‘একটা ঘর নদীত গ্যাছে, আরেকটা কিনারে দাঁড়ায় আছে। যেকোনো সময় হেইটাও যাইবো। ঘর সরায় যেইহানে যামু হেই জমিতেও পানি। কই যামু, যাওনের জায়গা তো নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ভিটেবাড়ি হারাতে বসা দিনমজুর আলহাজ্ব। বাড়ির আঙিনা ও ঘর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে তার। পাশের ঘরে বাস করছেন আলহাজ্ব ও তার পরিবার। অন্যত্র ঘর সরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। আলহাজ্বের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ফকিরের চর গ্রামে। ওই গ্রামের লিয়াকত আলীর ছেলে তিনি।
আলহাজ্ব জানান, গত এক মাসে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ফকিরের চরের অন্তত ৩০-৩৫টি পরিবার ভিটেমাটি ও আবাদি জমিসহ সর্বস্ব হারিয়েছে। এখনও ভাঙনের হুমকিতে তার গ্রামের ৩০-৪০টি পরিবার।
ভাঙনের তীব্রতার মাত্রা বোঝাতে গিয়ে অসহায় এই দিনমজুর বলেন, ‘যে ভাঙনি (ভাঙন) ধরে, কোনও বুদ্ধি পাওয়া যায় না।’
গত এক সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়েছে। পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভাঙন। অব্যাহত ভাঙনে আবাদি জমি আর বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে একের পর এক পরিবার। অনেকে মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁইটুকুও হারিয়েছেন। ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের আঘাতে পাড় ভেঙে পানিতে পড়ার শব্দ আর মানুষের আহাজারিতে একাকার হয়ে উঠেছে ওই এলাকা। কিন্তু প্রতিকারে নেই কোনও উদ্যোগ। ভাঙনকে ‘নিজেদের নিয়তি’ ভেবে এলাকা ছাড়ছে একের পর এক পরিবার। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে এমন চিত্র এখন সচরাচর। একই ইউনিয়নের কড্ডার মোড়ের দক্ষিণে মসুল্লিপাড়া গ্রাম। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে নাকাল এই গ্রামের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছাড়ছেন। কেউ অন্য কোনও চরে আবার কেউ জেলা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। প্রতিদিন একটু একটু করে নদের গর্ভে যাচ্ছে গ্রামটি।
গ্রামের দিনমজুর নায়েব আলী। এক টুকরো জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল তার। ব্রহ্মপুত্র সেখানেও তাকে স্থায়ী হতে দেয়নি। রবিবার (১৬ অক্টোবর) পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন চিলমারীর হকের চরে। নায়েব আলীর মতো এমন ভুক্তভোগী পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
গত কয়েকদিনে ওই গ্রামের আরিফ মন্ডল, লতিফ, ছোবহান, আজগার ও ফরিদসহ অনেকে ভিটেমাটি হারিয়েছেন। নদের গর্ভে চলে গেছে আবাদি জমি ও মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
মসুল্লিপাড়ার বাসিন্দা রাজ্জাক মোল্লা বলেন, ‘আমার বাড়ির আঙিনা নদের গর্ভে চলে গেছে। যেকোনো সময় পুরো ভিটা হারাতে পারি। হুমকিতে আছে গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার। আরও দক্ষিণে শতাধিক পরিবার ভাঙনের কবলে।’
ভাঙন প্রতিরোধে দায়িত্বশীলদের উদ্যোগ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করে রাজ্জাক মোল্লা বলেন, ‘কী আর বলবো। আমরা সবচেয়ে অসহায়। কেউ আমাদের দিকে দেখে না। মানববন্ধন করেও কোনও ফল পাচ্ছি না। কয়েকটা জিওব্যাগ ফেললেও বসতিগুলো রক্ষা হইতো। কিন্তু কেউ কোনও ব্যবস্থা নেয় না।’
রাজ্জাক মোল্লা বলেন, ‘গত এক বছরে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। জেলাও ছেড়েছেন অনেকে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বালাডোবা থেকে শুরু করে পুরান মোল্লারহাট হয়ে যেখানে প্রায় দুই হাজার ৪০০ ভোটার ছিল সেখানে এখন ছয় শতাধিক। তাহলে কত লোক এলাকা ছেড়েছে অনুমান করেন।’ ৬ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটাই এখন ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বলে জানান তিনি।
‘জন্মস্থান ছেড়ে দিনাজপুর, বদরগঞ্জ এলাকায় চলে গিয়ে সেখানে কাউকে ধরে সরকারি জায়গা ভাড়া নিয়া থাকতেছে। ভ্যানগাড়ি বা রিকশা চালায় জীবিকা চালাচ্ছে। জায়গা কিনবে এমন টাকাতো নাই।’ ভাঙনে স্থানান্তরিত দুর্গতদের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে বলেন রাজ্জাক মোল্লা।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে দুই কিলোমিটার এলাকার বসতবাড়ি ও আবাদি জমি নদের গর্ভে চলে গেছে। চলতি বছর ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ভাঙনের কারণে এলাকায় অভাব বেড়েছে। কিন্তু প্রতিকারে কোনও ব্যবস্থা নেই।’ ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে এলাকা সংকীর্ণ হয়ে একের পর এক বাসিন্দা বাস্তুহারা হলেও নির্বিকার স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বসতি রক্ষায় কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। ভাঙনকবলিত এলাকা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বেগমগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন প্রতিরোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত প্রকল্পভুক্ত এলাকায় কাজ করি। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনও স্থাপনা ভাঙনের হুমকিতে থাকলে সেটি রক্ষায় কাজ করে থাকি। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।’