বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার ৭৫ বছর। এবারের বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য‘Dignit, Freedom and Justice for All. And up 4 Human Rights.’ বিশ্বে ৩৬০ ভাষায় অনুবাদকৃত দলিল হিসেবে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করার জীবন্ত দলিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য দুর্নীতিমুক্ত অর্থবহ ও কার্যকর কর ধার্য, আদায় ও এর পরিধি বাড়ানো। নিজ সম্পদের দেশজ চিন্তায় দেশীয়তা বজায় রাখা। আন্তর্জাতিক মানদ-ে মানবাধিকার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
ইতোমধ্যে একটি বৈশ্বিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এক. জবাবদিহি, দুই. স্বচ্ছতা, তিন. অংশগ্রহণ, চার. আইনের শাসন, পাঁচ. দায়িত্বশীলতা, ছয়. কার্যকারিতা এবং পারঙ্গমতা, সাত. স্বাধীনতা, অধিকার ও সমতা, আট. ঐকমত্য, নয়. কৌশলগত রূপকল্প।
২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর কানাডার টরন্টোতে টরন্টো ওম্বাডসম্যান মিজ ফিওনা ক্রিন আয়োজনে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে আমার অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আলোচনায় কানাডার শিক্ষার অধিকার নিয়ে মূল বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে পরিবেশ, ক্লাসরুম, বইখাতা, যাতায়াত, খাওয়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা আরও কীভাবে উত্তম করা যায়। পাশে একটি প্রদর্শনীর জন্য সমৃদ্ধ স্টলও ছিল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আমি তুলে ধরেছিলাম কয়েকটি দিকনির্দেশনা। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ব্যানার হলেও আমাদের দেশে দরিদ্রতার জন্য শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। বই, পোশাক কিনতে পারে না, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষার হার, মান বৈষম্য, স্কুল ভবন, মাঠ ইত্যাদি অপ্রতুল। সেখানে মৌলিক অধিকার পূরণই মানবাধিকার। ধনী দেশের মানবাধিকার আর উন্নয়নশীল দেশের মানবাধিকার সমতালে আসবে না, যদিও ব্যানার একই।
২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট আমাদের দেশে পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী প্রতীক ছিল চুড়ি, চকোলেট, পুতুল, ফ্রগ, কাঁচি, ভ্যানিটি ব্যাগ, হারমোনিয়াম, মৌমাছি, আঙ্গুর, গ্যাসের চুলা। নির্বাচনে প্রতীকের ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের প্রতীক বলে কোনো বিশেষ ব্যাপার থাকতে পারে না। এতে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং সংবিধান গ্রহণ করে না। নির্বাচন কমিশনকে লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত করতে হবে। তাহলেই ‘ভোটের অধিকার, মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার পথ পাবে। এই দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য‘এই পৃথিবীতে কখনো কোনো ব্যক্তি তথা রাষ্ট্র যে কোনো ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যদি অন্যের ক্ষতিসাধন করে থাকে, সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।’ প্রায় প্রতিবছরই একই ধরনের বক্তব্যের ডালি নিয়ে আসে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকার বক্তব্যে নয়, একে এগিয়ে নেওয়া, আদায় ও প্রাপ্তি অনুশীলনই আজকের কাজ। তাহলেই স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের স্বাধীনতা প্রস্ফুটিত হবে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দলিলের ন্যায্যতা সাম্যতা সৃষ্টি হলেই মর্যাদা স্থাপিত হয়। বৈষম্য দূরীকরণে ২০ বছর দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হিসেবে বটমলাইনিং মা কেন্দ্রিক মাতৃত্বকালীন ভাতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, পরিবেশসহ ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’-এর ৬টি মৌলিক অধিকার সূচকগুলো ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক ১০টি উপজেলায় পাইলট আকারে অনুশীলনকৃত সফল বাস্তবায়ন হয়েছে, যা সারা দেশে কার্যকারিতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে এটি বাস্তবায়নে প্রতিবছর ৫ লাখ মাকে এনে এক প্রজন্ম ২০ বছর মেয়াদে সর্বমোট ১ কোটি গরিব মাকে টার্গেট করে সামাজিক নিরাপত্তা বিনিয়োগ খাতে বাজেট বরাদ্দ রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বর্তমান সরকার প্রায় ১২ লাখ গরিব মাকে মাতৃত্ব ভাতা দিচ্ছে, যা নারীর প্রজনন অধিকারের বিশাল স্বীকৃতি। যেই বিনিয়োগে লাভ ছাড়া লোকসান নেই। এতে এসডিজি ১নং এজেন্ডার দারিদ্র্য বিমোচন, ১০নং এজেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ এবং ১৬নং এজেন্ডায় শান্তি ও ন্যায্যতার কার্যকারিতা বৈষম্য কমানোর ভিত তৈরি হবে। নতুবা প্রতিবছর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এ ধরনের সুন্দর সুন্দর ডাক আসতে থাকবে, আনুষ্ঠানিকতা চলতেই থাকবে। শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিতরা বৈষম্যের খপ্পরে আটকেই থাকবে, বেড়িয়ে আসার শুধু হাতছানিই থাকবে, মুক্তির পথ আসবে না। লেখক : গুসি শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, প্রতিষ্ঠাতা ডরপ