বর্তমান এক ভয়ানক সময়ে পৃথিবীর বুকে বাস করছি আমরা, যখন তাতে পচন ধরেছে। ক্ষয় ও লয় হতে চলেছে তার তাবৎ সভ্যতা। কোথাও মানবতার কোনো বালাই নেই। ন্যায় ইনসাফ সুবিচার পাওয়ার আশা করা অনেকটাই অলীক স্বপ্নের মতো। নির্যাতন-নিপীড়নের করুণ দৃশ্য এখন আর করুণ মনে হয় না। দুর্বলের ওপর সবলের আক্রমণ গরিবের প্রতি ধনীর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি, সাদা-কালোর ভেদাভেদ এখনকার অভ্যাসপ্রসূত নিত্যদিনের আচরণ বললেও ভুল হবে না। এতিমের মাল ইচ্ছেমতো অন্যায়ভাবে খাওয়া হচ্ছে আজকাল। দরজা থেকে ভিক্ষুককে তাড়িয়ে দেয়া তো কোনো বিষয়ই নয়। মিথ্যার জালে বন্দী করে কত সত্যবাদীকে অসৎ উপায়ে ফাঁসানো হয়েছে তার কি কোনো হিসাব আছে? এক কথায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর জয়জয়কার চতুরপ্রান্তে। গিবত, শেকায়েত হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, অরাজকতা, স্বজনপ্রীতি, গোত্র-সঙ্ঘাত, জুয়া খেলা, মদপান, দেবপূজা, ইন্দ্রীয় পূজা, প্রবৃত্তি পূজা, সন্ত্রাসী, সুদ-ঘুষ, চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি, সিন্ডিকেট ইত্যাদি হীন কোনো অপরাধ নেই যা ঘটছে না এ যুগে।
আরেকটু শক্ত করে বললে, আজকের কুরুচিপূর্ণ এই খারাপ বিষয়গুলো তুলনা করা যায় বর্বর সেই জাহেলি যুগের খারাপির সাথে। কেউ কেউ তো এ কালকে আরো নিকৃষ্ট বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। সত্যি বলতে আমাকেও তাদের সাথে একমত পোষণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া যে উপায় নেই। ঘুণে ধরা রুগ্ন এই পৃথিবীকে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রয়োজন যুব সম্প্রদায়কে সবল ও সুস্থ করে তোলা। যার সর্বোত্তম মডেল ও আদর্শ হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব খাতামুন্নাবিয়্যিন, শান্তির অগ্রদূত, মুক্তির চূড়ান্ত সমাধান হজরত মুহাম্মদ সা:।
ঈসা আ:-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়ার পর থেকে আমাদের নবী সা:-এর ধরিত্রীতে আগমনের মধ্যবর্তী প্রায় ৬০০ বছরে গোটা পৃথিবী কতটা অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল কমবেশি সবারই জানা। তখনকার অগ্নিপূজক, মূর্তিপূজক কাফেরদের সীমাহীন অসভ্যতা অভিশপ্ত শয়তানকেও হার মানিয়েছিল। কী পরিমাণ উন্মাদ হলে আপন মেয়েসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া যায়! নিজের মায়ের সাথে জিনায় লিপ্ত হওয়া যায়! তা কি মাথায় ধরে? আল্লাহ তায়ালা হেফাজত করুক তা থেকে। ঠিক তখন, আগমন করেছিলেন দয়ার নবী মানবতার ফেরিওয়ালা প্রিয় নবী সা: মাত্র ২৩ বছরে কলুষিত বর্বর সমাজব্যবস্থাকে সভ্য সমাজব্যবস্থার রূপ দিয়েছিলেন। এঁকেছিলেন নতুন নকশা। নিপীড়িত-অত্যাচারিত জাতিকে চরিত্র ও সভ্যতার সর্বোচ্চ আদর্শে উন্নীত করেছিলেন।
অশালীন, অভদ্র, গর্হিত কর্মের ধারক-বাহক যুবসমাজকে শালীন, ভদ্র ও সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন তিনি। একসময় যারা ইসলামের বিরুদ্ধে জীবনের সবটুকু দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকত প্রিয় এই নবীর সুশৃঙ্খল শুভ পরশে এখন তারা ইসলামের পক্ষে নিজেদের বিলীন করে দেয়ার জন্য মরিয়া। দুনিয়ায় থেকে পরকালের জন্য কাজ করে জান্নাত প্রাপ্তিই একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হওয়া উচিত- এই বাস্তব উপলব্ধির বীজ তাদের হৃদয়ে বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। খুঁটে খুঁটে প্রতিটি অনিয়মকে তিনি নিয়মের আওতায় এনেছিলেন। অন্যায়ে আপসহীন ছিলেন সবসময়। ইসলামের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নে কোনো বাধাকে পাত্তা দেননি কখনো। এমনকি এক হাতে সূর্য আর অপর হাতে চন্দ্র এনে দিলেও হকের মিশন প্রতিষ্ঠা থেকে একচুল পিছিয়ে থাকতে পারবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অপরাধের শাস্তি প্রয়োগে বাছ-বিচারের কোনো নজির নেই তাঁর জীবন ইতিহাসে। ‘অন্যের বেলায় ষোলআনা আর নিজের বেলায় বারআনা’- এমন কল্পনা করাও ভুল ছিল তাঁর বিচারালয়ে।
হজরত আয়শা রা: থেকে বর্ণিত- এক হাদিসে এসেছে, নবী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে। কারণ, তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত কেউ চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত, পক্ষান্তরে দুর্বল অসহায় কেউ চুরি করলে তারা তার ওপর হদ প্রয়োগ করত। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, মুহাম্মদের বেটি ফাতেমাও যদি চুরি করে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দেবো’ (বুখারি-মুসলিম)। সেই সময়কার কাফির-মুশরিকরাও তাঁর কাছে সম্পদ আমানত রাখা সম্পত্তির জন্য নিরাপত্তার উপায় মনে করত। আল-আমিন ও সত্যবাদী অভিধায় ভূষিত করার কাহিনী তো সবারই জানা। যুদ্ধজয়ী হালতে প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যাপক ক্ষমা ঘোষণার দৃষ্টান্ত তাঁর আগে-পরে কেউ দেখাতে পেরেছে কি? একরকম হাজারো উদাহরণ পেশ করা যাবে।
অতএব, অধুনা মনুষ্যত্ববিবর্জিত অধঃপতিত জাতির গ্লানিকর পাশবিক কর্মকা- বন্ধ করা ও বিভীষিকাময় তপ্তশোকার্ত বিশ্বের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রিয় নবীর আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,‘বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করে’ (সূরা আহজাব-২১)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সর্বকাজে সব সময় রাসূল সা:-এর আদর্শকে অনুসরণ-অনুকরণ ও অনুশীলন করার তাওফিক দান করুন, আমীন। লেখক : প্রাবন্ধিক