শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৬ পূর্বাহ্ন

তবে কী বন্ধ হতে চলেছে চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্প?

অঞ্জন রায় চৌধুরী :
  • আপডেট সময় রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ নিয়ে ব্যস্ত সেই মূহুর্তে হঠাৎ করেই বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচনায় উঠে এসেছে চীনের সাংহাই ডকইয়ার্ডে পিএলএ নেভির সর্বশেষ টাইপ ০৭৫ ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডকের (এলএইচডি) জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা। ধীরে ধীরে সামনে এসেছে চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্প নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা।
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল সকালে পিএলএ নেভির এলএইচডি’তে আগুন ধরে যায়। সেখানে দেখা যায় দ্বীপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে আগুন জ্বলছে। পরবর্তীতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে কিছু জানায়নি ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ১০ দিন পরেই সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজগুলোকে নতুন করে রং লাগিয়ে প্রস্তুত করা হয় ‘পিএলএ নেভি’র ০৭৫ ধরণের অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে যেভাবে আগুন লেগেছিলো তাতে জাহাজের দারুণ ক্ষতি হবার কথা। শুধু রং লাগিয়ে আগুনের চিহ্নগুলো ঢাকলেও জাহাজ সঠিকভাবে মেরামত করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। এই আগুনে জাহাজের পুড়ে যাওয়া ইলেকট্রিক তার বা অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন যন্ত্র পরিবর্তন করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে এই জাহাজটি প্রস্তুত না করার কারণে চীনের জাহাজ শিল্পে সঠিকভাবে সকল মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্প: ১৯৯০ সালে ছোট পরিসরে শুরু হওয়া চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্প আজ বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ যেন বিশ্ব জুড়ে চীনের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম এক প্রতিচ্ছবি। এই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মাধ্যমেই সাধারণ অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সক্ষম হয়ে উঠেছে চীন। বিশ্বে জাহাজ শিল্পে নেতৃত্ব দেয়া চীন সাধারণ বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সময় নেয়, তা নিশ্চিতভাবে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
এত অল্প সময়ে জাহাজ নির্মাণে চীনের এই পন্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করে আসছে বিগত বছরগুলোতে। অবশ্য সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে চীন। সেখানে নিম্ন মানের পণ্য ব্যবহার বা দ্রুত সময়ে কাজ করতে গিয়ে জাহাজের গুণগত মান কমে আসা নিয়ে যত আলোচনা করা হয়েছে তাকে এক বাক্যে অস্বীকার করেছে দেশটির সরকার। যাই হোক না কেনো, সাংহাই ডক ইয়ার্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশটির সরকার, প্রতিরক্ষা বিভাগ বা জাহাজ নির্মাণ শিল্পের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ কোন প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়নি। আর সেই তথ্য প্রকাশ না করায়, বিশ্ব বাজারে তাদের জাহাজ নিয়ে চলতে থাকা এই নেতিবাচক আলোচনাগুলো আরো দৃঢ়ভাবে স্থান করে নিচ্ছে।
চীনের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য: স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর ভাষ্যমতে, ২০০৮ সালে চীনের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ছিলো ৬৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.০৪ বিলিয়ন ডলারে। এর শতকরা ৭৫ ভাগ বিক্রি হয়েছে এশিয়ার দেশগুলোর কাছে। আফ্রিকায় বিক্রি হয়েছে ২০ ভাগ। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রফতানিকৃত প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মূল্য ৬ হাজার ৪২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীনের এই প্রতিরক্ষা ৫০ ভাগই বিক্রি হয় পাকিস্তানের কাছে! চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ভিত্তি ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝতে এই তথ্যগুলো সহায়তা করবে।
পাকিস্তান: পাকিস্তান ‘প্রজেক্ট হ্যাংগার’-এর মাধ্যমে আটটি ইয়ুন ক্লাসের সাবমেরিন গ্রহণ করছে চীনের কাছ থেকে। এর মধ্যে প্রথম চারটি সাবমেরিন নির্মাণ করা হচ্ছে চীনের সিএসওসি-তে। বাকিগুলো পাকিস্তানে অ্যাসাম্বল করা হবে। মজার বিষয় হলো, এই সাবমেরিনে ব্যবহৃত ইঞ্জিন ‘১৬ভি৩৯৬এসই৮৪’ তৈরি করে জার্মানির এমটিইউ। ২০০২ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় চীনের এনওআরআইএনসিও। চুক্তি অনুসারে চীনের প্রতিষ্ঠানটি শুধু নিজেদের দেশের জন্য সাবমেরিনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ইঞ্জিন নির্মাণের অনুমতি পায় (চীনের মান অনুসারে)। কিন্তু পাকিস্তানকে দেয়া এই সাবমেরিন ইঞ্জিনগুলো তৈরি করছে এনওআরআইএনসিও। আর সে কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের এই বাণিজ্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জার্মানি এবং এটি চুক্তি লঙ্ঘন বলে স্পষ্ট করে জানিয়েছে তারা। এ ঘটনার পর পাকিস্তান জার্মানকে সস্তায় এই ইঞ্জিন ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে। অবশ্য এ বিষয়ে শেষমেশ কী হয়েছে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। কিন্তু পাকিস্তানে জার্মানের ইঞ্জিনের এই ব্যবহার স্পষ্টতই ‘ওয়াসেনার অ্যারেঞ্জমেন্ট’ ভঙ্গ করার শামিল।
চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে দুর্দান্ত সম্পর্ক বিদ্যমান। আর দুই দেশই তাদের সমস্যাগুলো ভাগ করে নেয়। পাকিস্তানকে দেয়া চীনের এফ২২পি জাহাজ তার আরেকটি উদাহরণ। যা মাঝে মধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সমস্যার সৃষ্টি করে।
শ্রীলঙ্কা: চীন ২০১৯ সালের জুন মাসে শ্রীলঙ্কাকে পিএলএ নেভি যুদ্ধ জাহাজ উপহার হিসেবে দেয়। ২৩০০ টনের এই ক্লাস ওয়ান যুদ্ধ জাহাজ চীন থেকে রওনা দিয়ে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর আগেই ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে তা আবারো জরুরি মেরামতের জন্য ইয়ার্ডে ফেরত পাঠানো হয়।
কোভিড-১৯ মহামারী: চীনের শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে শুধুমাত্র চলতি বছরের অর্ধেক সময়ে দেশটির জাহাজ নির্মাণ শিল্প গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৬ ভাগ কম আয় করেছে।
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়েও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের এই ব্যবসায় ধস নামার সম্ভাবনা প্রকট। কেননা বর্তমানে তাদের কোন গ্রাহক চীনে ভ্রমণে আগ্রহী নয়। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ চীনের নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ব্যবসার আলোচনার সুযোগও কমে যাচ্ছে। নতুন সিএসআইসি প্রতিবেদন অনুসারে চীন জাহাজ নির্মাণ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। চীনের আকাশ থেকে ধোঁয়া বিদায় নেয়ার পরেই মূলত চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন বিষয়গুলো সামনে আসা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে মান নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে দেশটির জাহাজ নির্মাণ শিল্প। উৎস: দৈনিক ইত্তেফাক অন লাইন,লেখক: নয়াদিল্লী প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com