মীর মশাররফ হােসেন (১৮৪৭-১৯১২)[Mir Mosarraf Hosain] তৎকালীন নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া মহকুমার (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম জেলা) গৌরী নদীর তীরবর্তী সাঁওতার নিকটবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মােয়াজ্জেম হােসেন, মাতা দৌলতুন্নেসা। মােয়াজ্জেম হােসেন ছিলেন সে অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু একজন জোতদার এবং সম্মানীয় ব্যক্তি। মীর উপাধি তারা পেয়েছিলেন রাজার প্রদত্ত খেতাবরূপে। কিন্তু সৈয়দ ছিল বংশানুক্রমিক উপাধি, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাহিত্য সাধক’ রচনার দ্বিতীয় খ-ে মীর মশাররফ হােসেনের জন্মতারিখ বলেছেন ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সাল। লেখক নিজে ‘আমার জীবনী’ গ্রন্থে বলেছেন ১৮৪৩ সালে তাঁর জন্ম হয়। গ্রামের বাড়িতে মুন্সি জমিরুদ্দিনের হাতে মশাররফের শিক্ষার হাতেখড়ি। মুনশী সাহেবের কাছে এক বছর কোরান শিক্ষার পর স্থানীয় জগমােহন নন্দীর পাঠশালাতে ভর্তি হন তিনি। শৈশবে তিনি ছিলেন স্থির ও শান্ত প্রকৃতির। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কুষ্টিয়ার নবাব মীর মােহাম্মদ আলি প্রতিষ্ঠিত নবাব হাইস্কুলে তঁকে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন পর অনিবার্য কারণে তাকে স্কুল ত্যাগ করতে হয়। তারপর পদমদীর নবাব উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। উচ্চ শ্রেণিতে তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাঁর সে সময় হতেই। জীবনের বেশিরভাগ সময়ে মশাররফ হােসেন [Mir Mosarraf Hosain] দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। তার পূর্বে উনবিংশ শতকে উল্লেখযােগ্য তেমন কোনাে মুসলমান লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় না। মুনশী শেখ আজিমউদ্দীন, শামসুদ্দীন মােহাম্মদ সিদ্দিকী, মুনশী নামদার, করিমুন্নেসা খানম, গােলাম হােসেন প্রমুখ মীর মশাররফ হােসেনের পূর্বে যেসব মুসলিম কবি-সাহিত্যিকের পরিচয় পাওয়া যায়, তারা নামমাত্র এবং পুঁথি-রচযতিা শ্রেণির লেখক ছিলেন। তাই মীর মশাররফ হােসেনের [Mir Mosarraf Hosain] মতো উঁচুমানের শক্তিশালী মুসলিম লেখকের আবির্ভাব ছিল যেমন আকস্মিক তেমনি বিস্ময়কর। তিনি সর্বমােট প্রায় ৫০টির মত গ্রন্থ (অপ্রকাশিতসহ) রচনা করেন। তাঁর সৃষ্টি-বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। একাধারে তিনি উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান, প্রহসন, প্রবন্ধ, আত্মজৈবনিক রচনা, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি লিখেছেন। তার এসব রচনায় যেমন রয়েছে ধর্মাভাব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-চেতনা, তেমনি রয়েছে সাময?িক প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক বিষয়, সাম্প্রদায?িক সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়। এত অসংখ্য বিষয়, ভাব ও অনুভূতি মশাররফ হােসেন তার বিশাল সাহিত্যে এক অসাধারণ নৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন। এর দ্বারা তাঁর প্রতিভার বহুমাত্রিকতা ও বর্ণিল পারঙ্গমতার বিষয়ই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মশাররফের জ্ঞানার্জনের আগ্রহও বই পড়ার ঝোঁক ছিল উল্লেখ করার মতাে। মাঝেমধ্যে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকেও বই পড়ে শােনাতেন। মশাররফ হােসেন মােটামুটিভাবে সব ধরণের বই পড়তেন। উপন্যাস, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ, ইতিহাস, আইন, ধর্ম তার পাঠ্য তালিকায় ছিল। তাঁর উল্লেখযােগ্য সংগ্রহের মধ্যে ছিল কোরআন শরীফ, শাহনামা, চাহার দরবেশ, কাসাসুল আম্বিয়া, রামায়ণ, মহাভারত, বিদ্যাসুন্দর, দশরথী রায়ের পাঁচালি, ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলি, দীনবন্ধু মিত্রের গ্রন্থাবলি, গিরিশ গ্রন্থাবলি, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য ও বীরাঙ্গনা কাব্য, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতােম প্যাঁচার নক্শা, কাঙাল হরিনাথের ব্রহ্মা-বেদ, ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী, হরিনাথ গ্রন্থাবলি, অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, শেখ আব্দুর রহিমের হযরত মুহম্মদের (সঃ) জীবনচরিত, ভাই গিরিশচন্দ্র ঘােষের সিরাজদৌল্লা, গিরিশচন্দ্র সেনের তাপসমালা, বড়পীর সাহেবের জীবনী ইত্যাদি। মশাররফ হোসেন [Mir Mosarraf Hosain] অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনায় লালিত ছিলেন। মুক্তবুদ্ধির প্রেরণা তাঁর লেখক সত্তাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছে। ধর্মনিষ্ঠ ও স্বজাতিবৎসল হয়েও তিনি ভিন্ন ধর্ম বা জাতির প্রতি বিরূপ মনােভাব পােষণ করেননি। তাঁর রচনায় জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে এমন কিছু উপাদানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যেগুলাের ভিতর দিয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতার পরিচয় ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে মশাররফ হােসেনের ব্যবহৃত ভাষার প্রসঙ্গকে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়ােজন। তিনি তাঁর ভাষায় প্রচুর পরিমাণ তৎসম শব্দের ব্যবহার করেছিলেন। লেখকের এ প্রবণতার ব্যাপক পরিচয় মেলে তাঁর সুবিখ্যাত রচনা ‘বিষাদসিন্ধু’-তে (১৮৮৪) এখানে তিনি অনেক ধর্মীয় প্রসঙ্গকে সংস্কৃত শব্দে উপস্থাপন করেনÍঅনেক সময়ে যা বহুল প্রচলিত আরবি শব্দকেও প্রতিস্থাপিত করে। মশাররফ হোসেনের [Mir Mosarraf Hosain] আত্মজীবনীমূলক রচনার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে হিন্দু সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রভাবচিহ্ন বর্তমান। পরবর্তী জীবনে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করলেও, কৃষ্ণনগরে তার ছাত্রজীবন হিন্দুদের দ্বারা খুব বেশি মাত্রায় প্রভাবিত হয়েছিলÍযে প্রভাব তার জীবনে ও সাহিত্যে আজীবন বর্তমান ছিল। ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম জীবনী’ (১৯১০) গ্রন্থে মশাররফ হােসেন কুষ্টিয়া অঞ্চলেও হিন্দু প্রভাবিত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন। কৃষ্ণনগরের মতাে এখানকার মুসলমানগণও নাম ব্যবহারে যথেষ্ট হিন্দুয়ানি ভাবধারাসম্পন্ন ছিলেন। যুক্তির খাতিরে এ জাতীয় হিন্দুয়ানিকে ‘আমার জীবনী’ (১৯০৮) গ্রন্থে তিনি কৃষ্ণনগরের দোষ হিসেবে বর্ণনা করলেও প্রকৃতপক্ষে উক্ত হিন্দুপ্রভাব যে সমকালীন নদীয়া জেলার সর্বত্রই কমবেশি ছিল ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম জীবনী’তেই তিনি তা স্বীকার করেন। মশাররফ হােসেন ১৯১০ সালে যখন তার প্রিয়তমা স্ত্রী কুলসুমের জীবনী রচনা করেছিলেন তখনও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, “মুসলমানের নাম লালন, মন্দির, নদীয়া জেলায় আশ্চর্য্য নহে। নদীয়া কুষ্টীয়া অঞ্চলে কৃষক অথবা বিশ্বাস ম-ল শ্রেণীর লােকমধ্যে অনেক হিন্দুনাম আজ পর্যন্ত প্রচলিত আছে।”
দৃষ্টান্ত হিসেবে মশাররফ হােসেন উল্লেখ করেন, সতীশ নামের জজ-অফিসের একজন কেরানি এবং মদন নামের একজন সাবরেজিষ্টারের নাম। এদের মুসলমান নাম ছিল যথাক্রমে সামসুদ্দীন ও মখদুম। তিনি সে সময়ে কৃষ্ণনগর ও কুষ্টয়া অঞ্চলে অনেক মুসলমানের নন্দ, গৌর, কালাচাঁদ, হরে, লক্ষণ প্রভৃতি নাম বর্তমান ছিল বলে উল্লেখ করেন। মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে মুসলমানের নাম ব্যবহারের হিন্দুয়ানিও তার চোখে পড়ে। এখানকার মুসলমানগণ হিন্দুদের অবতার রাম-শ্যামের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদের নাম রাখতেন। তেমন, ঝাউদিয়ার চৌধুরী বাড়ির প্রধান কার্যকারের নাম ছিল শ্যাম কাজী। এসময়ে কুষ্টিয়া কৃষ্ণনগর-মেহেরপুর অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই আত্মীয় স্বজনকে মাসি, পিসি, কাকা প্রভৃতি হিন্দুয়ানি ডাকে সম্বােধন করতেন বলে মশাররফ হােসেন জানান।
মশাররফ হোসেন [Mir Mosarraf Hosain] পারিবারিক জীবনেও এ প্রথা পালনের প্রতি তার অনুকূল মনােভাবের সাক্ষ্য মেলে। তিনি তার নয় ছেলেমেয়ের নাম একই প্রক্রিয়ায় রেখেছিলেন। তার ছেলে-মেয়ে সকলেরই দুটো নাম ছিলÍএকটি মুসলমানি, অন্যটি হিন্দুয়ানি। তার ছেলেদের নাম ছিল যথাক্রমে মীর এব্রাহীম হােসেন ওরফে সত্যবান, আসরাফ হােসেন ওরফে রণজিৎ, ওমরদারাজ ওরফে সধুম্ব, মহবুব হােসেন ওরফে ধ?্ম্মরাজ, এবং ছােট ছেলের ডাকনাম যুবরাজ। অন্যদিকে মেয়েদের নাম ছিল যথাক্রমে রওসান আরা ওরফে সতী, আমিনা খাতুন ওরফে কুকি, ছালেহা ওরফে সুনীতি এবং সালেমা ওরফে সুমতী। মশাররফ হেসেনের প্রিয়তমা স্ত্রী কুলসুমের বিবাহপূর্ব নামও ছিল হিন্দুদেবী কালীর নামানুসারে। এমনকি, মশাররফ হােসেন তার প্রিয় কুকুরের নামটিও রেখেছিলেনÍ ‘মঙ্গলা’।
প্রিয়তমা পতœী বিবি কুলসুমের জীবনী লিখতে গিয়ে মশাররফ হােসেন যেসব প্রসঙ্গের উল্লেখ করেন, তাতে তার পারিবারিক জীবনে অনুসৃত বহু হিন্দুয়ানি আচার-অনুষ্ঠান বিধ্যাসের পরিচয় পাওয়া যায়। বিবি কুলসুমের জীবনে হিন্দুয়ানির মত ব্যাপক দৃষ্টান্তের তিনি উল্লেখ করেছেন, তাতে রীতিমতাে সন্দেহ করা চলেÍবিবি কুলসুম যথার্থই হিন্দুকন্যা ছিলেন কিনা। এ অনুমান মিথ্যা হলে এ কথা তখন স্বীকার করতেই হবে যে, মশাররফ হােসেনের সময়কালে বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনে তেমন কিছু ব্যবধান ছিল না। কুলসুমের মা লালন হিন্দুবাড়িতে ধান ভেনে জীবিকা করতেন বলে উল্লেখ আছে। এজন্যে লালনকন্যা কুলসুমের মধ্যে হিন্দুসংস্কারের প্রাবল্য থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি, তার ভাই মন্দির সম্ভবত মালােপাড়াতেই গরুর রাখাল ছিল। মালাে জাতি হল জেলে শ্রেণির নি¤œবর্ণীয় হিন্দু। মশাররফ হােসেন কালী ওরফে কুলসুমকে অগ্নিদগ্ধ এক মালােপাড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন। কুলসুমের মা ঐ গ্রামেই বাস করতেন।
বিবি কুলসুমের জীবনযাত্রার হিন্দুয়ানি সম্পর্কে মশাররফ হােসেন বহু তথ্যের উল্লেখ করেন। কুলসুমের পােশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার ব্যবহার, কথাবার্তা, চালচলন হিন্দু মহিলাদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল না। তিনি নিয়মিতভাবে মহাভারত পাঠ করতেন। গােময় বা গােবর পবিত্র গণ্য হতাে তার কাছে গােবর দিয়ে তিনি ঘরবাড়ি নিকোতেন। বিবি কুলসুমের গােময়-প্রীতি বর্ণনা করতে গিয়ে মশাররফ হােসেন লেখেন,
“চাকরাণী পীড়িতা থাকিলে নিজ রান্নাঘর পরিষ্কার করিয়া ছড়া গােবরে নিকাইয়া ফেলিতেন। প্রতিদিন বাড়ীর আঙ্গিনায় কানাচি গােবারে ছড়া দেওয়াইতেন। তিনি বলিতেন আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি আমাদের এই ধূলী মাটীময় দেশেএই বাঙ্গালাদেশে দুর্গন্ধ নিবারণ করিতে গােবর ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। আলামটীতে ঘর নিকাইলে জমাট বাঁধে না, যে উদ্দেশ্যে নেকান তাহা হয় না।”
বিবি কুলসুম কখনাে গরুর মাংস খাননি। প্রথম বয়সে এতই ঘৃণা বােধ করিতেন যে রান্নাঘরের বাটীতে গােমাংস কুটিতেÍ ঘরে আনিতে দিতেন নাÍহাঁড়ীতে দিতেন না। এমনও হতে পারে, মশাররফ হােসেনের সমকালে নি¤œশ্রেণির মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে নি¤œবর্ণীয় হিন্দুদের সাংস্কৃতিক জীবনের তেমন কোনাে তফাত ছিল নাÍযে জন্যে বিবি কুলসুমের হিন্দুয়ানি এতাে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
সম্প্রদায়-সম্প্রীতির জন্য তার আগ্রহ ও প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। প্রধানত গদ্য লেখক হলেও সঙ্গীত লহরীর কয়েকটি গানে তিনি ভারত সভা, জাতি সভা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানে ঐক্য স্থাপনের সম্ভাবনার কথা ভেবে আনন্দিত হয়েছেন,
“ভারত সভা জাতি সভা হচ্ছে দলে দলে রে ।।
নাই ভেদাভেদ কোন প্রভেদ হিন্দু মুসলমান।
ক্রমে ক্রমে হইতেছে এক দেহ এক প্রাণ রে।।”
‘শ্রী শ্রীমতী ভারতেশ্বরীর জুবিলি উপলক্ষে’ রচিত গানে ‘ভিক্টোরিয়া গুণগান’ কীর্তনের জন্য একত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন,
“এস হিন্দু-মুসলমান, কেন আর অভিমান,
জাতিহিংসা, বিদ্বেষ, ভুলি আজি সবেরে।।” (সঙ্গীত লহরী)
মীর মশাররফ হােসেনের ‘গাে-জীবন’ প্রবন্ধ তার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনার প্রত্যক্ষ্য নিদর্শন। সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে স্বজাতিকে তিনি গরুর মাংস আহারে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে ‘গাে-জীবন’-এ তাঁর সিদ্ধান্ত, “এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু মােসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্মে এবং কর্মে এক-সংসার কার্যে ভাই না বলিয়া। আর থাকিতে পারি না।ৃকালে আমরা রাজাকে পরিত্যাগ করিতে পারি। রাজাও আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারেন। কিন্তু হিন্দু মােসলমান কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবে না।”
এই প্রবন্ধ রচনার জন্য মীর মশাররফ হােসেনকে প্রচুর লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়। টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত আবদুল হামিদ খান উইসুফজয়ী সম্পাদিত ‘আহমদী’ পত্রিকায় গােজীবনের প্রথম প্রস্তাব ‘গােকুল নির্মুল আশংকা’ ছাপা হলে স্থানীয় অন্য একটি পত্রিকা ‘আখবারে এসলামিয়া’ সমালােচনায় বলে, মীর মশাররফ হােসেনকে মুসলমান নন। এ উত্তির সমর্থনে আরও রচনা পত্রস্থ হয় এবং টাঙ্গাইলের সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌলবি শফিউদ্দিনের বাসগৃহে ধর্মসভা অনুষ্ঠান করে লেখককে ‘কাফের’ স্থির করা এবং তার স্ত্রী তালাক (বিবাহ বিচ্ছেদ) হবার ফতােয়াও দেওয়া হয়।
তার ‘বসন্তকুমারী নাটকের প্রস্তাবনা-অংশে নট-নটীর সংলাপের ভেতর দিয়ে তিনি হিন্দু-মুসলিম বিরােধের পরিণাম সম্পর্কে পােষণ করেন। নটী স্পষ্টই বলতে চান, “এই সভায় কি সেই নাটকের অভিনয় ভাল হয়? হাজার হােক মুসলমান।” নটীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নটের জবাব, “অমন কথা মুখে আনিও না। ঐ র্সব্বনেশে কথাতেই ভারতের সর্বনাশ হচ্ছে।”
অভিন্ন শত্রুর মােকাবিলায় সাম্প্রদায?িক ঐক্যের প্রয়ােজন সমধিক। নীলকর কেনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নীলবিদ্রোহের নেত্রী প্যারীসুন্দরী হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা বলেছে, “হিন্দু-মুসলমানকে এক ভাবা চাই। শত্রুতা বিনাশ করিতে একতা শিক্ষা করা চাই। একতাই সকল অস্ত্রের প্রধান অস্ত্র। জাতিভেদে হিংসা, জাতিভেদে ঘৃণা দেশের মঙ্গল জন্য একেবারে অন্তর হইতে চিরকালের জন্য অন্তর করা চাই।”
মশাররফ কেবল সম্প্রদায়-সম্প্রীতির জন্যই প্রয়াস চালিয়ে যাননি, ধর্ম সম্পর্কেও তার মতামত ছিল যথেষ্ট উদার। মশাররফের প্রথম বিবাহকালে এক গ্রাম্য মাওলানা তার জাত ও ধর্মের পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় তিনি স্পষ্ট জবাব দেন তিনি ’নিরজাতিভুক্ত’ ও তার ধর্ম ‘মানবধর্ম’।১
এ থেকে বেশ বােঝা যায়, জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষ’ পরিচয়ই মশাররফের কাছে অধিক গুরুত্বলাভ করেছে। মশাররফের ‘টালা-অভিনয়’ (১৮৯৭) প্রহসনে তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাম্প্রদায?িক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। কলকাতার টালা-অঞ্চলে একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার প্?েক্ষাপিটে এই প্রহসনটি রচিত। টালা-হাঙ্গামায় মুসলমানদেরই দায?িত্ব ছিল অধিক। ঘটনাপ্রবাহ এবং নেতৃবৃন্দের প্রচারপত্রও এই ধারণা সমর্থন করে। টালা-ঘটনায় মশাররফ বিশেষ বিচারবুদ্ধি ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দেন। এই ঘটনায় স্বজাতি-স্বধর্মীদের প্রতি যুক্তিহীন আবেগবশত কোনাে অন্যায় সমর্থন ও সহানুভূতি তিনি দেখাতে চাননি।
মশাররফের সমাজচিন্তার মূল্যায়ন-প্রসঙ্গে ‘টালা-অভিনয়’ রচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু-মুসলমানের মিলনে কপট মৌলবী ও ফিকিরবাজ পুরােহিত কারাে প্রচেষ্টা বা ইচ্ছাই আন্তরিক ছিল না। প্রকৃতপর্বে এদের চক্রান্ত ও উস্কানিই এই দাঙ্গার মূল কারণ, প্রহসনে এই সত্যই উদ্ঘাটিত হয়েছে।
মশাররফের জীবনের প্রথম পর্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতাবধো ও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হিন্দু বিদ্যাতীর্থ নবদ্বীপ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য,
“জগতবিখ্যাত পবিত্র নাম নবদ্বীপ। সরস্বতীর কমলাসনে আজ পর্যন্ত নবদ্বীপ স্থাপিত রহিয়াছে। ঈর্থর কৃপায় জগৎ নিলয় না হওয়া পর্যন্ত নবদ্বীপের মহাপবিত্র গৌরব প্রত্যক্ষ প্রমাণের সহিত রহিবে। বঙ্গে সংস্কৃত বিদ্যার আদিগুরু স্থান নবদ্বীপ।”২
বৈষ্ণব মহাগুরু শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে তিনি যে বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ও ভক্তিপরায়ণ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁর এই বর্ণনায় “এই নবদ্বীপে মহা-মাননীয় হিন্দুধর্ম সংস্কারক সর্বজীবে সম দয়া, দয়ার অবতার, সর্বজীবে সমস্নেহ, জাতিভেদে বৈরক্তি প্রেমের উৎস প্রেমের মহােদয়ের জন্মস্থান লীলাস্থান।”৩ শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে তাঁর এই ধারণা পরধর্মসহিষ্ণু এক উদার-হৃদয় মানুষের পরিচয় তুলে ধরে।
হিন্দু-মুসলমানের মিলন-বিরােধ প্রসঙ্গে ‘সৎ-প্রসঙ্গ’ নামে মশাররফের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘কোহিনুর’ পত্রিকায় (ভাদ্র (১৩০৫)। এই প্রবন্ধে মশাররফ আন্তরিক আবেগে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বঙ্গদেশে প্রকৃতপথে হিন্দু-মুসলমানের কোনাে গুরুতর সামাজিক বিষাদ-বিরােধ নেই এবং অভিন্ন শাসন ও অর্থনীতির অধীনে অবস্থান ও একই সমতলে বসবাসের কারণে এই ধরণের কলহ-বিদ্বেষ থাকা নিতান্তই অর্থহীন।
প্রথম জীবনে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ধারণায় প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন মশাররফ। বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে তিনি কখনাে কোন বিরােধ স্বীকার করেননি। ইসলাম ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবােধের কারণে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন সােসাইটি মাদ্রাসাগুলাের সার্থকতার পক্ষে জনমত সংগ্রহ করে। সমকালের একজন বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে মীর মশাররফ হােসেনের অভিমতও সােসাইটি গ্রহণ করে তার মতামত কার্যবিবরণীতে প্রকাশিত হয়। এতে স্পষ্টতই দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষা সংরক্ষণের উপরে তিনি জোর দিয়েছিলেন এবং ধর্মমিশ্রিত সাহিত্য ও ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্বারােপ করেন। এই মনােভাবেই তিনি রচনা করেন ‘মৌলুদ শরীফ’, ‘মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা’, ‘বিবি খােদেজার বিবাহ’, হযরত বেলালের জীবনী ইত্যাদি ধর্মাশ্রিত সাহিত্য। উল্লেখ থাকে মশাররফ হােসেনের এই ধর্মমূলক রচনাগুলাে তার ধর্মপ্রাণ ও সমাজচিন্তারই প্রতিফলন।
মীর মশাররফ হােসেন রচিত সাহিত্যের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কিত গ্রন্থগুলির বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। ইসলাম ধর্মের মাধুর্যে শিল্পীমন মুগ্ধ ছিল। ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য তাঁর শিল্পীমনকে যেভাবে আলােড়িত করেছিল তারই ছায়া পড়েছে তার রচনাতে। তার রচনায় ইসলাম সম্পর্কিত পা-িত্যের পরিচয় না থাকলেও ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে তিনি মানুষের মধ্যে নতুন চেতনার জন্ম দেবার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা ছাড়া জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশ সম্ভব নয়। অথচ এই ক্ষেত্রে মুসলমানেরা দারুণভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। তখন বিদ্যালয়গুলােতে মুসলিম ছাত্রদের জন্য ইসলামি শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণত আরবি, ফারসি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ শুরু হতাে। পরে উর্দু মাতৃভাষা হলে মীর মশাররফ হােসেনের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করেন। এবং ঘােষণা করেন ‘বঙ্গভাষী মুসলমানের দেশ ভাষা বা মাতৃভাষা বাঙ্গালা’।
মশাররফের ‘গরড়াই ব্রিজ অথবা গৌরীসেতু’ কাব্যগ্রন্থের সমালােচনা প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শন’ (পৌষ ১২৮০) পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়, “বাঙ্গালা, হিন্দু-মুসলমানের দেশÍএকা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান এক্ষণে পৃথকÍপরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালার প্রকত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়ােজনীয় যে হিন্দু-মুসলমানে ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব থাকিবে, যে তাহারা ভিন্নদেশীয় বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু ফারসীর চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। কেননা জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা।”
আলােচ্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বৈরিতার প্রোপটে বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মশাররফ হিন্দু-মুসলমানের মানসিক ব্যবধান হ্রাস ও সাংস্কৃতিক যােগাযােগ গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
মাতৃভাষার বিতর্কের পাশাপাশি মুসলমান ছাত্রদের জন্য পৃথক পাঠ্যপুস্তক রচনার উপর আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়ােজন দেখা দেয় যাতে ইসলামের সারতত্ত্ব হাদিস-দলিলের সার, নামাজ-রােজার উপকারিতা ইত্যাদি বিষয় সরল বাংলা ভাষায় পাঠ্যভুক্ত হয়। সমসাময?িক কালের মুসলমানদের এই স্বাতন্ত্রবাদী চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় মীর মশাররফ হােসেনের ‘মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা’ পাঠ্যপুস্তকে।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি যে উদার ও মুক্ত মনের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই কালােত্তীর্ণ। ‘বিষাদসিন্ধু’তে আরবি ফারসি শব্দ যতটা সম্ভব বর্জন করে সংস্কৃতজ বাংলা শব্দ ব্যবহারের ফলে নিন্দিত ও সমালােচিত হন। যদিও তিনিই মুসলিম সাহিত্যে প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক। আর ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর অমর সৃষ্টি।
বাবার সাথে ঢাকা-সফর মশাররফের সাহিত্যিক জীবনের প্রস্তুতি-পর্বের জন্য একটা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ঢাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় এক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি মশাররফকে দুটো বই দেন ‘শব্দার্থ প্রকাশিকা’ নামে একটা বাংলা অভিধান ও উপাখ্যান ‘কাদম্বরী’। ‘কাদম্বরী’র মাধ্যমেই তিনি প্রথম যথার্থ সাহিত্যের স্বাদ লাভ করেন এবং পুঁথির আবর্ত থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযােগ পান।
মীর মশাররফ হােসেনের সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত এবং তার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানা যায় ছােটবেলায় তাঁর বাড়িতে পুঁথি পাঠের আসর বসতাে। তিনি ছিলেন তার একজন বিমুগ্ধ শ্রোতা। বাউল কবি লালন শাহের এলাকায় তাঁর বাড়ি হওয়ার কারণে বাউল গানের দ্বারাও তাঁর মানস-প্রকৃতি কিছুটা প্রভাবিত হয়। তবে সাহিত্য চর্চা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও পৃষ্ঠপােষকতা পান ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-সম্পাদক কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) ও কলকাতার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের (১৮৪২-১৯১৬) কাছ থেকে। বলা যায়, এঁদের দুজনের প্রেরণাতেই মশাররফের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। তার সাহিত্যচর্চার উন্মেষ পর্বে সংবাদ-নিবন্ধের পাশাপাশি কিছু প্রবন্ধ ও কবিতা ‘প্রভাকর’ বা গ্রামবার্তায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৬৫ সালের মে মাসে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ‘মুসলমানের বিবাহ পদ্ধতি’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরে (১২৭২) ‘প্রভাকরে’ তার গােলাপ’ নামে একটা কবিতা ছাপা হয়। মীর মশাররফ হােসেনের প্রথম জীবনের লেখাও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও পাঠক সমাজে সমাদৃত ছিল। তিনি কাঙাল হরিনাথের প্রকাশিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার লেখক ছিলেন। তিনি প্রবন্ধ বা কবিতার নিচে নিজের নাম দিতেন না। লিখতেন গৌরীতটবাসী মশা। শিক্ষানিবিশী-পর্বের পর মশাররফের প্রথম গ্রন্থ ‘রতœবতী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে।
এভাবে পুঁথিপাঠের আসরে বসবার অভিজ্ঞতা, বাউল গানের অধ্যাত্মচেতনা, সংবাদপত্রের অভিজ্ঞতা এবং জমিদারের কর্মচারীতে কার্যরত অবস্থায় অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের বিচিত্র স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তারই প্রতিফলন তার বিভিন্ন লেখার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সাংবাদিক হিসাবে তিনি প্রথম জীবনে যে কাজ শুরু করেছিলেন তারই সূত্র ধরে তিনি এক সময় ‘আজিজন নেহার’ ও ‘হিতকরী’ নামক দুটি পত্রিকা প্রকাশেও আত্মনিয়ােগ করেছিলেন।
বাঙালি মুসলিম সমাজে বাংলা গদ্যের ও আধুনিক সাহিত্যের চর্চা তেমন একটা ছিল না। তাই মশাররফের প্রথম গ্রন্থ ‘রতœবতী’ যখন প্রকাশিত হয় তখন ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায়৪ সন্দেহ প্রকাশ করা হয় বইটি মুসলমানের ছদ্মনামে ভিন্ন লেখকের রচিত। এই পত্রিকায় বলা হয়,
ÒThis is a romantic tale designed to show that knowledge is of greater importance than wealth, but as it is founded on the marvallous and the supernatural it is not likely to be of much use. The authorÕs argument is to the effect that knowledge is more valuable than wealth, since the former enabled one Sumanta to turn some women into apes, while the latter is effectual to produce that wonderfull result. But as knowledge that we know of can turn into apes, the superiority of knowledge over wealth may well be doubted. But we dare say that writer did not intend either to instruct or to argue, but merely to make his readers laugh. We take it that author has concealed his real name under the Ônom de plumeÕ of a Musalman.Óতিনের পৃষ্ঠার পর
মীর মশাররফ বিশুদ্ধ বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিম সাহিত্যিকদের সামনে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। ‘জমিদার দর্পণ’ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় যে মন্তব্য করা হয়েছিল তাতে এর স্বীকৃতি পাওয়া যায়,
“জনৈক কৃতিবিদ্যা মুসলমান কর্তৃক এই নাটকখানি বিশুদ্ধ ভাষায় প্রণীত হইয়াছে। মুসলমানী বাঙ্গালার চিহ্নমাত্র ইহাতে নাই। বরং অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা, এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ।”
পঞ্চম গ্রন্থ ‘এর উপায় কি?’ প্রহসন। কাহিনির পটভূমি মধ্যবিত্ত সমাজ। মদ্যাসক্ত ও বেশ্যাসক্ত পুরুষের অনাচার ও উজ্জ্বলতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণের (১২৯৯) ভূমিকায় মশাররফ হােসেন বলেছেন, “বিষয়টি ভাল নয়Íকিন্তু রাধাকান্ত বাবুর মত স্বামী, মুক্তকেশীর ন্যায় স্ত্রী, মদনের মত এয়ার খুঁজিলে যে, না পাওয়া যায় তাহা নহে। এ যাতনা অনেকেরই ভােগ করিতে হইতেছে। কত পরিবারের চক্ষের জল অবিরত ঝরিতেছে। সম্পূর্ণ নহে, কোনও সত্য ঘটনার কতক সময়ের চিত্রই ‘এর উপায় কি?’ বিষয়টি যতই কেন কদ্য হউক না, ঘরের কথা যে পরের কানে গিয়াছে, আর কেন? বাবুদিগের মনে এই কথাটা উদয় হইলেও আমার পরিশ্রম ও অর্থব্যয় সার্থক মনে করি।”১২ লেখকের উদ্দেশ্য যে সমাজ-সংস্কার, এখানে তা স্পষ্ট। ঢাকার ‘বান্ধব’ পত্রিকায় প্রহসনখানির বিরূপ সমালােচনা হয়, “এদেশের মুসলমান ভদ্রলােকেরা সাধারণ সাহিত্যে বীতস্পৃহ বাঙ্গালা সাহিত্যের সহিত তাঁহাদিগের কোন সম্বন্ধ নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং যখন তাহাদিগের মধ্যে কেহ কদাপি সখ করিয়া বাঙ্গালা লিখিতে ইচ্ছা করেন, তখন আমরা নিতান্ত সুখী হই, এবং তাঁহাদিগের প্রশংসা করিতে প্রাণপণে যতœ করি। কিন্তু তাহারা যশােলাভের এমন সহজ পথ থাকিতেও, কল্পনায় ও ভাষায় যার পর নাই জঘন্য রুচির পরিচয় দেন,Íঅশ্লীল পদাবলীর ছড়াছড়িকেই কাব্যরসে রসিকতা মনে করেন, তখন এই গ্রন্থকারের ন্যায় আমরা বিপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করি এর উপায় কি?”১৩ মদ্যপান, বেশ্যালয় গমন প্রভৃতি অসামাজিক আচরণ নিয়ে সেযুগে নাটক-প্রহসন অনেকে লিখেছেন। প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬) প্রভৃতি এ শ্রেণির রচনা। মশাররফ ‘সধবার একাদশী’র দ্বারা প্রভাবিত হন। উল্লেখযােগ্য যে, ইন্দ্রিয়চর্চায় মশাররফ হােসেনের ব্যক্তিগত জীবনেও পদস্খলন ঘটেছিল।১৪
মশাররফ হােসেনের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ‘বিষাদ সিন্ধু’। ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হজরত মােহাম্মদ (সঃ)-এর দৌহিত্রদ্বয় হাসান-হােসেনের সঙ্গে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালা প্রান্তরের রক্রক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ইমাম হাসানহােসেনের করুণ মৃত্যুকাহিনি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থে বর্ণিত মূল বিষয়। অবশ্য এই মূল ঘটনার সঙ্গে গ্রন্থটিতে অসংখ্য শাখা কাহিনী উপকাহিনির সন্নিবেশ ঘটেছে। এ গ্রন্থে হৃদয়বিদারক বিষাদময় ঘটনার সঙ্গে ‘মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কারবােধ’ ইত্যাদি সংযােজিত হওয়ায় পাঠকদের হৃদয়কে আবেগায?িত করে তোলে। ‘বিষাদ-সিন্ধু’র জনপ্রিয়তা দুই ধরণের পাঠকের কাছে ভিন্ন দুই কারণে। প্রথমত, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত স্পর্শকাতর কাহিনি সাধারণ মুসলিম পাঠকের কাছে এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, ‘বিষাদ-সিন্ধু’র যাদুকরী রচনাগুণের জন্যে সাহিত্যরসিকজনের কাছেও গ্রন্থটি আদরণীয়। গ্রন্থটিতে তিনি মানুষের হৃদয়ানুভূতির দ্বান্দ্বিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। জয়নবের রূপে বিমােহিত এজিদ এবং এই রূপতৃষ্ণার পরিণামে বহুমানুষের বিপর্যয় ও ধ্বংসের যে কথকতা বার্ণিত হয়েছে তা গ্রন্থটিকে সর্বজনীন করে তুলেছে। এই গুণটি গ্রন্থটির জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। হয়তাে তাই ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, “বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্য খানির সমান আদর।” অধিক জনপ্রিয়তার কারণেই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বেণীপ্রসাদ বাজপেয়ী মঞ্জুল কর্তৃক হিন্দিভাষায় অনূদিত এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ থেকে মুদ্রিত হয়।
মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনায় বৃহত্তর সমাজ কাঠামােকে উপন্যাসে আনেন। অনেক ঔদার্য ও উন্মত্ত জ্ঞানে তিনি বাংলা গদ্যরীতিকে উপন্যাসের কাহিনিতে প্রবিষ্ট করান। তার ভাষা সংস্কৃতবহুল। এমন ভাষার প্রতি তার ঔদার্য ও অনুরাগ ছিল। বিষাদ-সিন্ধুতে তার প্রমাণ যেমন মেলে তেমনি বহুকালব্যাপী জনপ্রিয়তার বিষয়টিও তাঁর রচনায় বিরাজমান,“স্বয়ং ঈশ্বর তুর পব্বতে যাহার কথা কহিয়াছিলেন, মুসা সেই সচ্চিদানন্দের তেজোময় কান্তি দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইলে কিঞ্চিৎ আভামাত্র যাহা মুসার নয়নগােচর হইয়াছিল, তাহাতেই মুসা স্বীয় শিষ্যসহ সে তেজ ধারণে অক্ষম হইয়া তখনই অজ্ঞান অবস্থায় ধরাশায়ী হইয়াছিলেন, শিষ্যগণ পঞ্চত্ব পাইয়াছিলেন, আবার ক(ণাময় জগদীধর, মুসার প্রার্থনায় শিষ্যগণকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া মুসার অন্তরে অটল ভক্তির নবভাব আবির্ভাব করিয়াছিলেনÍসে মহামতি সত্য-তার্কিক মুসাও আজি হােসেন শােকে কাতর, কারবালায় সমাসীন।”১৫
এ দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছিল মীর মশাররফ হােসেনের ব্যক্তিজীবন থেকে। অনেক স্পর্শকাতর আখ্যান রচনায় তিনি প্রমাণ করেছেন তার মানবতাবাদের শর্তসমূহ। মীর মশাররফ হােসেন পারিবারিক জীবনেও এরূপ প্রতিশ্রুতি পালন করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা চলে “মশাররফ হােসেন একদিকে ছিলেন প্রাচীন জমিদারের সন্তান অন্যদিকে আধুনিক কালের বন্ধনমুক্তিকামী মানুষ। এ দু’য়ের সংমিশ্রণে মশাররফ হােসেনের অদ্ভুত মানস গঠন লক্ষ্য করা যায়। তার জন্ম এমন এক সময়ে যখন তৎকালীন ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব দৃঢ?ভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শাসক শ্রেণী মুসলমানের নিকট থেকে সব রকমের সুযােগ-সুবিধা কেড়ে নিয়েছে। মশাররফ হােসেনের পূর্বপুরুষ পিতা-পিতামহদের জমিদারি ছিল। কিন্তু নানা কারণে ধীরে ধীরে তাদের সম্পত্তি লােপ পেতে থাকে। এদিকে কৃষকরাও জমিদারের উপর আস্থা হারাতে থাকে এবং উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে কৃষক বিদ্রোহ দেখা যায়Íবিশেষত নীল-বিদ্রোহ। মশাররফ হােসেনের পিতা মীর মােয়াজ্জেম হােসেন জমিদার ছিলেন। তিনি ইংরেজদের প্রতি অনুগত ছিলেন।”১৬
এরূপ পরিবেশের দায়বদ্ধতায় উপন্যাসের ত্রুটি তিনি চিনে নিতে পেরেছিলেন। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার সূত্রটি পাওয়া যায় বিষাদ-সিন্ধু’ পাঠ করলে। নিজ ধর্ম ও মুসলিম আনুগত্যের প্রেরণা তিনি অর্জন করেন বাল্যকালেই। কিন্তু সেটি বিশেষ কোনাে কাল পরিবৃত্তে বা স্বধর্মের-কাঠামােতে আটকান নয়, হয়ে ওঠেন জীবনভাষ্যের পূর্ণাঙ্গ রূপকার। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ শুধু পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস নয়, একটি ধর্মনিঃসৃত আখ্যানও বটে। বিচিত্র ভাবনার পরিবৃত্তে এটির অবলােকন চলে অনেককালব্যাপী। ‘বিষাদ-সিন্ধু’র লেখক হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। মীর মশাররফ হােসেন বঙ্কিম অনুসৃত রীতিতে উপন্যাস রচনা করেন। এবং সেখানে বঙ্কিমী পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি সামনে এগুতে থাকেন।
“মানবভাগ্যের এই আবেগময় রূপায়ণের জন্যেই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ মূল্যবান। ৃঘটনার গতি রুদ্ধ করে আত্মগত ভাবনার সংযােজন মশাররফ হােসেনের গদ্যরচনার একটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য। এই কৌশল তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে লাভ করেছেন বলে মনে হয়, তবে বঙ্কিমের তুলনায় মশাররফ হােসেনের এই জাতীয় উক্তি দৈর্ঘ্যে ও সংখ্যায় বেশি। বঙ্কিমচন্দ্র স্বল্পকথায় যা বলেছেন, তার চেয়ে বুঝিয়েছেন অনেক বেশি সতর্ক পাঠকমনে তার অনুক্ত ক্কতব্যও স্পষ্টরূপ লাভ করেছে। মশাররফ হােসেন তার ছােট বক্তব্য বেশী কথায় বলেছেন এবং কিছুই বলতে বাদ রাখেননি।”১৭ গদ্যে মানবচরিত্রের প্রকৃত স্বরূপই শুধু বের করা নয়, তার ত্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দ্বিধা-দোলাচলতা সবকিছু মানুষের অঙ্গীভূত বার্তায় প্রচার করেন তিনি। সেখানে শিল্প হওয়ার জন্য প্রকৃত যে সংযম সেটি তার ছিল। এছাড়া বঙ্কিম জনপ্রিয়তার কারণ ধর্মীয় সহানুভূতি বা আবেগ মীর মশাররফের রচনায় বিপুলভাবে বিদ্যমান। ধর্মীয় আখ্যানে তিনি এতােটুকু কম যাননি। এজিদ তার অত্যন্ত প্রিয় ও জনপ্রিয় চরিত্র। এজিদ চরিত্রের প্রতি তিনি যাবতীয় সহানুভূতি লেপন করেছেন শিল্পসৃষ্টির অনিবার্য কারণেই। সেখানে হিন্দু-মুসলমান শুধু নয় মানুষের গরিমাকেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সাহিত্যের প্রকৃত স্থানটি তিনি অতি সহজেই চিনে নিতে পেরেছিলেন। সেজন্য তিনি কিছুতেই পিছপা হননি। এমনকি নিজ ধর্মকেও অবহেলা করেছেন। এ কারণেই তার জনপ্রিয়তার মূলশর্ত নির্ধারিত। একটু উদাহরণ দিলে তা পরিষ্কার হবে, “এ শিরে তােমার স্বার্থ কি? খ-িত শিরে প্রয়ােজন কি? অর্থ? হায়রে অর্থ! হায়রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতাপুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনােমালিন্য, ভ্রাতাভগ্নীতে কলহ, রাজাপ্রজায় বৈরীভাব, বন্ধুবান্ধবে বিচ্ছেদ, বিবাদবিসম্বাদ কলহ, বিরহ, বিসর্জন, বিনাশ, এ সকল তােমারই জন্য। সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি।”১৮ কিংবা অন্য প্রসঙ্গে, “ভাই মারােয়ান! তুমি আমার বাল্য সহচর। আজ তােমাকেই আমার প্রতিনিধি স্বরূপ এই বীরদলের অধিনায়ক হইতে হইবে। তােমাকেই সৈন্যপত্যের ভার গ্রহণ করিতে হইবে, কারণ হাসান-হােসেনের বধ সাধনের জন্য সৈন্যদলকে মদিনায় পাঠাইতেছি। যদি এজিদের মান রক্ষা করিতে চাও, যদি এজিদের অন্তরাগ্নি নি?্ব্বাণ করিতে চাও, যদি এজিদের মনে দুঃখ দূর করিতে চাও, যদি এজিদের জয়নব লাভের আশাতরী বিষাদ-সিন্ধু হইতে উদ্ধার করিতে চাও, তবে এখনই অগ্রসর হও, আর পশ্চাতে ফিরিও না।”১৯ এভাবে প্রণয়-উত্তপ্ত জয়নবের প্রলম্বিত ধ্বনি আমরা অবলােকন করি উপন্যাসে। রূপজ মােহে সে অন্ধ। এটি তিনি অর্জন করেন তার পূর্বসূরি বঙ্কিমের নিকট। আর এছাড়া তার ট্র্যাজিক সূত্রটিও আমরা অনুধাবন করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২২১৮৮৬)-র ট্র্যাজিক ভাবচেতনা থেকে। এরূপে মীর মশাররফ হােসেন তার উপন্যাসের জনপ্রিয়তার পরিচর্যাটি সম্পন্ন করেন। একাধারে নিজ মেধা অন্যদিকে সমসাময?িক কাল-অনুবর্তী লেখকদের সান্নিধ্যে। সেখানে তিনি বিশেষ ধর্ম বা সংস্কারে আত্মলীন ছিলেন না। মীর মশাররফ সেখানেও হয়ে ওঠেন অজেয়। এ প্রসঙ্গে সমালােচকের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য,“বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থের বড় একটি সাফল্য লেখকের চরিত্র রূপায়ণের মধ্যে উদ্ভিন্ন। তিনটি পর্ব মিলে অনেক নারী-পুরুষের সম্মিলন ঘটেছে এ গ্রন্থে। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির বাতাবরণে শেষ পর্যন্ত তার নায়ক এজিদ নঙর্থক জীবনেরই প্রান্তরেখায় নিঃশেষিত হয়েছে। যে রূপতৃষ্ণ ‘বিষাদসিন্ধু’র প্রারম্ভকে উপন্যাসােচিত অভিব্যক্তি দান করেছে সেই তৃষার্ত নায়কের অভিজ্ঞান ধারণ করে এ গ্রন্থে উন্মােচিত হয়েছে। এজিদ। ৃতার চরিত্রগুলাে ৃশত্রুতায়-হতচকিত মিত্রতায় উদ্বেলিত কিংবা প্রিয়জনদের ভালােবাসায় হৃদয়বেদ্য।”২০ ‘বিষাদ সিন্ধু’ তিনটি পর্বে সম্পন্ন মহররম পর্ব (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭) ও এজিদ পর্ব (১৮৯১)। কারবালার বিষাদময় কাহিনী নিয়ে উপন্যাস রচিত। কল্পনার যথেষ্ট আশ্রয় থাকলেও এটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত। মধুসূদন যেমন পৌরাণিক কাহিনীকে আধুনিক চিন্তার বাহন করেছিলেন, মশাররফ তেমনি দোভাষী পুঁথি প্রভাবিত পৌরাণিক-ঐতিহাসিক কাহিনীকে নতুন চিন্তার বাহন করেছিলেন। তারা উভয়েই ধর্মের বন্ধন স্বীকার করেননি। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাবণ ও এজিদ সংগ্রাম করে উভয়ে লেখকের সহানুভূতি পেয়েছেনÍঅধার্মিকতা, পাশবিকতা প্রভৃতি দীর্ঘকালের আরােপিত মনুষ্যত্বহীন চরিত্র-ধর্ম থেকে তাঁদের মুক্ত করে মানবােচিত চারিত্রিক দোষ-গুণ আরােপ করেছেন। ‘বিষাদসিন্ধু’র উৎস ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লেখক মুখবন্ধে (মহররম পর্ব) বলেছেন, “পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদসিন্ধু’ বিরচিত হইল। প্রাচীন কাব্যগ্রন্থের অবিকল অনুবাদ করিয়া প্রাচীন কবিগণের রচনাকৌশল এবং শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ।ৃমহরমের মূল ঘটনাটি বঙ্গভাষাপ্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণের সহজে হৃদয়ঙ্গম করিয়া দেওয়াই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।” ‘বিষাদসিন্ধু’ একটি যুদ্ধপ্রধান রচনা। বইয়ের অর্ধেকটা জুড়েই যুদ্ধ। মদিনার প্রবেশপথে প্রথম যুদ্ধে হাসানের নেতৃত্বাধীন মদিনাবাসী এজিদের আক্রমণ প্রতিরােধ করেছে। কারবালার ফোরাত নদীর তীরে এজিদ-বাহিনী হােসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাঁর পুরজনদের বন্দী করেছে। মদিনার পথে তােগান ও তুর্কির সেনাদল শত্রুর চাতুর্যে পরাভূত হলেও শেষ পর্যন্ত মুসাহিব কাক্কার কাছে সীমার-বাহিনী পর্যদস্ত হয়েছে। মদিনার প্রান্তরে দ্বিতীয় যুদ্ধে হানিফার হাতে এজিদের সেনাপতি অলীদের চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটল। শেষ যুদ্ধ দামাস্কাসের প্রান্তরে, সবচেয়ে দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ,Íপ্রাসাদের ভেতর পর্যন্ত সে যুদ্ধ বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসে যুদ্ধের বিবরণ বড় কম নেই, প্রায়ই তা কল্পনার রঙে অতিরঞ্জিত, তুলনায় মশাররফ হােসেনের উপন্যাসে নিষ্ঠুর রূঢ? বাস্তবতা বেশি। এই লেখায় যুদ্ধ-ঘটনাগুলিতে অতীতের কণ্ঠ এত সােচ্চার, যাতে একে উপন্যাস এমনকি রােমান্স বলতেও কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ হয়। ইউরােপ-আমেরিকার আধুনিক ওয়র-নভেলের চেয়ে বরং ব্যাস-হােমরের মহাকাব্যের আদল এখানে বেশি। ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসে লেখক ভারতবাসীর জাতীয় স্বাধীনতার স্পৃহাকেও জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘বিষাদসিন্ধু’ রচনাকালে দেশ ছিল পরাধীন। লেখক হােসেন পরিবারের বন্দিদশা থেকে মুক্তির প্রণটিকে যেভাবে এবং যে ভাষায় সামনে নিয়ে আসেন তাতেই শিল্পীর সে আকাঙ্খটি স্পষ্ট হয়। লেখকের উক্তি অমূল্য রতœ স্বাধীনতাধন যে স্থানে বর্জিত, সে স্থান অমরাপুরী সদৃশ মনােনয়ন মুগ্ধকর সুখ-সম্ভোগের স্থান হইলেও মানব চক্ষে অতি কদাকার ও জঘন্য। কত বন্দি ভ্রমে, পক্ষপাতিত্বে, অনুরােধে, বিভ্রাটে আজীবন ফাটকে আটক রহিয়াছে। লেখকের এই উক্তিতে শুধু এজিদ শাসনামূলের বিচার ব্যবস্থার ত্রুটির দিকটিই তুলে ধরা হয়নি, এর মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ ভারতের বিচার পদ্ধতির নানা দুর্বলতাকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘বিষাদসিন্ধু’ র শিল্পীর দৃষ্টি সাম্প্রদায?িক ভেদবুদ্ধি দ্বারা কখনােই আচ্ছন্ন হয়নি। লেখক কাফের বলতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নয়, হাসান-হােসেনের শত্রু পক্ষে মুসলমান হলেও কাফের বলে অভিহিত হয়েছে। অসাধারণ ত্যাগে সমর্থ আজর দম্পতিকে সামনে এনে শিল্পী তার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টির এক অবি?্বাস্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। এই উপন্যাস সম্পর্কে বিজ্ঞ সমালােচক মুনীর চৌধুরী মন্তব্য করেন, “মধ্যযুগীয় ধর্মচেতনার জীবনবিমুখ আচ্ছন্নতাকে অপসারিত করে ইহলােকের ইন্দ্রিয় পরবশ মানব মানবীর হর্ষ-শােকের মহামূল্যকে তিনি যে কল্পলােকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, সেটাই তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়।
এই জন্যই ‘বিষাদসিন্ধু’ র প্রধান চরিত্রসমূহ, কিৎসা-কাহিনীর ক্রোড়োদ্ভূত হয়েও অনেক দূর পর্যন্ত মৃত্তিকা সংলগ্ন, প্রিয় পরিজনবেষ্টিত, শত্রু-মিত্র পরিবৃত, সজীব নরনারী।”২১ সমালােচকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা কিছুটা দ্বিমত পােষণ করি। ‘বিষাদসিন্ধু’র প্রধান চরিত্রসমূহ মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষের স্বভাবকে কিছুটা ধারণ করলেও তারা মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষ নন। তারা উভয় দিকেই রাজ-পরিবার ও তাদের অমাত্য-পরিবারবর্গের অন্তর্গত। উপন্যাসের ঘটনাধারায় নিয়ন্ত্রক চরিত্রের মধ্যে মায়মুনাই মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষদের প্রতিনিধি, কিন্তু লেখক তাকে অতি নিচাশয় নারীর দৃষ্টান্ত রূপে উপন্যাসে উপস্থিত করেছেন। রাজ-রাজড়ার এ বিখ্যাত কাহিনিতে সাধারণ মানুষের স্থান বড় একটা নেই। যাইহােক, বঙ্কিমচন্দ্র, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখ লেখকেরা মশাররফের ‘বিষাদ সিন্ধু’র ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ‘ভারতী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় তার ‘বিষাদ সিন্ধু’র অনুকূল সমালােচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-র মন্তব্যÍমুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় অল্পই অনুবাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে।২২ ‘ভারতী’-তে বলা হয়েছিল, ইতিপূর্বে একজন মুসলমানের এত পরিপাটি বাঙ্গালা রচনা আর দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।২৩ কিন্তু মনে রাখতে হবে ‘বিষাদ সিন্ধু’-র অত্যাশ্চর্য সাফল্য ছাড়া তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম বস্তুতই তেমন প্রশংসার দাবী করতে পারে না। ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগে’র বার্ষিক প্রতিবেদনে (১৮৮৭) ‘বিষাদ-সিন্ধু’র ‘উদ্ধার পর্ব’ সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ও মুল্যবান। এই চুম্বক মন্তব্যে মশাররফের শিল্প-প্রতিভার যে মূল্যায়ন করা হয় তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, ÒMir Mosharraf HossainÕs Bishad Sindhu, based on the events before and after the great battle of Karbala, is one of the best works in the Bengali Language. The earnestness and pathos of the work, its elevated moral tone and dignified diction, raise it to a high level, and mark a distinct departure, both in matter and in manner, from the current examples of imaginative writing in Bengali.Ó28 তবে ‘বিষাদ-সিন্ধু’র সমাদর প্রশংসার পাশাপাশি বিরুপ সমালােচনাও কিছু কিছু হয়েছে। কায়কোবাদ তার মহরম শরিফ (১৩৩৯) কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় ‘বিষাগ-সিন্ধু’র কঠোর সমালােচনা করেন। ‘মহরম শরিফ’ রচনার কারণ হিসেবে তিনি ‘বিষাদসিন্ধু’র অনৈতিহাসিককতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর অভিযােগ,
“মীর মশাররফ হােসেন সাহেব কল্পনারাজ্যের কতকগুলি অবান্তর কথা লিখিয়াÍঘটনা উপন্যাস আকারে সাজাইয়া ইসলামের হৃদয়-পঞ্জরে তীব্র শেলাঘাত করিয়াছিলেন।”২৫
কায়কোবাদের বিবেচনায় ‘বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনি ‘অবান্তর কথা’, মশাররফ ‘মুসলমান ধর্ম ও জাতির উপরে ঘাের কলঙ্ক-কালিমার অনুলেপন’ করেছেন, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ জাতীয় রচনা ‘পুতিগন্ধময় রাবিশ’ ও ‘কাল্পনিক বাজে কথায় পরিপূর্ণ’।২৬ অবশ্য উপসংহারে কায়কোবাদ স্বীকার করেছেন, মুসলমান বাংলাসাহিত্যের শৈশব অবস্থায় রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’র ‘শত দোষ থাকিলেও তাহা মার্জনীয়’ এবং এই গ্রন্থই মশাররফকে ‘অমর করিয়া রাখিয়াছে’।”২৭
‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০-১৮৯২) মশাররফের জীবনীমূলক উপন্যাস। এতে মীর সাহেবের চরিত্রে মােশাররফকে কিছু অংশ দেখতে পাওয়া যায়। কেনীর সঙ্গে বন্ধুত্বে ও নীলকরদের সমর্থন এবং সাহায্য করার মধ্যে মীর সাহেবের যে-পরিচয় আছে তাতে লেখকের পিতৃ-জীবনের প্রতিবিম্বন। মীর সাহেবের দ্বিতীয় পতœীর অপঘাত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিকের প্রণয?িনী লতিফনের বেদনাময় পরিণতির ছায়াও চোখে পড়বে।
মশাররফের এই উপন্যাসে সমকালের উচ্চবংশের অনেক মুসলমান যে আত্মকলহে লিপ্ত চরিত্রহীনতায় গ্রস্ত এবং মানবত্বের মহত্ত্ব বর্জিত হয়ে ধ্বংসের পথে চলছিল তারই ঘটনা পাওয়া যায়। স্বার্থ দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত পরিবারের মধ্যে যে বিষ প্রয়ােগ, গােপন চক্রান্ত ও জঘন্য নীচতা বর্তমান ছিল মীর সাহেবের পারিবারিক জীবনের ঘটনায় তা বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। লেখক মশাররফ হােসেন এই উপন্যাসে মীর সাহেবের দেহ ও মনের পরিচয় দিয়েছেন। মীর সাহেব দেখতে গৌরবর্ণ, স্থূলকায়, মিষ্টভাষী, সরল প্রকৃতি ও ঘাের আমােদ-প্রমােদী। মীর সাহেবের চরিত্রে পরস্পর বিরােধী দুই দিক বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। মুসলমান জমিদার মীর সাহেব এক রকম বাধ্য হয়ে নীল কুঠিয়াল কেনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেছেন। নিজের সম্পত্তি, মান-সম্মান বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে শােষক কেনীর সঙ্গে তাকে বন্ধুত্ব করতে হয়েছে। এ জন্য তার মানসিক দ্বন্দ্বও ছিল। সাগলোম চরিত্রটি মীর সাহেবের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তবে লেখক সা গােলাম চরিত্রটিকে বেশ ঘৃণা করেই এঁকেছেন। তবুও তার চরিত্রের একটি বাস্তব দিক উন্মােচন করেছেন লেখক। ঘর-জামাই সা গােলাম খুড়শুর মীর সাহেবকে বিষয় সম্পত্তি থেকে দখলহীন করার ইচ্ছায় দলিল চুরির মতাে জঘন্য কাজ করছে যখন, সেই সময় সে শুনল, মীর সাহেব সব দায়িত্ব তাঁকেই দিতে চান। তার হাতে তুলে দিতে চাইছেন পারিবারিক দলিলের বাক্স। তখন সে চমকে উঠলÍ“অন্তরে আঘাত লাগিল। এ অন্য আঘাত নহে, এ দুঃখের আঘাত নহে, ভক্তির সহিত প্রেমের আঘাতও নহে। এ নি, আত্মনির আঘাত।” মীর সাহেবের দুধে বিষ প্রয়ােগ, তাকে নদীর ঘাট থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি তার চরিত্রের নীচতার-ই লক্ষণ। নীল বিদ্রোহের প্রোপটে প্রজাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের নেতৃত্ব করা এবং নিজস্ব আর্থিক উন্নতি করার মধ্যে তার নীচতা প্রমাণ হলেও এতে তার কূটবুদ্ধি ও প্রজাদের উদ্বুদ্ধ করার মত ব্যক্তিত্বও প্রকাশিত হয়েছে। নারী-চরিত্রগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ্য দৌলতুন্নেসা। তাঁর চরিত্র অঙ্কনে লেখক তুলনাশ্রয়ী হয়েছেন। হিন্দু-মুসলমানের পুরাণ কাহিনীর নারী-চরিত্র থেকে শুরু করে প্রাচীন ও সমকালীন সাহিত্যের নারী-চরিত্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দৌলতুন্নেসার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের চেষ্টা যথেষ্ট দুর্বল রচনারীতিরই স্মারক হয়ে আছে। দৌলতুন্নেসার শ্রেষ্ঠত্বের প্রচারে লেখকের মুখর হবার যুক্ত দৌলতুন্নেসার দৌলতে মীর সাহেবের এই বিলাসিতা, এই রঙ্গরস। এসব জানা সত্ত্বেও তিনি স্বামীর প্রতি বিরূপ নন। সমালােচনাও করেন না। বরং মীর সাহেবের জীবনের পূর্ববর্তী ঘটনার ব্যক্তিগত যন্ত্রণার প্রোপটে তাঁর রঙ্গরসকে সমর্থন করেন। দৌলতুন্নেসা তুলনাহীন পতিভক্তি পরায়ণা। তিনি যাহাতে সুখে থাকেন তাহাই আমার সুখ। এই তাঁর আদর্শ। যতদূর মনে হয় তৎকালীন নারী সমাজের পুরুষ-নির্ভরতা তথা নারীর উপর পুরুষের অহেতুক আধিপত্যই নারীর অযৌক্তিক স্বামীপ্রীতির মূলে আছে। শিক্ষার অভাব অন্তঃপুরবাসিনী নারীকে কী মাত্রায় স্বামীগত প্রাণা করে রেখেছে দৌলতুন্নেসার অপমৃত্যুই তার প্রমাণ। তাছাড়া তৎকালীন সমাজে নারী স্বাধীনতা কতখানি অবহেলিত হত এবং নারী নির্যাতন কী পরিমাণে হত তার অপর একটি দৃষ্টান্ত হল জকির প্রথমা স্ত্রী ময়নার জীবন কথা। ময়না স্বামীর নির্দেশে নীল কুঠিয়াল কেনীকে দেহ দিতে বাধ্য হয়েছে। গর্ভধারণ করেছে সে এবং সাহেবের দেওয়া ঔষধ নিজে ইচ্ছামত সেবন করে আত্মহত্যা করেছে।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) মুলত ব্যঙ্গমূলক উপন্যাস। এতে কোনও কোনও ঘটনা এবং চরিত্র বাস্তব জীবন অবলম্বন করে লেখা-লেখক মশাররফ হােসেনের নিজ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। ভেড়াকান্ত ও তাঁর স্ত্রী স্বয়ং ঔপন্যাসিক এবং বিবি কুলসুমের (মশাররফের স্ত্রী) প্রতিকৃতি। লেখকের নিজ জীবন এই উপন্যাসের উপাদান হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটিতে মেয়ে-জমিদারের নেতৃত্বে পরিচালিত দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছবি আছে। সােনাবিবি-মণিবিবি সম্পর্কে দু-বােন, কিন্তু এই দু-বােন পরস্পর পরস্পরকে সর্বস্বান্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে জঘন্যতম চত্রান্ত করেছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়েছে, লাঞ্ছনা ও অপমানের কঠিন হাতিয়ার প্রয়ােগ করেছে। অর্থ দিয়ে জজ-ম্যাজিস্ট্রেটকে বস করা, পুলিশ লাগানাে, জেলে দেওয়া, জেল ছাড়ানােÍসমস্ত রকমের আইন বহির্ভূত কাজ ও অবাধে জোচ্চুরি চালিয়েছে। দুই জমিদারনীর স্বভাব-চরিত্রে তফাৎ রয়েছে, নৈতিক অবস্থানও সম মাপের নয়। বেগম সাহেবা আলােকপ্রাপ্ত মহিলা। সে তার বিগত প্রায় যৌবনকে ঘষে-মেজে কলাকৌশলে আহার-বিহারের দ্বারা হাকিমউকিল পুলিশ-কর্তাদের উপরে মােহ বিস্তার করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করে। সাহস ধৈর্য প্রেম বাৎসল্য বুদ্ধি নিয়ে ভেড়াকান্ত ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’-র স্বতন্ত্র মানুষ। সােনাবিবির কর্মচারী সে, তার স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টাও চালায় সে, কিন্তু জমিদারীর পাপ তাকে গ্রাস করতে পারেনি। এককথায় একদিকে এই উপন্যাসে যেমন মুসলিম সমাজ জীবনের ভালাে দিকটা চিত্রিত হয়েছে তেমনি খারাপ দিকটিও ঔপন্যাসিক মীর মােশাররফ হােসেন সুচতুরভাবে দেখিয়েছেন। এই চিত্র যেমন বাস্তব তেমনি মর্মস্পর্শী। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এই গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন ‘কখন কখন মনে হয়, বুঝি তােমাকে আমাকে লক্ষ্য করিয়াই এই পুস্তক লিখিত হইয়াছে। ইহাতে নাই এমন রস দুর্লভ। কটু, তিক্ত, কষায়, অম্লমধুরমধুর, অতি মধুর,যাহা চাও, তাহাই প্রচুর। অথচ সকল রসের উপর দিয়া কাতর করুণ রস উছলিয়া পড়িতেছে।২৮ ১৯০০ সালের ৩১শে অক্টোবরের ‘কলিকাতা গেজেট’-এ ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ সম্পর্কে অন্য যে সমালােচনাটি প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ÒIt is a story relating mainly to the quarrel between two femal and Muhammedan Zamindars in Northern Bengal. It is full of graphic realistic sketches illustrating the life led by the local Muhammedan gentry, the vogury of the Zamindari amla, the corruption of the police and the high-handed proceedings of the native judiciary and magistracy in the mufassal. Among the characters, that of Begum Saheba is very cleverly drawn. The writer is no friend of femal emancipation, and he comments in strong language on Begum SahibÕs not conforming to the system of Parda prevalent among highclass Muhammedan ladies. The writer though a Muhammedan; writes Bengali with ease and possess a wonderful command over the vacabulary of the language. But his style is nevertheless ungrammatical and marked by East Bengalism and an absence of literary grace.Ó
‘তহমিনা’ উপন্যাসটি কবি ফেরদৌসীর বিখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহনামা’য় বর্ণিত সােহরাব-রােস্তমের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। মীর মশাররফ হােসেনের এ রচনাটি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশ লাভ করে মাসিক ‘হাফেজ’ পত্রিকায় (জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী ও মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায়), কাজী আব্দুল মান্নান তাঁর ‘আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম-সাধনা’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম এ তথ্য প্রদান করেন। মশাররফ হােসেন বলেছেন, কবিগুরু ফেরদৌসী মহােদয়ের পদাঙ্ক চিহ্ন লক্ষ্য করিয়াই এই ‘তহমিনা’। সােহরাবরােস্তম সম্পর্কে শাহনামায় বর্ণিত কাহিনিকে অবলম্বন করে পল্লবিত ভাষায় মশাররফ ‘তহমিনা’-র মধ্যে একটি রােমান্টিক প্রেম উপাখ্যান রচনা করেছেন।
‘রাজিয়া খাতুন’ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মীর মশাররফ হােসেন ১৩০৬ সালে (১৮৯৯ খ্রিঃ) ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র শেষ পৃষ্ঠায় যে বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন তাতে অন্যান্য পুস্তকের সঙ্গে ‘রাজিয়া খাতুন’-এর প্রকাশ সংবাদ প্রচালিত হয়েছিল।২৯ উক্ত বিজ্ঞাপন ছাড়া এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের অপর কোন সংবাদ আমাদের জানা নেই। মীর মশাররফ হােসেন কখনাে রচনার কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিজ্ঞাপন দিতেন এমন সংবাদ পাওয়া যায় ‘বিবি কুলসুম’ গ্রন্থে নাম রাখিলে, বিজ্ঞাপন দিলে, পুস্তকের খোঁজ নাই।৩০ কাজেই ‘রাজিয়া খাতুন’ পুস্তকাকারে বেরিয়েছিল একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় না। তবে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত মীর মশাররফ হােসেনের ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ‘রাজিয়া খাতুন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ লাভ করার সংবাদ পাওয়া যায়। ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ‘হিতকরী’ পত্রিকা আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “মীর সাহেবের ‘রাজিয়া খাতুন’ উপন্যাসটিও টাঙ্গাইলের এই ‘হিতকরী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল।৩১ অধ্যাপক আবদুল হাই ‘রাজিয়া খাতুন’-কে উপন্যাস শ্রেণিভুক্ত করলেও প্রকৃত পক্ষে এটি উপন্যাস কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহও প্রকাশ করেছেন।৩২ অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী রাজিয়া খাতুনকে উপন্যাস বলেই উল্লেখ করেছেন।৩৩ মশাররফ হােসেন রচিত ‘এসলামের জয়’ ইতিহাসও নয়, উপন্যাসও নয় ইসলামের শৈশবেতিহাসের কতকগুলাে ধারাবাহিক এবং বিচ্ছিন্ন কাহিনি নিয়ে রচিত আন্তরিকতাপূর্ণ আবেগময়-সন্দর্ভ। ইতিহাসের ঘটনা এর আখ্যান ভাগের মূল কথা তবু রচনার মননশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা এবং ভাবময়তা ‘এসলামের জয়’ রস-সন্দর্ভটিকে উপন্যাসের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ‘ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঢঙে’ লেখা রচনাটিতে ‘চরিত্র চিত্রনােপযােগী ঔপন্যাসিকের গভীর অন্তদৃষ্টি ও বিশ্লেষণী শক্তির প্রকাশ’ ঘটেছে। মদিনায় অবস্থানকালে হজরত মােহাম্মদের (সঃ) জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এর প্রধান শাখায় দশটি ‘মুকুল’-এ বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় শাখা’য় তেরােটি ‘মুকুল’-এ বিবৃত হয়েছে মক্কা বিজয় এবং তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ। হজরত মােহাম্মদের (সঃ) নেতৃত্বে ইসলামের বিজয় পতাকা কিভাবে একের পর এক রক্তাক্তা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত হলাে তারই ঘটনালেখ্য রচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। হজরত মােহাম্মদের (সঃ) কঠোর সাধনা ও অটলতা, চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও আদর্শে কেমন করে এই জয় সূচিত হলাে, সেই কাহিনিই রূপ লাভ করেছে এই গ্রন্থে। ‘এসলামের জয়’ প্রকাশিত হয় ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে। এসময়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলছে এবং তা রদ করবার জন্য বাংলাজোড়া তুমুল আন্দোলন চলছে। মীর সাহেব এই রাজনৈতিক ঝড়ঝক্কা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করলেও অবচেতন মনে স্বাধীনতার স্পৃহার কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে এই গ্রন্থে। মশাররফ হােসেন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ১৯ শতকের সত্তর দশকে, শেষ করেন বিশ শতকের প্রথম দশকে। ৪০ বছরে যুগ ও পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার মনােভাব ও চিন্তাজগতের পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে বাংলার মুসলিম সমাজের তখন সংকট এবং সংকট থেকে উত্তরণের কাল। উপন্যাসে তার ছাপ স্পষ্ট। উপন্যাস ছাড়া তিনি ধর্মভাব নিয়ে দশ খানা পুস্তক লিখেন যা তাঁর সমগ্র রচনার প্রায় ত্রিশ ভাগ। রূপকথা-পুরাকথাধর্মী গল্প ও ছােট ছােট নক্সা-প্রহসনের সংখ্যাও প্রায় ত্রিশ ভাগ। এই দুই শ্রেণির রচনা বাদ দিলে বাকী চল্লিশ ভাগ রচনা অথাৎ ১৪-১৫টি গ্রন্থের ভিত্তির উপরে মশাররফের প্রকৃত সাহিত্যকীর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার মানবপ্রীতি, স্বদেশপ্রীতি, জাতীয়তাবােধ, সমাজের হিতচিন্তা এসব রচনায় সহজ ঘূর্তি লাভ করেছে। উপসংহারে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে মশাররফের স্থান নির্দেশ করতে গিয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তার প্রতিতুলনা করে যে মন্তব্য করেছিলেন, ‘বিষাদ-সিন্ধু’র প্রোপটে মশাররফ হােসেনের মূল্যায়ন-প্রসঙ্গে সেই উক্তি বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সীতার বনবাস’ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যেমন এককালে পঠিত হইয়াছিল, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তেমনই আজও পর্যন্ত জাতীয় মহাকাব্যরূপে বাঙালী মুসলমানের ঘরে ঘরে পঠিত হয় বাংলা-সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্যকাব্যখানির সমান আদর।ৃতাহার সাহিত্য-প্রতিভা এমনই উচ্চশ্রেণীর ছিল যে, সুদূর অতীতের কারবালা-প্রান্তরের ট্রাজেডিকে তিনি সমগ্র বাংলাভাষাভাষীর ট্রাজেডি করিয়া তুলিতে পারিয়াছেন।”৩৪
তথ্যসূত্রঃ ১. মীর মশাররফ হােসেন, আমার জীবনী, দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যা- পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ.২৫৬। ২. মীর মশাররফ হােসেন, আমার জীবনী, দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যা- পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ২০০। ৩. মীর মশাররফ হােসেন, আমার জীবনী, দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যা- পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ২০০-২০১। 4. Calcutta Review, Vol.-1, No.-XCIX, 1870, P-235. ৫. রাজেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত, রহস্যসন্দর্ভ, ৫ম পর্ব, ৫৪ খ-, ১৮৭০, পৃ. ৯৫-৯৬। ৬. সুনীলকুমার মুখােপাধ্যায়স, মীর মশাররফ হােসেন ও তার প্রথম গ্রন্থ ‘রতœবতী’, সাহিত্য সমীক্ষা, ঢাকা, ১৯৭৬, পৃ. ৬৭। ৭. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-ভূমিকা, মীর মশাররফ হােসেন রচনা সংগ্রহ, ১খন্ড, বিষ্ণু বসু সম্পাদিত, কমলা সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ২৫।
৮. বঙ্গদর্শন, পৌষ ১২৮০। ৯. মশাররফ রচনা সম্ভার, প্রথম খ-, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৬, পৃ. ১০৫। ১০. বিনয় ঘােষ, সাময?িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ৪র্থ খ-, পাঠভবন, কলকাতা, পৃ. ৬৮৬-৮৭। ১১. এডুকেশন গেজেট, ১০ শ্রাবণ ১২৮০। ১২. মশাররফ রচনা সম্ভার, প্রথম খ-, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৬, পৃ. ২৫৫, ‘লিখকের কয়েকটি কথা দ্রষ্টব্য।
১৩. বান্ধব, আবিন ১২৮৩। ১৪. আনিসুজ্জামান, মীর মশাররফ হােসেন রচিত ‘এর উপায় কি?’, পা-ুলিপি, ৩ খ-, চট্টগ্রাম, ১২৮০, পৃ. ১৬৩। ১৫. ‘পুস্তক পরিচয়’, ‘প্রবাসী ভাদ্র ১৩২৭, পৃ.-৪৫৫। ১৬. অমৃতলাল বালা ও ঊষা রাণী সরকার, মশাররফ মানস ও বিষাদ-সিন্ধু, শােভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃ.-৪৮। ১৭. আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, প্রতিভাস, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ১৭০। ১৮. মশাররফ রচনা-সম্ভার, দ্বিতীয় খ-, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৪৮। ১৯. মশাররফ রচনা-সম্ভার, দ্বিতীয় খ-, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৬২। ২০. অনীক মাহমুদ, বাংলা উপন্যাসের চিত্তবৈভব ফিরে দেখা, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ৩৩।
২১. মুনীর চৌধুরী, মীর মানস, ২য় সংস্করণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ. ৪৭।
২২. গ্রামবার্তা প্রকাশিকা, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯২।
২৩. ভারতী, ফাল্গুন ১২৯৩।
২৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রতœবতী থেকে অগ্নিবীণাÍসমকালের দর্পণে, কলকাতা, পৃ. ৬৫।
২৫. কায়কোবাদ, মহরম শরীফ, ঢাকা, ১৩৭৭, নতুন সংস্করণ, কৈফিয়ত’ অংশ দ্রষ্টব্য, পৃ. ১০-১১।
২৬. কায়কোবাদ, মহরম শরীফ, ঢাকা, ১৩৭৭, নতুন সংস্করণ, কৈফিয়ত’ অংশ দ্রষ্টব্য, পূ, ১১, ১৫।
২৭. কায়কোবাদ, মহরম শরীফ, ঢাকা, ১৩৭৭, নতুন সংস্করণ, কৈফিয়ত’ অংশ দ্রষ্টব্য, পৃ. ৩০।
২৮. প্রদীপ ১৩০৮ উদ্ধৃত- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় সম্পাদিত, সাহিত্য সাধক চরিতমালা, দ্বিতীয় খ-, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩৭৭।
২৯. আবদুল লতিফ চৌধুরি, মীর মশাররফ হােসেন, সিলেট, ১৯৫২, পৃ. ১১, ২৭।
৩০. মশাররফ রচনা সম্ভার, ৫ম খ-, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৪৪৫।
৩১. আশরাফ সিদ্দিকি, হিতকরী, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৬০, পৃ. ২৬।
৩২. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলি আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ঢাকা বিধবিদ্যালয়, ১৯৫৬, পৃ. ৭৩।
৩৩. আশরাফ সিদ্দিকি, হিতকরী, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৬০, পৃ. ২৬।
৩৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, মীর মশাররফ হােসেন, সাহ্যিত সাধক চরিতমালা, ২য় খ-, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩৭৭, পৃ. ৪৫।
মশাররফ হােসেনের রচিত গ্রন্থ : কাব্য কবিতা :
১. গােরাই ব্রিজ অথবা গৌরী সেতু (কবিতা), জানুয়ারি ১৮৭৩। ২. সঙ্গীত লহরী (গান ও কবিতা), ১৮৮৭। ৩. পঞ্চনারী পদ্য (কবিতা), ১৮৯৯। ৪. মৌলুদ শরীফ (গদ্য-পদ্য), ১৯০৩। ৫. বিবি খােদেজার বিবাহ (কাব্য), মে ১৯০৫। ৬. হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (কাব্য), আগস্ট ১৯০৫। ৭. হযরত বেলালের জীবনী (কাব্য), নভেম্বর ১৯০৫। ৮. হযরত আমীর হামযার ধর্মজীবন লাভ (কাব্য), নভেম্বর ১৯০৫। ৯. মদিনার গৌরব, ১৯০৬। ১০. মােসলেম বীরত্ব (কাব্য), জুলাই ১৯০৭। ১১. বাজীমাত (কাব্য), ডিসেম্বর ১৯০৮১২. উপদেশ (কবিতা), ১৯০২।
প্রবন্ধ-গদ্য রচনা : ১৩. গাে জীবন (প্রবন্ধ), মার্চ ১৮৯৯। ১৪. সৎ প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ), ১৮৯৮। ১৫. প্যারী সুন্দরি, ১৯০৭। ১৬. হজরত ইউসােফ (প্রবন্ধ/গদ্য রচনা), ১৯০৮। ১৭. আমার জীবনী (১ম খ-, আত্মজীবনীমূলক গদ্য রচনা), ১৯০৮। ১৮, আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম জীবনী (প্রবন্ধ), ১৯১০। ১৯. গাজী মিয়ার গুলি (রসরচনা), ১৯০৯। ২০. মুসলমানের বিবাহ পদ্ধতি (প্রবন্ধ), ১৮৬৫। ২১. আমাদের শিক্ষা (প্রবন্ধ), ১৮৯০। ২২. প্রেম পারিজাত (গদ্য রচনা?), ১৮৯৯। ২৩. ইদের খােতবা (গদ্য রচনা), ১৯০৯।
উপন্যাস : ২৪. রতœবতী, সেপ্টেম্বর ১৮৬৯। ২৫. বিষাদ সিন্ধু (মহরম পর্ব-মে ১৮৮৫, উদ্ধার পর্ব-আগস্ট ১৮৮৭, এজিদ বধ পর্ব-মার্চ ১৮৯১)। ২৬. উদাসীন পথিকের মনের কথা, ১৮৯০। ২৭. তাহমিনা, ১৮৯৭। ২৮. রাজিয়া খাতুন, ১৮৯৯। ২৯. গাজী মিয়ার বস্তানী, ১৮৯৯। ৩০. এসলামের জয়, ১৯০৮।
প্রহসন : ৩১. এর উপায় কি? ১৮৭৬। ৩২. টালা অভিনয়, ১৮৯৭। ৩৩. ফঁস কাগজ, ১৮৯৯। ৩৪. ভাই ভাই এইত চাই, ১৮৯৯। ৩৫. একি? ১৮৯৯। ৩৬. বাঁধা খাতা, ১৮৯৯।
নকসা : ৩৭. নিয়তি কি অবনতি, ১৮৯৮।
নাটক : ৩৮. বসন্তকুমারী, ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩। ৩৯. জমীদার দর্পণ, মে ১৮৭৩। ৪০. বেহুলা গীতাভিনয় (যাত্রার ঢঙে রচিত নাটক বিশেষ), ১৮৮৯।
শিশু গ্রন্থ : ৪১. মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা (১ম ভাগ ও ২য় ভাগ স্কুল পাঠ্যপুস্তিকা হিসাবে রচিত), ১৯০৩ ও ১৯০৮ ৪২. মুসলমানের শিক্ষা, ২য় ভাগ, স্কুল পাঠ্যপুস্তিকা হিসাবে রচিত, মে ১৯০৮। ৪৩. বৃহৎ হীরক খনি।
সম্পাদিত পত্রিকা : ৪৪. আজিজন নাহার (সাপ্তাহিক / পাক্ষিক / মাসিক)। ৪৫. হিতকরী (পাক্ষিক), ১২৯৭-১২৯৯ বাংলা সন।
অন্যান্য : ৪৬. মহাজন সমাচার। ৪৭. চোরের উপর বাটপাড়ী। ৪৮. ওফাতে রসুল। ৪৯. শবে মেরাজ। ৫০. অ ক্কা সে ব বিবরণ।