মৌলভীবাজারের শ্রীঙ্গলে বহুল আলোচিত স্কুল ছাত্র ফাহাদ হত্যার ঘটনায় শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে পুলিশের দায়সারা তদন্তের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ফাহাদ রহমান মারজান এর পিতা, মৌলভীবাজার জেলা দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. ফজলুর রহমান। বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় শহরের ভানুগাছ রোডস্থ টি ভ্যালী রেস্টুরেন্ট এর দ্বিতীয় তলায় এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে ফাহাদের ছোট ভাই ফারদিন রহমান, মো. সালমান ছোট বোন নুসরাত জাহান জেনিফা, চাচা ইমাদ আলী ও মুছাব্বির আল মাসুদ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মো. ফজলুর রহমান বলেন, আমার সন্তান ফাহাদ হত্যার ঘটনায় দুই মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত রেলওয়ে পুলিশ হত্যার রহস্য উৎঘাটন করে খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ ঘটনার প্রথম দিকে কিছুটা তৎপর হলেও পোস্ট মোর্টেম রিপোর্টের ভিত্তিতে এখনও হত্যা মামলা হিসেবে এফআইআর করে নাই, বরং তদন্তের নামে তারা সময় ক্ষেপণ করছেন। আমরা জানতে পারি সিডিআর রিপোর্টের পর তদন্ত কর্মকর্তা ও এবং রেলওয়ে ওসি তাদের প্রকাশিত আসামীদের সাথে যোগ সাজস করে আর্থিকলেনদেন করেছেন। ফলে তারা ফাহাদ হত্যার প্রকৃত সত্য জানার পরও একটি হত্যাকান্ডকে অপমৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দেয়ার জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ কারণে আমি তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোল্লা সেলিমুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তসহ শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার তদন্ত কর্মকর্তার প্রতি অনাস্থা থেকে এই মামলার তদন্তভার পিবিআই, সিআইডি বা র?্যাবের মতো সংস্থার কাছে হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে আমি আমার সন্তান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে খুনিদের গ্রেফতার ও সুষ্ঠু বিচারের দাবি করছি। লিখিত বক্তব্যে ফাহাদ রহমান মারজান এর পিতা আরো বলেন, গত ১২ অক্টোবর আমার ছেলেকে শাহীবাগ রেল লাইনের পাশে কে বা কাহারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ফেলে রাখে। পরে একটি মহল আমার ছেলে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে বলে অপপ্রচার চালায়। এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর ২০২২ইং শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়। মামলা নং-২৫/২২। আমার ছেলের মৃতু্যুর কয়েকদিন পূর্বে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার মায়ের নিকট ফোন করে ফাহাদকে সাবধানে চলাফেরা করার জন্য সতর্ক করেন। ওই সময় ফাহাদের এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। মৃত্যুর দিনও তার প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা ছিল।
কিন্তু এই দিন ১২ অক্টোবর ভোর রাতে আমাদের অজ্ঞাতেকে বা কাহারা তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে সকাল ৯ টার দিকে রেলওয়ে থানা পুলিশ ফোন করে জানান ফাহাদ গুরুত্বর অসুস্থ, সে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেেছ। আমরা সেখানে গিয়ে ফাহাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পাই। আমরা জানতে পারি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত ফাহাদকে রেল লাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সুরতহাল রিপোর্টে মৃত দেহের মাথার বাম পাশে ৬ বাই ২ ইঞ্চি একাধিক কাটা জখম, কপালে একটি ৩ বাই ১ ইঞ্চি কাটা জখমের কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া সুরতহাল প্রতিবেদনে পিঠে ২ বাই ৩ ইঞ্চি ছেছড়া দাগ রয়েছে। বাম পায়ের হাটুর নীচে হালকা কাটা দাগ, বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে হালকা কাটা দাগ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতের সময় থেকে রেল পুলিশের ভূমিকা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হতে থাকে। ওই সময় রেল পুলিশের এসআই ও মামলা তদন্ত কর্মকর্তা মোল্লা সেলিমুজ্জামান একটি কাগজে ফাহাদ ১ দিন আগে বাড়ি থেকে নিখোজ ও ট্রেনে কাটা পড়েছে মর্মে স্বাক্ষর নিতে পীড়াাপিড় করেন। তদন্তের আগেই পুলিশ কিভাবে নিশ্চিত হলেন আমার ছেলে ট্রেনে কাটা পড়েছে? এ ছাড়া আমার ছেলে সেদিন ভোরে বাসা থেকে বের হয়। ১ দিন পুর্বে বের হওয়ার তথ্য দেয়ায় আমি ওই কাগজে স্বাক্ষর করিনি। পুলিশের এই আচরণ আমার সন্দেহজনক মনে হলে পরদিন রেলওয়ে থানায় আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে একটি লিখিত আবেদন করি। গত ২৩ অক্টোবর ২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৩-৪ জনকে আসামী করে মৌলভীবাজার সিনিয়র জুডিসিয়্যাল মেজিস্ট্রেট ২নং আমল আদালতে সিআর মোকদ্দমা নং ৫১৫/২০২২ দায়ের করি। মাননীয় আদালত রেলওয়ে পুলিশকে ৪৮ ঘন্টার ভেতর ঘটনার আলোপাত্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। রেল পুলিশ আমার অভিযোগ আমলে নেয়নি। এরপর আমি, আমার ভাই ইমাদ আলী, দৈনিক যুগান্তরের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি সৈয়দ সালাউদ্দিনসহ আমাদের ব্যক্তিগত তদন্তের তথ্য উপাত্ত ওসি সাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোল্লা সেলিমুজ্জামানের নিকট সরবরাহ করি। এসময় পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয় বলেন, আমরা সিডিআর (মোবাইল ফোনের কল লিস্ট) ও পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট আসার পর তদন্ত কাজ শুরু করবো বলে জানান। দ্রুত সময়ে ২২টি মোবাইল ফোন নাম্বারের সিডিআর সংগ্রহের জন্য এসআই মোল্লা সেলিমুজ্জামান আমাদের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ফি গ্রহণ করেন। সিডিআর রিপোর্ট আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের ডেকে নিয়ে বলেন, ফাহাদের সহপাঠী মুন্না, টিআরজি মাহিন, রাব্বি,ডিজে ইরফান, ফুয়াদ, মান্না, মুরাদ, তানভীর, শাহরুখ, তানজিল, ইফতি, আরাফাত,সুমন, জুম্মন, জাহিদ ডনসহ আরো কয়েকজন মিলে ফাহাদকে হত্যা করে। তিনি বলেন, “সিডিআর রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, শহরের সোনা মিয়া রোড লুৎফা এলাহী কমপ্লেক্সে (এহসান করিম মঞ্জিল) তারা সবাই একত্র হয়ে মাস্টার প্ল্যান করে ফাহাদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট আসার পর অপমৃত্যু মামলাকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করে সব আসামীদের ধরে প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন করা হবে বলে তিনি জানান। ঘটনার ১ মাসের মধ্যে পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট চলে আসে। রিপোর্টে মাথায় আঘাতজনিত ও মস্তিষ্কে জমাট রক্ত বাধার কারণে মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ করা হয়। এতে কপালে ২টি ও পায়ের তলায় আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট আনার পরপরই রেলওয়ে থানার ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তা ট্রেনের আঘাতে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অপমৃত্যু মামলার প্রতিবেদন দেবেন বলে জানান। পরক্ষণে আমরা সাংবাদিক সালাউদ্দিনকে নিয়ে রেলের বদি ও তদন্ত কর্মকর্তার সাথে পোস্ট মোর্টেম রিপোর্টের বিষয়ে কথা বলি। এসময় সাংবাদিক যুক্তি দেখান-তিনি এ পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর সাথে কথা বলেছেন। ওই আইনজীবী রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন, পোস্ট মোর্টেম রিপোর্টে আঘাতের কথা উল্লেক থাকলেও ট্রেন না মানুষের দ্বারা আঘাতের সৃষ্ট তার কোন উল্লেখ নেই। এখন পুলিশের দায়িত্ব এটা বের করা যে, আঘাতগুলো মানুষের না ট্রেনের সৃষ্ট। এছাড়াা আরো ৩টি আঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। যদি ট্রেন আঘাত করতো তাহলে ফাহাদের মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত বলে অভিমত ওই আইনজীবীর। তদন্তে কোন ব্যাত্যয় ঘটলে আপনারাও আসামী হতে পারেন বলে সাংবাদিক ভাই তাদের জানান।
সময়ে রেল বিভাগের ডিআইজি ও এসপি মহোদয়ের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করি। তারা সঠিকভাবে ফাহাদ মৃত্যুর তদন্ত পরিচালনা করতে নির্দেশ দেন। এখানে উল্লেখ্য, ঘটনার দিন সকাল অনুমানিক ৬টা ৭ মিনিটে দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী লোকাল ট্রেন সুরমা মেইল এর চালক জাহিদুল ইসলাম যুগান্তরের সাংবাদিকসহ অন্যদের জানান, শ্রীমঙ্গলে রেল স্টেশন সামনে থাকায় ঘটনাস্থলে ট্রেনের গতি স্বাভাবিকভাবে কমিয়ে আনা হয়। তিনি নিশ্চিত করে বলেন, সেখানে কোন ব্যক্তির সাথে ট্রেনের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটেনি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আনিত এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোল্লা সেলিমুজ্জামান গণমাধ্যকর্মীকে আসামীদের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে মামলার তদন্ত চলছে বলে লাইন কেটে দেন। রেলওয়ে থানার ওসি সাফিউল ইসলাম পাটোয়ারীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এসআই সাব্বির নামে এক কর্মকর্তা জানান, তিনি (ওসি) অভিযানে রয়েছেন। ফাহাদ মৃত্যুর তদন্তে পুলিশ কর্মকর্তার অনিয়ম ও অনাস্থার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলওয়ের ডিআইজি জয়দেব ভদ্র গণমাধ্যমকর্মীকে জানান, বিষয়টির খোঁজ নিয়ে সিলেট জোনের এসপিকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হবে। সংবাদ সম্মেলনে ফাহাদের পিতা ফজলুর রহমান সন্তান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।