কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবারো বাংলাদেশ সীমান্তে যুদ্ধবিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যাপকভাবে গুলি ও বোমাবর্ষণ শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন : কক্সবাজার অফিস জানায়, টেকনাফের নাফ নদীর এপারের উংচিপ্রাং, উলুবনিয়া, খারাংগা ঘুনা ও বালুখালী সীমান্তের বিপরীতে মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটার দূরত্বে মিয়ানমারের মংডু অ লের নাইচাদং ও কুমিরখালী সামরিক বাহিনীর ব্যাটালিয়ন ঘাঁটি। প্রায় দেড় মাস ধরে এটি স্বাধীনতাকামী আরকান আর্মির দখলে। আজ সোমবার ভোর রাত ৩টা থেকে ওই এলাকাটি সেনাবাহিনী পুনরায় দখলে নিতে চাইলে তুমুল লড়াই শুরু হয়। লড়াইয়ের ব্যবহৃত হচ্ছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র। সেখানকার গুলি আর গোলার বিকট শব্দ আর গোলাবারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ায় আতঙ্কে কাঁপছে এপারের বাসিন্দারা।
মিয়ানমারের নাইচাদং ও কুমীরখালী সীমান্তে সারারাত থেমে থেমে গুলি ও মর্টারশেলের আওয়াজে কেঁপে উঠছে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, খারাংগা ঘুনা, বালুখালী সহ টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং সীমান্তের জনপদ। গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ৬টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত পরপর ১৫-২০টি মর্টারশেলে বিকট শব্দে হোয়াইক্যং, লম্বাবিল উনছিপ্রাং কেঁপে উঠে। সীমান্তের সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী মিয়ানমারের নাইচাদং ও কুমিরখালী দুটি ঘাঁটিতে মিয়ানমারের জান্তা ও বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ হয়েছে। হোয়াইক্যং দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোস্তফা চৌধুরী লালু ভোরে ফোন দিয়ে জানান, মিয়ানমারের ভিতরে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজে ভয়ে এলাকার মানুষ অনেক আতঙ্কিত। যেন আমার বাড়ির সামনেই বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে। বিকট আওয়াজে ঘুমের শিশুরাও জেগে উঠেছে।
সীমান্তে কর্তব্যরত উনছিপ্রাং বিজিবির কোম্পানি কমান্ডারের ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বিকট শব্দ শুনেছেন বলে জানান। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই বলেও জানান তিনি। জানান, তারাও সীমান্তে কঠোরভাবে প্রহরারত আছেন। কয়েক দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেট ফাইটার ও একাধিক হেলিকপ্টারের তৎপরতা বেড়েছে। হেলিকপ্টার থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে ছোড়া হচ্ছে অসংখ্য গুলি ও বোমা। তাতে পাহাড়ের বনা ল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ওপারে (মিয়ানমার) একাধিক হেলিকপ্টার, জেট ফাইটারের দৌড়ঝাঁপ, গুলিবর্ষণের দৃশ্য দেখা যায় এপার থেকে।
এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গতকাল সোমবার ভোররাত থেকে ওপারে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সাথে চলছে আর্টিলারি, মর্টার গোলাসহ ভারী অস্ত্রের ব্যবহার। বেলা ২টা পর্যন্ত অন্তত চার দফায় তিনটি হেলিকপ্টার থেকে কয়েক শ’ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। জেট ফাইটারের চক্করও লক্ষ্য করেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। আতঙ্কে সীমান্ত এলাকার মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। সীমান্তের দিকে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী। তিনি বলেন, দু’দিন বন্ধ থাকার পর আজ সোমবার ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই যুদ্ধ চলেছে। যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
এদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। সোমবার (১০ অক্টোবর) সকাল থেকে তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শুরু করেন বলে জানান বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মেহেদী হোসাইন কবির।
বিজিবি জানিয়েছে, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সীমান্ত পরিস্থিতি পরিদর্শন করছেন বিজিবির মহাপরিচালক। লে. কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির বলেন, সোমবার সকালে বিশেষ হেলিকপ্টারে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ কক্সবাজার পৌঁছান। এরপর সকাল ১০টা থেকে ঘুমধুমের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শুরু করেন। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিজিবির মহাপরিচালক সীমান্ত পরিস্থিতি পরিদর্শন করছেন। পরিদর্শনের সময় বিজিবির সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে তিনি কথা বলেন।
এদিকে, বান্দরবান থেকে জানা গেছে, কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবারো বান্দরবান সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। আজ সোমবার ভোর থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যাপকভাবে গুলি ও বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। বোমাবার্ষণে কেঁপে উঠছে পুরো এলাকা। এতে সীমান্তে বসবাসকারী লোকজনদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিজিবি সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৪টা থেকে তুমব্রু সীমান্তের ৩৪ নম্বর পিলালের কাছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিপির রাইট ক্যাম্প থেকে গোলান্দাজ বাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। এছাড়া যুদ্ধবিমান থেকেও সীমান্তে ব্যাপক গুলি ও বোমাবর্ষণ করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ ঘটনার পর সীমান্তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিরাপত্তা জোরদার করেছে। বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, হঠাৎ করে বোমা ও গুলিবর্ষণে সীমান্ত এলাকার লোকজন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ দুই মাস ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির সাথে সে দেশের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী ও বিজিপির ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। এ ঘটনায় বান্দরবান সীমান্তের জিরো লাইনের রোহিঙ্গা শিবিরের এক রোহিঙ্গা নিহত ও ছয়জন আহত হয়। এছাড়া সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে।