শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ দিবস পালিত মাধবদীতে জ্যান্ত কই মাছ গলায় ঢুকে কৃষকের মৃত্যু বদলগাছীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী কালীগঞ্জে কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা লতিফ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে মানববন্ধন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন বরিশালে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী মেলার উদ্বোধন হাতিয়ায় দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত স্মৃতি কর্ণার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন গজারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে ছাত্রলীগের গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

ইসলামের স্বর্ণযুগে অপ্রতিরোধ্য নৌশক্তি

নিজাম আশ শামস :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

আমির আল বাহার। এটি একটি আরবি শব্দ। অর্থ সমুদ্রের অধিপতি। আরব নৌবাহিনীর প্রধানকে এ উপাধিতে সম্বোধন করা হতো। আরবি থেকে এ অভিধা ইউরোপে আত্তীকৃত হয়েছে। পর্তুগিজ উচ্চারণে তা আমিরালহ্, ফরাসিদের কাছে আমিরাল। এর সঙ্গে লাতিন উপসর্গ অ্যাড যুক্ত হয়ে ইংরেজিতে তা অ্যাডমিরাল রূপ লাভ করছে। বর্তমানে তা সারা বিশ্বে আধুনিক নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। নৌবাহিনীতে ব্যবহূত এমন বেশকিছু শব্দের উৎস আরবি ভাষা। এসব শব্দ থেকে সুপ্রাচীন কাল থেকে আরবদের নৌ-চলাচলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সওয়ারি উটের ওপর চড়ে যেতে যেতে মরুভূমির কবির মানসপটে ভেসে ওঠে পালতোলা জাহাজের স্মৃতি। উটের ছন্দময় দুলুনি সাগরবক্ষে দোদুল্যমান জাহাজের প্রতীক হয়ে তার চোখে ধরা দেয়। উটের লম্বা বাঁকা গ্রীবা তার কাছে নৌকার পশ্চাৎভাগ। এ কল্পনাকে তিনি মূর্ত করেন তার কবিতায়, যা স্থান পায় পবিত্র কাবার দেয়ালে সাতটি ঝুলন্ত কবিতা ‘সাবআ মুয়াল্লাকা’র অন্যতম হিসেবে। প্রাক-ইসলামী যুগের আরবি কবিতায় নদী, সাগর ও নাবিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ কবিরা প্রায়ই বাহরাইন বা পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় সফর করতেন। তারা হেরাতেও যেতেন। দজলা ও ফোরাত অঞ্চলে বসবাসকারী ইরাকের এক শাসকগোষ্ঠী পরিচিত ছিল ‘মানযিরা’ নামে। হেরাত ছিল তাদের রাজধানী।
মুসলিম নৌবাহিনীর যাত্রা: আরবি শব্দ ও কবিতা বিশ্লেষণে আরবদের সমুদ্রযাত্রার বিচ্ছিন্ন কিছু চিত্র পাওয়া গেলেও প্রকৃত অর্থে আরব নৌবাহিনী তৈরি হয় ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফানের খেলাফতকালে। প্রথম আমির আল বাহার হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস হারিসীর নাম। ২৮ হিজরি থেকে এ যাত্রা। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে ৫০টি নৌ-অভিযান করেন। সে সময় সিরিয়ার প্রশাসক ছিলেন হযরত আমির মুয়াবিয়া। তিনি সেখানে মুসলিম নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। মিসরে এ দায়িত্ব ছিল হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সাদের কাঁধে। ভূমধ্যসাগরে মুসলিম নৌবাহিনী নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। ২৮ হিজরিতে তারা সাইপ্রাস জয় করে। তারপর একে একে দখল করে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো। পাশাপাশি পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে যাত্রা করে আরব নৌবাহিনী।
মুসলিম নৌবাহিনী ব্যাপকতা লাভ করে উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আমির মুয়াবিয়ার হাত ধরে। প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি নৌবাহিনীকে সুসংহত করেন। উমাইয়াদের রাজধানী ছিল দামেস্ক। সাম্রাজ্যবাদী রোমানরা তখন পরাশক্তি। ৪৯ হিজরিতে তারা সিরীয় উপকূল আক্রমণ করে। তাদের প্রতিহত করতে আমির মুয়াবিয়া নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। তার নির্দেশে সিরিয়ায় জাহাজ নির্মাণ কারখানা তৈরি হয়। এ নৌবাহিনী নিয়ে তিনি পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। দখল করে নেন সিসিলি, রোডস, ক্রিট প্রভৃতি অঞ্চল। উমাইয়া আমলে শুরু হওয়া মুসলিম নৌবাহিনীর এ অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা আব্বাসীয় আমলেও বজায় থাকে।
