সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ অপরাহ্ন

বন্ধুত্বের মূলনীতি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মো: হাসিম আলী:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২

‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’ শব্দদ্বয় আকারে ছোট্ট হলে এগুলোর উচ্চতা গগনচুম্বী, গভীরতা অতলস্পর্শী, ব্যাপ্তি বিশ্বময় এবং অনুরণন হৃদয় থেকে হৃদয়ে। ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’ সমার্থ শব্দ হলো ভ্রাতৃত্ব, প্রেম, হৃদ্যতা, সখ্য ইত্যাদি। শব্দদ্বয়ের আরবি প্রতিশব্দ হলো- ‘বেলায়াত’, ‘উখুওয়াত’ ‘মুওয়াদ্দাত’, ‘খুল্লাতুন’ ‘মুহাব্বত’ ‘হুব্বুন’ ইত্যাদি। অভিধানে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাকে সমার্থ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা উভয়টির উৎস স্বয়ং স্র্রষ্টা এবং ভিত্তি হলো বিশ^াস।
পরিভাষায় একাধিক মানুষের গভীর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। অন্য কথায়, দু’জনের গভীর আত্মিক সম্পর্কের অপর নাম বন্ধুত্ব। ভালোবাসার সংজ্ঞায় বলা হয়- মনঃপূত বস্তুর প্রতি হৃদয়ের আকর্ষণ। অন্যকথায়, কোনো কিছুর মধ্যে কোনো যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে তার প্রতি মনের আকর্ষণকে ভালোবাসা বলে। ভালোবাসার একান্ত দাবি হলো- যাকে ভালোবাসা হয় তার মনের চাহিদা অনুযায়ী চলা।
ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা এক অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত। কারণ বন্ধুত্ব ছাড়া ভালোবাসা হয় না, আবার ভালোবাসার স্পর্শহীন বন্ধুত্বও অস্তিত্বহীন।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার গুরুত্ব
সহজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য : জগতে জীবন মাত্রই ভালো লাগা আছে, ভালোবাসা আছে। অন্যান্য জীবে বা জড়ে স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধি না থাকলেও তাদের পরস্পরের আচরণে ভালোবাসা সুস্পষ্ট। গবেষণার দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায়, সব কিছুর মধ্যেই ভালোবাসা নামক আকর্ষণ রয়েছে। মধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণে আসমান-জমিনকে স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। ভালোবাসার টানেই নদী ছুটে যায় সাগর পানে। আহ্নিক গতি হয়, জোয়ার-ভাটা হয়। পাখিরা গান গায়, ফুলেরা সৌরভ ছড়ায়। প্রজাপতি ছুটে চলে। জলপ্রপাত বয়ে যায়। ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর সব কিছু চলমান, বহমান ও আবর্তিত।
স্র্রষ্টার সেরা দান : ভালোবাসা আল্লাহর সেরা দান। তিনি যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন সে ব্যক্তির ভালোবাসা মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন। মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা থেকে ভালোবাসা, দয়া, মায়ার শিক্ষা লাভ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর ১০০টি রহমত আছে, যার মধ্য থেকে মাত্র একটি রহমত তিনি জিন, মানব, পশু ও কীটপতঙ্গের মধ্যে অবতীর্ণ করেছেন। ওই এক ভাগের কারণেই হিংস্র্র জন্তু তার সন্তানকে মায়া করে থাকে… (মুসলিম)।
অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক : ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো অবিচ্ছেদ্য ও চিরন্তন। মৃত্যুর পরও এ সম্পর্ক জারি থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই যাকে ভালোবাসে সে তার সাথী হবে’ (সহিহ বুখারি)।
বন্ধুত্বের পরকালীন প্রতিদান : হাদিসের বর্ণনা মোতাবেক যে সাত শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার ওপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার ওপরই চিরবচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয় (সহিহ বুখারি)।বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর মহান গুণ : কুরআন মাজিদ ও হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ কর্তৃক ভালোবাসার কথা উল্লেখ আছে। যেমন তিনি বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা বাকারাহ-১৯৫)।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর নিয়ামত : ‘আর তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অমূল্য সম্পদ : ‘তিনি তাদের অন্তরসমূহে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহব্বত পয়দা করে দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল আনফাল-৬৩)।
আল্লাহর ভালোবাসা লাভের মাধ্যম : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা মহব্বত করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা উপবেশন করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা খরচ করে এবং আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা পরিদর্শন করে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য ওয়াজিব (আবশ্যক) হয়ে গেছে’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)। আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্তির উপায় : হাদিসে কুদসিতে এসেছে- আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি পৃথিবীর অধিবাসীদের শাস্তি দিতে মনস্থ করি। অতঃপর যখন আমি আমার ঘর আবাদকারী, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের বন্ধুত্ব বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি ও অতি প্রত্যুষে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন আমি তাদের ওপর থেকে সেই শাস্তি সরিয়ে নিই (আমি নিবৃত্ত হই)’ (বায়হাকি)।
ভালোবাসা ঈমানের পূর্ণতার শর্ত : ভালোবাসার মাধ্যমে ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। যেমন আবু উমামাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়ে থাকে সে ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার (সুনানে আবু দাউদ)।
বন্ধুত্ব হলো নিরাপত্তার গ্যারান্টি : ‘যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে’ (সূরা আল ইউনুস-৬২)।
জান্নাত লাভের উপায় : আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরাই ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে।’
সর্বোত্তম প্রভাবক : বন্ধু হলো সর্বোত্তম প্রভাবক। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত কবি শেখ সাদী রহ:-এর কবিতাংশটি কতই না চমৎকার। তিনি লিখেছেন-
‘সংগীর গুণ পশিয়াছে মম মাঝে গো,
নইলে কাদায় সুবাতাস কি এতো পাইতে?’
ইসলাম স্বভাবধর্ম। মানবতার কল্যাণে এর সব বিধিবিধান প্রণিত। তাই স্বভাবধর্ম ইসলাম নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে। ভালোবাসার উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি : ভালোবাসা হবে শুধু আল্লাহর জন্য। এটিই ভালোবাসার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান মূলনীতি। জগতের সব ভালোবাসা আবর্তিত হবে আল্লাহকে কেন্দ্র করে এবং শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য, যাতে থাকবে না কোনো লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা এবং পার্থিব চাওয়া-পাওয়া। হজরত আবু যার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ পোষণ করা সর্বোত্তম কাজ’ (সুনানে আবু দাউদ)।
ভালোবাসার ভিত্তি হবে ঈমান ও ইসলাম : ভালোবাসার ভিত্তি হলো ঈমান ও ইসলাম। সুতরাং যার মধ্যে ঈমান নেই, যে ব্যক্তি ইসলামের অনুসারী নয় তার সাথে কখনোই কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব নেই। ‘ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অন্যের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করবেন’ (সূরা আত তাওবা-৭১)। ‘মুমিনরা যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না’ (সূরা আলে ইমরান-২৮)। ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা আল মায়িদাহ-৫১)। ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না’ (সূরা আল মুমতাহিনা-১৩)।
বন্ধুত্বের পাত্র হবেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইমানদাররা : একজন মানুষ শুধু বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক করতে পারে তাঁর মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে, তাঁর রাসূলের সাথে এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারী মুমিনদের সাথে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ- যারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় ও বিনম্র’ (সূরা আল মায়িদাহ-৫৫)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘যারা আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদের তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না। হোক না এই বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জাতি-গোত্র’ (সূরা মুজাদালাহ-২২)।
সর্বোত্তম বন্ধু আল্লাহ তায়ালা : যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারদের বন্ধু (অভিভাবক)। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান’ (সূরা আল বাকারাহ-২৫৭)। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জান-মাল দিয়ে আবু বকর ইবনে আবু কুহাফার চেয়ে বেশি কেউ আমার প্রতি ইহসান করেনি। আমি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে অবশ্যই আবু বকরকে গ্রহণ করতাম। তবে ইসলামের বন্ধুত্বই সর্বোত্তম’ (সহিহ বুখারি)। মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ভালোবাসার পাত্র রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিকৃত প্রিয়পাত্র হই’ (সহিহ মুসলিম)।
পঙ্কিলতা ও কলুষতা থেকে পবিত্রতা : বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হতে হবে নিষ্কলুষ ও তা অবশ্যই পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবে। কারণ, হারাম ও অবৈধ কাজের ক্ষেত্রে কোনো বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার সুযোগ নেই। তাই ভালোবাসার নামে বয়ফ্রে›ড, গার্লফ্রেন্ড, জাস্টফ্রেন্ড কালচার ও বিয়েবহির্ভূত অথবা বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েদের নষ্টামি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘বলুন, নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আল্লাহ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন’ (সূরা আল আরাফ-৩৩)। অশ্লীলতার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, যা ইসলামে হারাম। যেমন- আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩২)।নাম-ঠিকানা ও পরিচয় জানা : ইয়াজিদ ইবনে নুআমা আয-যাব্বি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি কারো সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে সে যেন তার নাম, পিতার নাম ও গোত্র বা বংশের নাম জিজ্ঞেস করে নেয়। কেননা, তা ভালোবাসার সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য খুব বেশি কার্যকরী হয়’ (জামে আত-তিরমিজি)। রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আসে উত্তরাধিকার সূত্রে’ (আদাবুল মুফরাদ)।
কৃত্রিমতা বর্জন : ভালোবাসার অন্যতম মূলনীতি হলো তা হবে নির্ভেজাল ও খাঁটি। তাতে কৃত্রিমতার কোনো স্থান থাকবে না। হজরত জায়েদ ইবনে আসলাম রা: থেকে বর্ণিত- উমার ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন, তোমার ভালোবাসা যেন কৃত্রিম না হয় এবং তোমার ঘৃণা যেন ধ্বংসকামী না হয়। আমি (রাবি) বললাম, তা কিভাবে হতে পারে? তিনি বলেন, তুমি যখন ভালোবাসো তখন শিশুর মতো হয়ে যাও এবং যখন তুমি ঘৃণা করো তখন তোমার সাথীর (প্রতিপক্ষের) ধ্বংস কামনা করো (এরূপ যেন না হয়) (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক)।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিম নামধারী এবং মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের অনেকেই উপরোক্ত মূলনীতিগুলোকে অবজ্ঞা কিংবা অস্বীকার করে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মতো ভয়ঙ্কর ঈমানবিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের বড় একটি অংশ অমুসলিম ও বিজাতীয়দের সাদৃশ অনুসরণে ব্যস্ত। তাদের বস্তাপচা সংস্কৃতি ও ক্রীড়া-কৌতুকের সামগ্রীকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করছে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো-
বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ও জাস্টফ্রেন্ড কালচার : বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ও জাস্টফ্রেন্ড কালচার পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা সংস্কৃতি। এটি মুসলিমদের কোনো সংস্কৃতি নয়। ইসলাম বন্ধুত্বের নামে এসব নোঙরামিকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারসহ যেকোনো উপায়ে বেগানা যুবক-যুবতীর মধ্যে নিষ্কাম বন্ধুত্ব অসম্ভব। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে- ‘কোনো পুরুষ যেন কোনো (বেগানা) নারীর সাথে মাহরাম ব্যতীত একাকিত্বে না থাকে’ (সহিহ বুখারি)।
বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে অহেতুক মাতামাতি : প্রতি চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল ও ক্রিকেটের আসর বসে। এ বিশ্বকাপকে ঘিরে মদ, জুয়া, ব্যভিচার ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি দেখা দেয়। কোটি কোটি দর্শক তাদের মূল্যবান সময়, সম্পদ ও স্বাস্থ্য নষ্ট করে বৃথা উল্লাসে মেতে ওঠে। এ উন্মাদনা শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীর মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়। পক্ষ-বিপক্ষ সমর্থন, হার-জিত নিয়েও তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বাড়াবাড়ির শেষ নেই। এ খেলাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও ওয়াজ মাহফিল ও তাফসির মাহফিল বন্ধের মতো দুঃখজনক ঘটনার সংবাদও শোনা যায়। এ খেলাকে কেন্দ্র করে বিয়েবিচ্ছেদ, স্ত্রীকে বাজিধরা, আত্মহত্যা এমনকি হত্যাকা-ের মতো গর্হিত কর্মের কথাও অহরহ শোনা যায়। অথচ এ ক্ষেত্রেও মুসলিম যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতার বড় একটি অংশ ভুলে যায় বন্ধুত্ব সম্পর্কে ইসলামের সেই সুমহান নীতিমাল- হে ঈমানদাররা! তোমরা তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেল-তামাশা রূপে গ্রহণ করেছে’ (সূরা মায়িদাহ-৫৭)।
থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন : ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের দিবাগত রাতকে থার্টিফার্স্ট নাইট বলা হয়। এটি পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের একটি কালচার। তারা এ দিনে আতশবাজি, পটকাবাজি, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করে। এটি ইসলামিক সংস্কৃতি নয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্কলাররা ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উদযাপনকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ এ ক্ষেত্রে মুসলিমদের বিরাট অংশ ভুলতে বসেছে ইসলামের সেই সতর্কবার্তা- ‘যে কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে (কিয়ামতের দিন) সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে’ (সুনানে আবু দাউদ)।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস উদযাপন : খ্রিষ্টানরা ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদযাপন করে। দিবসটির উৎপত্তি খ্রিষ্টীয় ও প্রাচীন প্রথা থেকে। খ্রিষ্টানদের কাছে এটি একটি মহৎ ও পবিত্র দিন। গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এ দিনে তারা তাদের যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে বিশেষভাবে স্মরণ করে। এ তারিখটি তাদের সংস্কৃতির অংশ। আমরা হুজুগে পড়ে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’কে ‘বিশ^ ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছি।
আবার ঈমান ও ইসলামের অনুসরণ ও অনুকরণের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তিদের মধ্যেও ভালোবাসা নিয়ে মাতামাতি বাড়াবাড়ির কমতি নেই। তাদের অনেকেই ভালোবাসাকে দল, মতবাদ, মাজহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। তাদের অনেককেই বিভিন্ন ঠুনকো অজুহাতে কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের কারণে অথবা ফিকহি মাসয়ালার কারণে বা দলীয় ভিন্নতার কারণে মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সামান্য কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং পরস্পরে শত্রুতে পরিণত হয়। অনেক সময় মুসলিম ভাইয়ের পরিবর্তে কোনো অমুসলিম বা শিরক ও বিদয়াতি আকিদায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত লোককেও সাহায্য করে। একজন ভালো বন্ধু হলেন রক্ষাকারী ছায়ার মতো। যে তা খুঁজে পেলো সে যেন একটি গুপ্তধন পেল। সুতরাং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমাদের ঈমান, ইসলাম, দ্বীনদারিতা, সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণসহ যাবতীয় নৈতিক উপযুক্ততার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। লেখক : সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com