কথা দিয়ে মানুষ তার ব্যক্তিত্ব ও আদর্শকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। প্রকাশ পায় তার আসল মানসিকতার। আবার এই কথার মাধ্যমেই মানুষ পৌঁছে যেতে পারে জান্নাতে। এই কথার যখন সঠিক ব্যবহার করা না হয় এটি তার জাহান্নামের কারণও হতে পারে। তাই কথা বলার সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়।
এখানে ক্ষুদ্র পরিসরে ইসলামী রীতি মোতাবেক আকর্ষণীয় কথা বলার কিছু কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। এই নিয়ম অনুযায়ী মানুষ কথা বললে অবশ্যই তার কথা গ্রহণযোগ্য হবে। মহানবী সা:-এর কথা ও বাচনভঙ্গির আলোকেই এই নিয়মগুলো প্রণীত।
কথার সাথে বাস্তবতার মিল : ব্যক্তি যখন কথা বলবে সে কথাগুলোর সাথে যেন তার বাস্তবিক জীবন আচরণের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যক্তির প্রায়োগিক জীবনের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় সত্যের একটি প্রভাব মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। যা সহজে অন্যকে আকৃষ্ট করে।
শৈশবকাল থেকে মহানবী সা: মিথ্যা না বলার কারণে মানুষের কাছে সত্যবাদী হিসেবে তাঁর একটা খ্যাতি ছিল। তাই তিনি যখন ইসলামের দাওয়াত দেন আরববাসী খুব সহজেই তা সত্য বলে গ্রহণ করে। তারা বিশ^াস করতেন, মহানবী সা: কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। তাঁর আনীত বাণীও মিথ্যা হতে পারে না। তারপরও কিছু লোক তার চরম বিরোধিতা করেছে। এর কারণ, তাঁর কথার বিশ^াসযোগ্যতার কমতির জন্য নয়; বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও অন্ধ ধ্যান-ধারণার জন্য।
যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা অনেক। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য কথা বলা মানুষকে ভালো কাজের পথ দেখায় আর ভালো কাজ জান্নাতের পথ দেখায়। আর যখন মানুষ সত্য কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। অন্য দিকে, মিথ্যা পাপের পথ দেখায় আর পাপ জাহান্নামের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি যখন মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয় (বুখারি)।
কথা হবে সুস্পষ্ট : যখন কথা বলা হবে তখন কথা বলতে হবে স্পষ্ট ভাষায়। যেন শ্র্রোতার বুঝতে কোনো সমস্যা না হয়। অকারণে কঠিন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। যথাসম্ভব প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতে হবে। যখন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা হয় তার প্রভাব শ্রোতার ওপর খুব বেশি পড়ে। মহানবী সা:-এর কথা এত স্পষ্ট ছিল, যেকোনো শ্রোতা তার কথা শুনলে বুঝতে পারত।
অযথা তাড়াহুড়ো না করা : কথা বলতে হবে ধীরস্থিরভাবে। কথা বলার সময় যদি তাড়াহুড়ো করা হয় তাহলে শ্রোতা ওই কথা বুঝতে পারে না। ফলে বক্তা যে উদ্দেশ্যে কথা বলছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। মহানবী সা: যখন কথা বলতেন এমনভাবে কথা বলতেন যদি কোনো শ্রোতা মনে করত তিনি কয়টি কথা বলেছেন আমি তা গণনা করে রাখব, চাইলে সে তা পারত। আবার এক কথা থেকে অন্য কথার মধ্যে বেশি বিলম্ব করাও ঠিক নয়। তাতে শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখা যায় না।
কর্কশ ও রূঢ় ভাষা পরিহার : কথা বলার সময় বক্তার আচরণে কোমলতার স্পর্শ থাকবে। শব্দ বা বাক্য চয়নের ক্ষেত্রে এমন সব শব্দ বেছে নিতে হবে যে শব্দ বা বাক্যের মাধুর্য ও প্রাঞ্জলতা শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। একজন ভালো বক্তা মাত্রই জানেন শব্দ বা বাক্যেরও স্বকীয়তা ও ভাবগাম্ভীর্য রয়েছে যা বক্তার কথাকে শ্রোতার কাছে গুরুত্ববহ করে তোলে। মহানবী সা: যখন কথা বলতেন, কর্কশ ও রূঢ় ভাষা পরিহার করে সুমিষ্ঠ ভাষায় কথা বলতেন। কাউকে সম্বোধন করলেও এমনভাবে সম্বোধন করতেন সেই শ্রোতা তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। পবিত্র আল-কুরআনে তাই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি যদি কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে মানুষ আপনার থেকে দূরে চলে যেত’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৫৯)।
বাহুল্য বর্জন করা : শ্রোতাকে মুগ্ধ করতে হলে বক্তাকে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে শ্রোতার কাছে বক্তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। রাসূলে করিম সা: যখন কথা বলতেন অপ্রয়োজনীয় বিষয় তাঁর কথায় স্থান পেত না। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত মহানবী সা: বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলাম পালনের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অনর্থক কথা ও কাজ পরিত্যাগ করা’ (তিরমিজি)।
শালীনতা বজায় রাখা : কথা বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে পড়ি। তখন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারি না। ফলে কথার মধ্যে অশালীন শব্দ ও ভাষা প্রয়োগ করে থাকি। একজন কথক যখন কথা বলবেন শ্রোতাকে তার মুগ্ধ করতে হলে কোনোক্রমেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না; বরং তাকে শালীনতা বজায় রেখেই মার্জিত ও রুচিসম্মত ভাষায় কথা বলতে হবে। মহানবী সা: কখনো অশালীন কথা বলেননি। এমনকি তিনি কাউকে অভিশাপ ও গালিগালাজও করতেন না। কাউকে তিরস্কার করার সময় শুধু এটুকু বলতেন, ‘তার কপাল ধূলিমলিন হোক।’
বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা : কথা বলার সময় বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। যথাসম্ভব আ লিকতা পরিহার করতে হবে। মহানবী সা:-এর উচ্চারণ, শব্দ প্রয়োগ ও বাচনভঙ্গি সবই ছিল বিশুদ্ধ ভাষায়। একজন ভালো কথককে অবশ্যই ভাষা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হবে।
কথা হবে পরিমিত : একজন কথকের কথা শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় হতে হলে তা যেমন খুব দীর্ঘ হবে না তেমনি খুব সংক্ষিপ্তও হবে না। তার কথাগুলো এমন হতে হবে তিনি যা শ্রোতাকে বোঝাতে চান স্বল্প ও পরিমিত শব্দ ও বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিকভাবে তা বোঝাতে পারেন।
শ্রোতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা : কথা বলার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, আমার কথায় যেন শ্রোতা নিজেকে ছোট না ভাবেন। অর্থাৎ শ্রোতার প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলতে হবে। এটি শ্রোতাকে মুগ্ধ করার সুন্দর একটি কৌশল। মানুষকে অসম্মান করা, তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা প্রিয় নবীর আদর্শের পরিপন্থী। তেমনিভাবে মানুষের সাথে কঠোর ভাষায় কথা বলা ইসলামের সুমহান নীতি ও আদর্শের বিরোধী। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক