শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২৩। একটি বছর অতিক্রম করে নতুন বছরে পদার্পণ করা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবে মুমিনের আনন্দ-বেদনা শুধু পার্থিব অর্জনের ওপর নির্ভর করে না। তার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস, সাফল্য ও অগ্রযাত্রার মূলভিত্তি পরকাল। তাই নববর্ষের আনন্দেও সে পরকাল ভুলে থাকে না।
সময়ের ভালো-মন্দ : বছরান্তে মানুষ যখন নতুন বছরে পদার্পণ করে, তখন বিগত বছরের প্রতি অনুযোগ করে বলে, ‘অন্ধকার সময় কাটিয়ে নতুন বছর আপনার জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করুক। ’ প্রকৃতপক্ষে সময়ের কি ক্ষমতা আছে মানবজীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর করার? সুসময় ও মন্দ সময় তো মানুষেরই কর্মফল মাত্র। তাই ইসলাম সময়কে গালমন্দ করতে নিষেধ করেছে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, বনি আদম আমাকে কষ্ট দেয়, সে যুগকে গালি দেয় অথচ আমিই যুগ, আমিই রাত ও দিন পরিবর্তন করি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৯১)
কৃতজ্ঞতা সময়ের মালিকের প্রতি : নতুন বছরে পদার্পণ করার সুযোগ দিয়ে মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যেন আমরা বিগত দিনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর আনুগত্যে জীবন যাপন করতে পারি। এই অবকাশটুকু দেওয়ার জন্য মহান স্রষ্টার প্রতিই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই বাড়িয়ে দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। ’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
মুমিনের আনন্দ-বেদনার ভিত্তি : মুমিনের জীবনে আনন্দ-বেদনার ভিত্তি পরকালীন সাফল্য। যদি বিগত বছরে মুমিনের পরকালের পাথেয় যথাযথভাবে অর্জন করতে পারে, তবে সে আনন্দিত হবে এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করবে। আর যদি সময়টুকু আল্লাহর অবাধ্যতায় কেটে যায়, তবে সে অনুতপ্ত ও ব্যথিত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফল। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ্য ছাড়া কিছু না। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
নিঃশেষ হচ্ছে জীবন : পৃথিবীতে মানুষের জীবনকাল অসীম নয়, বরং প্রতিনিয়ত সে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার অর্থ জীবন থেকে একটি বছর বিয়োগ হলো। তাই জীবনের ভালো ও মন্দ, অর্জন ও বিসর্জন বিবেচনা করা মুমিনের দায়িত্ব। আল্লামা ইবনু কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘সময় নষ্ট করা মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয়াবহ। কেননা সময়ের অপচয় তোমাকে আল্লাহ, পরকাল ও জান্নাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আর মৃত্যু তোমাকে কেবল পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো সেই কাজে লিপ্ত থাকা, যা অধিক উত্তম ও পরকালে বেশি উপকারী। ’ (মাওয়ারিদুজ জামআন লি-দুরুসিজ জামান : ৪/৪৬৯)
মুছে যাক পাপের ছায়া : পাপ মুমিন জীবনের ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত নিয়ে মানুষ যেমন স্থির থাকতে পারে না, মুমিন তেমন পাপ থেকে তাওবা না করে স্থির থাকতে পারে না। তাই নববর্ষে মুমিনের প্রতিজ্ঞা হয় পাপমুক্ত জীবন। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু যারা তাওবা করে, নিজেদের সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশে তাদের দ্বিনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনদের আল্লাহ অবশ্যই মহা পুরস্কার দেবেন। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৬)
আগামীর দিনগুলো হোক আরো সুন্দর : মুমিন মাত্রই আত্মোন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঈমান তাকে জীবনের মানোন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করে। সে সচেষ্ট থাকে যেন তার আগামীর দিনগুলো অতীতের চেয়ে উত্তম হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের জন্য অপেক্ষা কোরো না। আর যখন তোমার সকাল হয় তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা কোরো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে আর তোমার মৃত্যুর জন্য জীবনকে কাজে লাগাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬)
স্থির হোক জীবনের লক্ষ্য : মুমিনের জীবন অর্থহীন নয়। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সুতরাং মুমিন লক্ষ্য স্থির করে অগ্রসর হয়। লক্ষ্য নির্ধারণে সে পরকালকে প্রাধান্য দেয়। ফলে মুমিনের জীবনের প্রতিটি দিন হয়ে ওঠে লাভজনক ও ফলপ্রসূ। সাঈদ ইবনে জাবের (রহ.) বলেন, ‘মুমিনের প্রতিটি বেঁচে থাকার দিনই লাভজনক। ’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ১/৩৮৬)
মুমিনের দৃষ্টিতে সময়ের পরিক্রমা : আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, এসব মাস, বছর, রাত ও দিনÍসব কিছু সময়ের সীমা নির্ধারণ মাত্র, যা বান্দাকে ইবাদতের সময় নির্ধারণ করে দেয়। যা খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। … মুমিনের জীবনের যে সময়টি কেটে যায় নিশ্চয়ই সে সময়ে আল্লাহ কর্তৃক কোনো দায়িত্ব তার ওপর ছিল এবং তার আনুগত্যে তা অতিবাহিত করা আবশ্যক ছিল। মুমিনের জীবন এসব বিষয়েই আবর্তিত হবে। সময়মতো দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে সে তার ইবাদত করার পর আত্মতৃপ্তিতে ভোগে না। বরং তার ভাবনার পুরোটাতে মহান আল্লাহ বিরাজ করে। সে ভয় পায়, না জানি কখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যান, না জানি কখন একটু মনোযোগিতার কারণে তার সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে যায়। ’ (তাফসিরে ইবনে রজব, ১/৬১১)
উদাসীনতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয় : জীবন ও জীবনের সময় সম্পর্কে মুমিন কখনো উদাসীন থাকতে পারে না। সে সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর জবাবদিহিকে ভয় পায়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? এবং পূর্বে তাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের মতো যেন তারা না হয়, বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তাদের অধিকাংশ সত্যত্যাগী। ’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ১৬) মহান আল্লাহ সবার আগামীর দিনগুলো সুন্দর করে দিন। আমিন।