দুনিয়ায় মানুষের প্রতি কাজ হবে মহান আল্লাহ তাআলার জন্য। অথচ মানুষ দুনিয়ার কাজে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। যা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ এতে পরকালের কাক্সিক্ষত সাফল্য থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ। মানুষের দ্বীনদারী কিংবা ধর্মকর্ম পালন যেন দুনিয়ার সুবিধা লাভের হাতিয়ার হয়ে না যায়। কেননা আল্লাহ তাআলা মানুষকে শুধু তার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি জ্বীন ও মানুষকে আমার ইবাদত ব্যতিত অন্য কোনো কিছুর জন্য সৃষ্টি করিনি।’ (সুরা জারিয়াত : আয়াত ৫৬)
সম্প্রতি সময়ে এমন অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা যায় যে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ দ্বীন তথা ধর্মকে পূজি করেন। ধর্মের দোহাই দেন। বাস্তবে দ্বীন তথা ধর্মকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করা একেবারেই অনুচিত। কেননা মানুষের প্রতিটি কাজ হবে আল্লাহর জন্য। তবে এসব কাজ করতে ধর্ম বা দ্বীনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। আল্লাহ তাআলা এ দিকে ইঙ্গিত করে বলেন- ‘আর হে আমার জাতি! আমি তো এজন্য তোমাদের কাছে কোনো অর্থ চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর জিম্মায় রয়েছে।’ (সুরা হুদ : আয়াত ২৯)
দুনিয়ার সব কাজ শুধু আল্লাহর জন্য করতে যুগে যুগে গত হয়ে যাওয়া ইসলামিক স্কলারদের জীবনের কিছু ঘটনা হতে মুমিন মুসলমানের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। তবেই কুরআনুল কারিমের নির্দেশনা বা এর হক আদায় হবে।
ইলমে হাদিসের বিখ্যাত স্কলার ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইর বর্ণনায় ‘সব কাজ হবে মহান আল্লাহর জন্য’- এ মর্মে কিছু ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলো-
– বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার এক ব্যক্তির কোনো এক প্রয়োজনে সে সময়ের শাসকের সঙ্গে কথা বলেন আর শাসকও তা সমাধান করে দেন। তিনি যখন ঘরে ফিরলেন, তখন দেখলেন তার জন্য কেউ একটি হাঁস ও একটি মুরগী পাঠিয়েছেন। তিনি ঘরের লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন- (এটি কোথায় থেকে এসেছে?) তারা (ঘরের লোকজন) ওই ব্যক্তির নাম বলল, যার প্রয়োজন নিয়ে তিনি শাসকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহাবি হজরত আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এগুলো (ঘর থেকে) বের করে দাও। আমি কি আমার সুপারিশের বিনিময় দুনিয়াতেই নিয়ে নেব!
– এক ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন হয়ে এমন হালতের সঙ্গে পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ করছেন। যেন আল্লাহ তাআলা তাকে দেখছেন। তাওয়াফের এ দৃশ্যটি এক ব্যক্তি দেখলেন। ওই ব্যক্তি তাওয়াফকারীকে অনুসরণ করতে লাগলেন। তাওয়াফ শেষ হলে অনুসরণকারী ব্যক্তি এক থলে দিরহাম হাদিয়া স্বরূপ তাওয়াফকারীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন- আপনি এত সুন্দর তাওয়াফ করেছেন, এগুলো (ব্যাগ ভর্তি দিরহাম) আপনার জন্য হাদিয়া।
তাওয়াফকারী দিরহামের থলেটি হাতে নিয়ে সজোড়ে ছুঁড়ে মারলেন। ফলে দিরহাম ভর্তি ব্যাগটি ছিঁড়ে যায় আর দিরহামগুলো মাটিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাওয়াফকারী দিরহামের ব্যাগ ছুঁড়ে মেরে ওই ব্যক্তিকে বললেন- আমি কি আমার তাওয়াফ বিক্রি করে দেব? অর্থাৎ তাওয়াফ অনেক সুন্দর হয়েছে এজন্য হাদয়িা। এটি তিনি গ্রহণ করেনি। কারণ তিনি তাওয়াফ করেছেন শুধু মহান আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্টির জন্য। হাদিয়া পাওয়ার জন্য নয়।
– শাম দেশের বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রিজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ইলমের জগতে এক বিখ্যাত পÐিত ও ইবাদতগুজার ব্যক্তি। তার একটি ঘটনাও অনুসরণ যোগ্য- তিনি একবার কাপড় কিনতে এক দোকানে যান। তিনি দোকানে গেলে এক ব্যক্তি কাপড় ব্যবসায়ীকে বলল- হে ভাই! ইনি ইবনে মুহায়রিজ; তাঁর সঙ্গে সুন্দরভাবে বেচা-কেনা কর। অর্থাৎ দামে ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিও। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রিজ এ কথা শুনেই রাগান্বিত হয়ে গেলেন আর দ্রæত দোকান ত্যাগ করতে করতে বললেন-‘আমি তো আমার দিরহাম দিয়েই কাপড় কিনতে এসেছি, দ্বীন বা ধর্ম দিয়ে নয়।’ (কিতাবলুল যুহদ : আহমাদ ইবনে হাম্বল)
উল্লেখ্য বিভিন্ন সময় বাজার-ঘাটে ধর্মীয় পোশাকধারী ও লেবাস ব্যবহকারী ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান রেখে অনেক ব্যবসায়ী দ্রব্য-সামগ্রীর স্বাভাবিক দাম থেকেও কিছু ছাড় দেন। তা কম হোক আর বেশি হোক। যা অন্যদের তুলনায় অনেক সময় করা হয় না। একটু চিন্তা করলে বুঝা যায়, কতভাবে মানুষ দ্বীন বা ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগায় কিংবা দ্বীন বা ধর্মের কারণে কত সুবিধা ভোগ করে। অথচ পরকালেই এসব সুবিধাগুলোর বেশি প্রয়োজন।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বুঝা উচিত, দুনিয়ার কোনো কাজে কোনো আমল-ইবাদতের বিনিময় না করাই উত্তম। দ্বীন বা ধর্মের দোহাই দিয়ে দুনিয়ার সুবিধা নেয়া থেকে বিরত থাকা খুবই জরুরি।
মনে রাখতে হবে: পরকালের প্রস্তুতিতে দুনিয়ার প্রতি কাজই হবে শুধু আল্লাহর জন্য। কেননা দুনিয়া হলো আখেরাতের শষ্যক্ষেত্র। তা যেন দুনিয়া প্রাপ্তি ব্যবহার না হয়। আখেরাতের কাজ দিয়ে মূল্যহীন দুনিয়া অর্জনের পথ বিরত থাকাই ঈমানদারের একান্ত কাজ।
আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সব মানুষকে প্রতিটি কাজ মহান আল্লাহর জন্য করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় কাজও আল্লাহর উদ্দেশ্যে করলে তা পরকালের জন্য হবে নাজাতের উসিলা। আমিন।