সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন

জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ

শাহাদাত সুমন :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৩

মানবসভ্যতাকে ধ্বংসাত্মক ও জাতিগত প্রতিহিংসামূলক সংঘাত থেকে রক্ষা করতে পৃথিবীর ইতিহাসের বাঘা বাঘা বিশ্বনেতা বারবার একত্র হয়েছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে প্রণয়ন করেছেন বহু চুক্তি, সমঝোতা-স্বাক্ষর। তবে অনেকক্ষেত্রে জাতিগত স্বার্থ রক্ষার জের ধরে অনেক আলোচনা-সমালোচনা প-ও হয়েছে বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বাদ সাধার কারণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর রাসায়নিক অস্ত্রের মুখে মানবসভ্যতার করুণ অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে ১৯২৫ সালের ১৭ জুন প্রণয়ন করা হয়েছিল জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিক নেতাদের সম্মতিতে পাশ হওয়া এই চুক্তির সময়কাল দিনক্ষণ হিসেবে প্রায় শতবর্ষ পার করলেও প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি সে চুক্তির প্রতিপাদ্যকে। প্রতিনিয়ত বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে বাজছে যুদ্ধের দামামা। অব্যাহত রয়েছে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে নিরীহ জনগোষ্ঠীর উৎখাতের রাজনীতিও। অনেক দেশে অনাহারি মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়লেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আধুনিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষার ব্যয়, যা জাতীয় অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ।
নেদারল্যান্ডের হেগভিত্তিক রাসায়নিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দ্য অর্গানাইজেশন ফর দ্য কেমিক্যাল ওয়েপনস’ বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক অস্ত্রের উৎপাদন, উন্নয়ন, মজুত ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ও ধ্বংসের লক্ষ্যে রাসায়নিক অস্ত্র সম্মেলনের আয়োজন করে যাচ্ছে গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। সংস্থাটির দপ্তর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৮৮টি দেশ সংস্থাটির আয়োজিত রাসায়নিক অস্ত্র সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও স্বাক্ষর করায় প্রায় ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে রাসায়নিক অস্ত্র নিরাপত্তার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশগুলোর ঘোষিত প্রায় ৭১ হাজার টন অস্ত্রের মধ্যে ৪৪ হাজার ১৩১ টন অস্ত্র ইতিমধ্যেই ধ্বংস করা হয়েছে। তবে ইসরাইল, মিশর, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ সুদান অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে চূড়ান্ত অনুমোদন না দেওয়ায় পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি রাসায়নিক অস্ত্র নিরাপত্তা। কালের পরিক্রমায় রাসায়নিক অস্ত্র নিরাপত্তা চুক্তিতে অংশ নেওয়া দেশসমূহের মধ্যেও এসব অস্ত্র উৎপাদন, মজুত ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে সক্ষমতা জাহিরের প্রতিযোগিতাও রোধ করা সম্ভব হয়নি। মানবসৃষ্ট দুর্যোগের আরেক আতঙ্কের নাম জীবাণু অস্ত্র। জীবাণু অস্ত্রকে বিশেষজ্ঞরা পারমাণবিক বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই জৈব অস্ত্রের মাধ্যমে মানবশরীরে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা বিশেষ গোত্রের ক্ষতিকর ছত্রাক প্রবেশ করিয়ে পুরো মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যায়।
কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কিউবার চলমান ডেঙ্গু মহামারিকে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত জৈব অস্ত্র হামলা বলে অভিযোগ করেছিলেন। এছাড়া বর্তমানে চলমান করোনা মহামারিকেও অনেকে চীনের উহান বা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার জীবাণু গবেষণা ল্যাব থেকে ইচ্ছাকৃত জৈব অ্যাটাক বলে অমীমাংসিত পালটাপালটি অভিযোগ করে চলেছেন। অভিযোগগুলো সত্য নয় বলেও যদি আমরা ধরি, তাহলেও জৈব অস্ত্র হামলা মানবজাতির জন্য যে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, তার সম্যক ধারণা আমরা পেতে পারি। ইবোলা ভাইরাস, হেমোজেরিক ফেবার, সোয়াইন ফ্লুর মতো নতুন নতুন ভাইরাস মহামারি সৃষ্টিকল্পে প্রকৃতিতে কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করা হলে আরো একবার অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হবে বিশ্ববাসীকে। যার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে হবে মড়ার উপর খাড়ার ঘা’র মতো। এর অভিঘাত আগে থেকে অভাবে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অপুষ্টিজনিত সমস্যা, স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, অকস্মাৎ আগত মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলবে। এমতাবস্থায় ১৮২টি দেশ কর্তৃক চুক্তিভুক্ত ১৯৭২ সালে প্রণীত বায়োলজিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশনের ধারা এক, দুই ও তিন অনুযায়ী জীবাণু অস্ত্র উৎপাদন, গবেষণা, সংগ্রহ, পরিবহন নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপই উপহার দিতে পারে মানবজাতিকে একটি বসবাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবীর। পাশাপাশি রাসায়নিক অস্ত্র মজুত ও অস্ত্র গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির চেয়ে মানবজাতির জীবনমান বৃদ্ধি, পৃথিবীর বুকে জেঁকে বসা মরণব্যাধি নির্মূল ও দেশে দেশে চলমান অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধে নজর প্রদানই পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com