শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের ৩৮৭তম সভা অনুষ্ঠিত অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে দ্রুত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে -আমান শ্রীমঙ্গলে নারী চা শ্রমিক-কর্মজীবী নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য নিয়ে সংলাপ কালীগঞ্জে সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম : আতঙ্কে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বগুড়ার শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত-নিহতদের স্মরণসভা দেশবিরোধী চক্রান্তকারীদের দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়া হবে-রেজাউল করিম বাদশা দুর্গাপুরে আইনজীবীদের মানববন্ধন কয়রায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের স্মরণ সভা ও সাংস্কৃতিক ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মুন্সীগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল সন্ত্রাসী সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধের প্রতিবাদে জলঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ দুর্গাপুরে শেষ হলো দুইদিন ব্যাপি কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ

গ্রেট নিকোবরে ভারতের নতুন মেগা বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৩

পরিবেশবাদীদের আপত্তি উপেক্ষা 

ভারত মহাসাগর লাগোয়া গ্রেট নিকোবর দ্বীপে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে একটি ‘ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর’ ও সেই সঙ্গে বিমানবন্দর, টাউনশিপ, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিরাট একটি হাব তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার।
‘গ্যালাথিয়া বে’ নামে এই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর বাংলাদেশ ও ভারতসহ পুরো বঙ্গোপসাগরে নৌ-বাণিজ্যের চেহারাই পাল্টে দেবে বলে বলা হচ্ছে। তবে পরিবেশবাদীরা অনেকেই এই মেগা-প্রকল্পে তীব্র আপত্তিও জানাচ্ছেন। যাবতীয় বিরোধিতা উপেক্ষা করে শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) ভারত সরকারের বন্দর ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই ‘গ্যালাথিয়া বে’ প্রকল্পের জন্য ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ (আগ্রহপত্র) আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে এই মর্মে পরদিন (২৮ জানুয়ারি) বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছে।
তবে এই ‘গ্যালাথিয়া বে’ প্রকল্প নিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেছে কিনা তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। এই প্রকল্পে ভারতের কলকাতা-হলদিয়া, ভাইজাগ বা চেন্নাই বন্দরের পাশাপাশি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরও দারুণ লাভবান হবে বলে ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কিন্তু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তাদের কথাবার্তা হয়েছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে গেছেন। তা ছাড়া, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার মতো আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশেরই এই প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি আছে। সার্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে স্পষ্ট, ‘গ্যালাথিয়া বে’ ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক আ লিক ভূ-রাজনীতিতে অচিরেই তীব্র আলোড়ন ফেলতে যাচ্ছে। এই মেগা প্রকল্পের পক্ষে-বিপক্ষে কী যুক্তি, এই প্রতিবেদনে সেটাই দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
কাকে বলে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট? যখন কোনও বড় জাহাজের কার্গো বা কন্টেইনারকে তার অন্তিম গন্তব্যে (ফাইনাল ডেস্টিনেশন) পৌঁছে দিতে কোনও বন্দরে ভিড়িয়ে তুলনায় ছোট কোনও জাহাজে সেই মাল খালাস করা হয়, তখন সেই বন্দরকে বলা হয় ‘ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট’।
নানা কারণে এই ট্রান্সশিপমেন্ট করতে হয়। ধরা যাক, চীনের সাংহাই থেকে একটি জাহাজ পণ্য নিয়ে সুয়েজ ক্যানাল পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবে, পথে সেটি ভারতের হলদিয়া বা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কিছু মাল খালাস করবে। কিন্তু সেই পুরো জাহাজটি যদি বঙ্গোপসাগরে ঢুকে হলদিয়া বা চট্টগ্রামে মাল খালাস করতে যায় তাহলে বাড়তি প্রায় দিন পনেরো সময় লাগবে, জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ অনেক বাড়বে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সেই পণ্য আমদানি করাটা হয়তো খরচেই পোষাবে না।
তার বদলে যদি বড় জাহাজটি তার রুটে সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে থেমে সেই কার্গো কোনও ছোট জাহাজে তুলে চট্টগ্রাম বা হলদিয়ার পথে রওনা করিয়ে দেয়, তাহলে খরচ ও সময়ের অনেক সাশ্রয় হবে। ঠিক এই কারণেই সিঙ্গাপুর ও কলম্বো এই অ লের সবচেয়ে বড় ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট।
ভারত সরকার এখন চাইছে, তাদের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একেবারে দক্ষিণতম প্রান্তে যে প্রায় জনমানবহীন গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ডটি আছে, সেখানে এরকম একটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট ও সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো গড়ে তুলতে। গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ডকে বেছে নেওয়ার কারণ, এই দ্বীপটি মালাক্কা প্রণালী দিয়ে যাওয়া পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ও ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের খুব কাছে।
গ্যালাথিয়া বে-তে (উপসাগর) এই ধরনের হাব গড়ে তোলার পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে : এই দ্বীপটি দুনিয়ার অন্যতম ব্যস্ত আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের খুব কাছে, মাত্র ৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে। এই রুট দিয়ে প্রতি বছর কম করে ৩৫ হাজার জাহাজ চলাচল করে। এখানে ‘ড্রাফট’ খুব ভাল, কারণ গ্যালাথিয়া বে-তে সমুদ্রের প্রাকৃতিক গভীরতাই ২০ মিটার। এর ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অনেকগুলো বন্দর – ফলে সেই সব বন্দরের জন্য গ্যালাথিয়া বে থেকে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো’ আহরণের সম্ভাবনাও বিপুল।
বন্দরের খুব কাছেই গড়ে তোলা হচ্ছে গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট, আধুনিক উপনগরী ও পাওয়ার প্ল্যান্ট। অবকাশ থাকছে শিপইয়ার্ড ও সংশ্লিষ্ট শিল্প গড়ে তোলারও। সব মিলিয়ে চারটি ধাপে মোট ৭২০০০ কোটি ভারতীয় রুপি খরচ করে পিপিপি মডেলে এই মেগা-প্রকল্প গড়ে তোলা হবে বলে স্থির হয়েছে। কলকাতা-হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে প্রথম ধাপের জন্য আগ্রহপত্র জমা দিতে হবে মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই।
গ্যালাথিয়া বে নিয়ে আপত্তি কোথায়? গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ডে এই মেগা ইনফ্রা-প্রকল্প পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা যাচাই করতে ভারত সরকার গত বছরই একটি পাবলিক কনসালটেশন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। বহু পরিবেশবাদী সংগঠন, এনজিও, গবেষক ও বিশিষ্ট নাগরিক তখন থেকেই বলে আসছেন এই ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট একটি বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এমন কী গত সপ্তাহেও (২১ জানুয়ারি) ভারতের ৮৭ জন সাবেক শীর্ষস্থানীয় আমলা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বরাবরে খোলা চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছেন, পরিবেশ বাঁচানোর স্বার্থে গ্রেট নিকোবরের এই ‘বিধ্বংসী প্রকল্প’ অবিলম্বে বাতিল করা হোক।
এই ৮৭ জনের মধ্যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত মধু ভাদুড়ী, শিবশঙ্কর মুখার্জি, দেব মুখার্জি, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ, সাবেক জাতীয় নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশির মতো বহু সুপরিচিত নাম আছে। তবে এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে গ্যালাথিয়া বে বন্দরের প্রথম ধাপ গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ভারত সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা এই সব আপত্তিতে আদৌ কর্ণপাত করছে না। ভারতের যে পরিবেশবিদরা কিংবা বাণিজ্য-অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাদের যুক্তি: এই প্রকল্প মহাসাগরীয় পরিবেশের জন্য একটা বিরাট বিপর্যয়। নিকোবর সি-র মহামূল্যবান ‘সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র’কে এটি ধ্বংস করে ফেলবে। ইন্দোনেশিয়া উপকূল থেকে ভৌগলিকভাবে খুব কাছে অবস্থিত এই দ্বীপটি একটি সুনামিপ্রবণ অ ল। ফলে এখানে যে কোনও বিনিয়োগে বিরাট ঝুঁকি থাকবে।
দক্ষিণ চীন সাগর থেকে সিঙ্গাপুরকে এড়িয়ে সরাসরি আন্দামান সি-তে ঢোকার জন্য দক্ষিণ থাইল্যান্ডকে চিরে চীন যে ‘ক্রা ক্যানাল’ বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, থাইল্যান্ড তা খারিজ করে দিয়েছে। এখন এই ক্যানাল যেহেতু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তাই গ্যালাথিয়া বে-তেও আশানুরূপ ট্রান্সশিপমেন্ট ট্রাফিক আসবে না।
এই প্রকল্প আসিয়ান-ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেও (বিশেষত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া) নতুন করে ভারতের জিওপলিটিক্যাল টেনশন (ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা) তৈরি করবে, যা বাঞ্ছনীয় নয়।
ফলে ভারতেও অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরীয় অ লের বন্দরগুলোর জন্য (কলকাতা-হলদিয়া, চট্টগ্রাম, মোংলা, ভাইজাগ, চেন্নাই ইত্যাদি) যেভাবে কলম্বো, সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুরের কাছে ক্লাং ‘ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট’ হিসেবে কাজ করছে, সেই ব্যবস্থাই জারি থাকুক। গ্রেট নিকোবরের গ্যালাথিয়া বে-তে ট্রান্সশিপমেন্ট হলে খরচ বাড়বে বই কমবে না বলেও তাদের ধারণা। ফলে ভারতের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বন্দর ও ইনফ্রা প্রকল্প বঙ্গোপসাগরে যে অচিরেই বিতর্কের তুফান তুলতে যাচ্ছে, সে ইঙ্গিত একেবারে স্পষ্ট।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com