদ্যত আচরণের জন্যে ১৮৮০-৮২ সনের দিকে চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন।”
“আর একবার পতœীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির ফলে প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা অন্নজল গ্রহণে বিরত থাকেন। বাড়ির লোকের সাহস হয়নি সাধাসাধি করবার, বাইরের শ্রদ্ধেয় আত্মীয়-বন্ধুর বহু অনুরোধে উপরোধে অবশেষে অন্ন গ্রহণে সম্মত হন। তার একমাত্র মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন তার ভালো-লাগা একটি ছেলের সঙ্গে, পিতৃব্যসহ পরিবারের সদস্যদের অমতে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে (১৯৩৬) সার্কেল অফিসারের সঙ্গে পটিয়া রেলস্টেশনেই তার কোনো বিষয়ে বচসা শুরু হয়। তিনি ছাতা দিয়ে অফিসারকে মারতে উদ্যত হন। ট্রেনের দর্শকদের কেউ কেউ দৈনিক পাঞ্চজন্যে এবং সাপ্তাহিক সত্যবার্তায় অফিসারকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী ও নিন্দা করে চিঠি প্রকাশ করেন। সেরেস্তাদার আবদুল ওদুদের মধ্যস্থতায় এ বিবাদ মেটে।”
“আর একবার ক্রুদ্ধ আবদুল করিমকে মূর্চ্ছিত হতে দেখা গেছে। ১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে পতœীবিয়োগের মাস তিনেক পরে এবং তার নিজের মৃত্যুর মাস তিনেক আগে কি কারণে বাড়ির উপর অভিমান করে শহরে ভ্রাতুষ্পুত্রদের কারো বাসায় কিংবা কন্যার বাড়ি না গিয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজলের বাড়িতে ওঠেন। ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাধাসাধিতেও তিনি টলেননি। অবশ্য দুদিন পরে নিজেই গাঁয়ের বাড়ি ফিরে যান।”
মৃত্যু ও প্রতিক্রিয়া: ১৯৫৩ সালের ২৫ মার্চ বুধবার সাহিত্য বিশারদের স্ত্রী বদিউন্নিসা (১৮৭৩-১৯৫৩) মারা যান। এর ছয় মাস পাঁচ দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১০টা থেকে পৌনে এগারটায় হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এই সাধক পুরুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। শেষ জীবনে তিনি চট্টগ্রামের অলিখিত ইতিহাস লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর কারণে তা শেষ করে যেতে পারেননি।
তাঁর মৃত্যু সংবাদে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সব পত্র-পত্রিকায় তার মৃত্যুর খবর ও শোকবাণী গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়।
ড. আহমদ শরীফ জানাচ্ছেন, “মৃত্যুর দুঘণ্টা পূর্বে পর্যন্ত তিনি পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুসংবাদ বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত ও পরিবেশিত হয়েছিল ঢাকার সেকালের সব ইংরেজি-বাঙলা-উর্দু দৈনিকে এবং সাপ্তাহিকে। কোলকাতার কাগজেও তার মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ আয়োজিত শোকসভায় অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী প্রমুখ বিখ্যাত বিদ্বানেরা তার গুণের ও অবদানের কথা বক্তৃতায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদও শোক সভা করে। ঢাকায়-চট্টগ্রামে এবং অন্যত্রও অনেক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে, পটিয়ার স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোও তার মৃত্যু-সংবাদে ছুটি হয়ে যায়। ‘আজাদ’ পত্রিকা ঘটা করে তার ‘চেহলাম’ উপলক্ষে সচিত্র বিশেষ বিবরণ প্রকাশিত করে।”
শেষ কথা: যতদূর জানা যায়, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ নিজের কাজের প্রচার বা মূল্যায়নের কাঙাল ছিলেন না। তিনি নিজেই বলেছেন, “এই যুগে যাঁহারা বাঙ্গালা ভাষার সেবায় বিভিন্নভাবে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে আমিই ছিলাম পাল হইতে পলাতক। আমার সহকর্মীরা কবিতা, সাহিত্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতির রচনায় মন দিয়াছিলেন। তাঁহাদের সাহিত্য সৃষ্টির মূলে বেশিরভাগই প্রেরণা দান করিয়াছিল-স্বধর্মানুরাগ। আমার সাহিত্য সাধনা ছিল তাঁহাদের সাহিত্য সাধনা হইতে একটু পৃথক। আমি ছিলাম বাঙ্গালা ভাষায় মুসলমানদের প্রাচীন অবদানের তথ্য উদঘাটনে তৎপর। প্রাচীন বাঙ্গালায় মুসলমানদের দান সম্বন্ধে আলোচনা করিতে গিয়া আমি যে সকল নূতন তথ্যের উদঘাটন করি, তাহা জাতির পক্ষে সম্মান কি অসম্মানের গৌরব কি অগৌরবের বিষয় ছিল, সে বিচার আমি করিতে চাই না।’ কিন্তু সূর্য নিজের আলো বিতরণের কৃতিত্ব নিজে প্রকাশ না করলেও সেই আলোয় আলোকিত জনেরা সূর্যের গুণের কথা প্রচার করতে দ্বিধা করেন না। শুরুতে সাহিত্যবিশারদের মূল্যায়ন সম্পর্কে প্রফেসর মোহাম্মদ হারুণ-উর-রশিদের যে উদ্বৃতি উল্লেখ করেছি, সময়ের পরিবর্তনের সাথে তারও কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। সাহিত্যবিশারদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বাংলা একাডেমির সুপরিসর মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন।’ চট্টগ্রাম শহরের লাভ লেইন এবং পটিয়ায় সড়কের নামকরণ হয়েছে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সড়ক। তার লেখা ও কর্মের মূল্যায়ন করে একাধিক গ্রন্থ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো তার মৃত্যু বা জন্মদিনে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করে। কিছু সংগঠন তাঁর স্মরণে আয়োজন করে স্মরণানুষ্ঠান। যদিও এসবে এই সাধক পুরুষের সামগ্রিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
এ লেখা শেষ করবো তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের একটি বক্তব্য দিয়ে- সত্যই কি সব শেষ হয়ে গেল? মাস্টার আবদুল করিম মারা গেছেন, কেরানী আবদুল করিম দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু সাহিত্যবিশারদ মরেননি। তিনি মরতে পারেন না, কারণৃ চিত্ত, বিত্ত, জীবন এবং যৌবন এ সমস্তই চঞ্চল, কিন্তু কীর্তিমান ব্যক্তি চিরজীবী। কীর্তিমান সাহিত্যবিশারদ আজও জীবিত।
তথ্যসূত্র: ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’, আহমদ শরীফ; ‘আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ: জীবন ও কর্ম’, ড. আবদুল করিম; ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত স্মরণসভায় পঠিত উদ্ধৃতি: সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদ প্রকাশিত ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’, সঞ্জীবপ্রসাদ সেনের পত্র ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ২৮ অগাস্ট, ১৯৮১। লেখক: মুহাম্মদ শামসুল হক, সম্পাদক ইতিহাসের খসড়া, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী