ভারতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির খবরে দেশেও পেঁয়াজের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মাত্র তিনদিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। হুট করে এমন দাম বাড়ায় বাড়তি পেঁয়াজ কিনে মজুদ করেছেন ক্রেতারা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধ করলে দেশের বাজারে হু হু করে দাম বেড়ে পেঁয়াজের কেজি রেকর্ড ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে। এ কারণেই অজানা শঙ্কায় ক্রেতারা বাড়তি পেঁয়াজ কিনেছেন। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কথাতে তেমন আভাসই পাওয়া গেছে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়া শুরু হয়। এরপর শনি ও রোববার দুই দিনেই খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। প্রথম দফায় শুক্রবার কেজিতে পেঁয়াজের দাম বাড়ে ১০ টাকা। শনিবার বাড়ে ১৫ টাকা এবং রোববার কেজিতে আরও ৫ টাকা বাড়ে। তবে সোমবার নতুন করে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবারের আগে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০-৪৫ টাকা। যা শুক্রবার বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা হয়। শনিবার ও রোববার দাম বেড়ে তা এখন ৬৫-৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি শুক্রবারের আগে ছিল ২৫-৩০ টাকার মধ্যে। এখন তা ৬০ টাকা হয়েছে। পেঁয়াজের দামের বিষয়ে মালিবাগ হাজীপাড়া বৌ-বাজারের ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, গত বৃহস্পতিবারও দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ২৫ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু শুক্রবার শ্যামবাজারে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখি দাম বেড়েছে। দাম বাড়ায় পাঁচ বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে এসেছিলাম। ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করা ওই পেঁয়াজ শনিবার দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায়। ‘এরপর শনিবার শ্যামবাজারে গিয়ে দেখি পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছে। দাম আরও বাড়তে পারে সেই আশঙ্কায় ১০ বস্তা পেঁয়াজ এনেছি। কেজি বিক্রি করছি ৬০ টাকা। দাম বাড়ার কারণে মানুষ বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কিনছে। আট বস্তা পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেছে। আর দুই বস্তা আছে। আজই হয় তো এগুলো বিক্রি হয়ে যাবে’ বলেন জাহাঙ্গীর।
তিনি আরও বলেন, রোববারও (৬ সেপ্টেম্বর) পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। গতকাল যারা পেঁয়াজ এনেছে তারা ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করছে। আর বাছাই করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি করছে ৭০-৭৫ টাকা। আমার আগে কেনা তাই ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। রামপুরায় ৭০ টাকা কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করা কবির মোল্লা বলেন, দাম বাড়ার খবরে শনিবার ও রোববার পেঁয়াজ কেনার এক প্রকার হিড়িক পড়ে। দুই দিনে ১০ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। এর আগে দুই দিনে এতো বেশি পেঁয়াজ বিক্রি করিনি। তবে আজ বিক্রির পরিমাণ কম। আসলে যার যা মজুদ করার তা গত দুই দিনেই করে ফেলেছে। তিনি বলেন, হুট করে দাম বাড়ায় মানুষ ভয় পেয়েছে। কারণ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। আমরাই ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। এবারও সেই সেপ্টেম্বরে খবর ছড়িয়েছে ভারতে বৃষ্টিতে পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে এবং দাম বেড়েছে। এ কারণেই হয়তো আবার যেন গত বছরের পরিস্থিতির মুখে পড়তে না হয়, সে জন্য অনেকে বাড়তি পেঁয়াজ কিনেছেন। খিলগাঁওয়ে বাছাই করা দেশি পেঁয়াজ ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, গত বছর যেভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়া শুরু হয়েছিল এবারের লক্ষণও সেরকম। খুব দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আবার পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে কেজিতে ৩০ টাকা বেড়েছে। রামপুরা থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কেনা রাসেদুল হক বলেন, গত বছর পেঁয়াজ নিয়ে কম কা- হয়নি। আড়াইশ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। এবারও সেই পরিস্থিতি হবে কি না বলা মুশকিল। তাই অল্প কিছু পেঁয়াজ কিনে রাখছি। অবশ্য কিছুটা স্বস্তির খবর দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন। রোববার তিনি জাগো নিউজকে বলেছেন, আমরা পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। গতবারের মতো এবার পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই। এবার আমরা খুব সতর্ক। এছাড়া আগামী সপ্তাহ থেকে নতুন পেঁয়াজ না ওঠা পর্যন্ত খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করবে টিসিবি। আশা করি যেটুকু বেড়েছে দু-একদিনের মধ্যে সেটুকু কমে যাবে। টিসিবিসহ দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে।
ফিরে দেখা অতীত: গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধ করলে দেশের বাজারে হু হু করে বেড়ে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এরপর পেঁয়াজের দাম কমাতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালায় সরকার। মিয়ানমার, মিসর থেকে আমদানি করা হয় পেঁয়াজ। এতে কিছুটা দাম কমে। এরপরও পেঁয়াজের ঝাঁজ ছিল বেশ চড়া। একশ টাকার নিচে পেঁয়াজ মিল ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনতে হয় ক্রেতাদের। কম দামে নিম্ন আয়ের মানুষকে পেঁয়াজ দিতে ট্রাকে বিক্রি শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির পেঁয়াজ কেনা নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর থেকে বাজারে আসতে শুরু করে নতুন দেশি পেঁয়াজ। যার প্রভাবে ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলে। ডিসেম্বরেই নতুন পেঁয়াজের কেজি একশ টাকার নিচে নামে যায়। এরপর চলতি বছরের মার্চের শুরুতে রফতানি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। যার প্রভাবে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে ৪০ টাকায় নামে। কিন্তু মহামারি করোনার প্রকোপে মার্চের শেষ দিকে পেঁয়াজের দাম আবার কিছুটা বাড়ে। দাম বাড়ায় বাড়তি পেঁয়াজ কেনা শুরু করেন ক্রেতরা। এতে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকায় ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামে ভোক্তা অধিদফতর ও র্যাব। পেঁয়াজের বাজারে চলে একের পর এক অভিযান। এর মধ্যেই বাজারে বাড়তে থাকে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ। সঙ্গে আসতে থাকে ভারতের পেঁয়াজ। এতে আবারও দফায় দফায় দাম কমে পেঁয়াজের কেজি ৩০ টাকায় নেমে আসে। তবে ঈদের আগে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকায় উঠে। গত মাসেও আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ২০-২৫ টাকার মধ্যে ছিল। আর দেশি পেঁয়াজ ছিল ৪০-৪৫ টাকার মধ্যে।
পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে দুই উদ্যোগ: ভারতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির খবরে দেশে বাজারেও নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মাত্র তিনদিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি পেঁয়াজ আমদানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুল্কহার পুনর্র্নিধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রণালয়ের টাস্ক ফোর্স কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্ক ফোর্স কমিটির বৈঠকে দেশের চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় পর্যালোচনা করা হয়। পেঁয়াজের মজুত, আমদানি ও সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে, আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে।
সেখানে বলা হয়, পেঁয়াজের সংকট বা মূল্য বৃদ্ধির কোনো সঙ্গত কারণ নেই। পেঁয়াজের অবৈধ মজুত বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করা হলে সরকার আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করছে। পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিসিবি অবিলম্বে খোলা বাজারে ট্রাক সেলের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রয় শুরু করবে, নতুন পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখবে। এছাড়া, পেঁয়াজ আমদানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুল্কহার পুনর্র্নিধারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং আইপি ও কোয়ারেন্টাইন বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা করে দেশব্যাপী বাজার মনিটরিং জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্ক ফোর্স কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন- কমিটির সভাপতি এবং বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। সভায় উপস্থিত ছিলেন- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মো. ওবায়দুল আজম, অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) মো. হাফিজুর রহমান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসানসহ টাস্ক ফোর্স কমিটির সদস্যরা।