নৌবাণিজ্য: ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখল করে। তারা সিরিয়া থেকে ইরাকে রাজধানী স্থানান্তর করে। ফলে পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ আরো ঘনিষ্ঠ হয়। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। একে বেষ্টন করে আছে দজলা ও ফোরাত নদী। দুটি নদীই গিয়ে মিলিত হয়েছে পারস্য উপসাগরের সঙ্গে। দজলা ও ফোরাতকে কেন্দ্র করে সারা দুনিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করা ছিল আব্বাসীয়দের উদ্দেশ্য। সে বিবেচনায় তাদের প্রথম রাজধানী কুফা ত্যাগ করে তারা বাগদাদে রাজধানী স্থাপন করে। বাগদাদকে ঘিরেই আবর্তিত হয় মুসলমানদের সোনালি যুগ। এ প্রসঙ্গে ‘আরব নৌবহর’ গ্রন্থে এর রচয়িতা সৈয়দ সুলাইমান নদভী (বঙ্গানুবাদ হুমায়ুন খান) আব্বাসীয় আমলের ঐতিহাসিক ইবনে ওয়াহিদ ইয়াকুবী রচিত ‘কিতাবুল বুলদান’ থেকে এ উদ্ধৃতি তুলে ধরেন: ‘মনসুর এই স্থানটি নির্বাচন করেছিলেন। কারণ এটা সত্যিকার অর্থে দজলা ও ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ। পূর্বে দজলা আর পশ্চিমে ফোরাত, এ দুটি গোটা পৃথিবীর ঘাট। ওয়াসিত, বসরা, ওবুল্লা, আহ্ওয়াজ, ইরান, ওমান, ইয়ামামা, বাহরাইন এবং তাদের সন্নিহিত এলাকা থেকে যেকোনো সম্পদ আসত, তা দজলা দিয়ে আসতেই হতো এবং সেই সব জাহাজকে দজলাতে নোঙর গাড়তেই হতো। অনুরূপভাবে মসুল, রাবিয়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া থেকে আগত জাহাজকেও অবশ্যই দজলাপথে আসতে হতো এবং মুদার, রাক্কা, সিরিয়া ও সিরিয়ার বিভিন্ন বন্দর, মিসর এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত জাহাজও ফোরাত নদীপথে অবশ্যই এখানে আসত। শহরটির নৌ ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে ফোরাত নদী থেকে একটি খাল কেটে সওদাগরদের মহল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়া হয়। সমুদ্র থেকে সওদা বোঝাই জাহাজ ফোরাত নদীতে আসত। নদী থেকে কারখাইয়া খালে প্রবেশ করত, সেখান থেকে একটি কৃত্রিম খালপথে শহরে প্রবেশ করত। শহর থেকে সওদাগরদের মহল্লায় গিয়ে সেখানে মালপত্র খালাস করত। এগুলো ছাড়াও অন্যান্য খাল ছিল এবং সেগুলোও একই উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতো, যেমন বহরের বা সাগরের খাল। ফোরাত থেকে বহির্গত এই খাল খুব প্রশস্ত ছিল। রাক্কা, সিরিয়া ও মিসর থেকে আটা ও ময়দা বোঝাই বড় বড় জাহাজ এসে ভিড়ত। এর পাড়ে ছিল সওদাগরদের গুদামঘর। আর খালটি সবসময়ই বড় জাহাজ চলাচলের উপযোগী গভীর থাকত। বাগদাদের কাছে সারসারে একটি খাল ছিল, সেটিতেও নৌকা চলাচল করত। ঈসা খাল থেকে ফোরাত নদী হয়ে জাহাজ আসত দজলা নদীতে।’ ইয়াকুবির এ বর্ণনা থেকে আব্বাসীয় আমলে মুসলিম নৌবাণিজ্যের একটি রূপরেখা পাওয়া যায়।
আব্বাসীয় শাসনামলে আরবরা সিন্ধু দখল করে সিন্ধু ও বসরার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে। আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদির শাসনকালে তারা গুজরাটে অভিযান চালায়। এর নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল মুলক ইবনে শিহাব আল মাসমাঈ। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সিন্ধুর সঙ্গে আব্বাসীয় খলিফাদের সম্পর্ক অটুট ছিল। এ সময় তারা এ অঞ্চলে আর কোনো নৌ-অভিযান পরিচালনা করেননি। ফলে সিন্ধুবাসীদের কাছে আরবরা সওদাগর হিসেবে পরিচিতি পায়। তাদের বাণিজ্য উদ্যোগ বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্য হারে। ইরাক ও আরবের বন্দরগুলোকে কেন্দ্র করে পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর, চীন সাগর, লোহিত সাগর ও আবিসিনিয়া সাগরে বিস্তৃত ছিল তাদের বাণিজ্যপথ। এর কারণ হিসেবে সৈয়দ সুলাইমান নদভী লেখেন: ‘আব্বাসীয় আমলে আরবদের বাণিজ্যিক ক্রিয়াকা- খুব বেশি বৃদ্ধি পায়। এর কারণ ছিল এই যে উমাইয়া আমলে তাদের যে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক ও বেসামরিক চাকরি করতে হতো, আব্বাসীয় আমলে তা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৩৩ হিজরি থেকে বেসামরিক চাকরিতে ইরানিরা নিযুক্ত হতে থাকে এবং কেবল সামরিক চাকরিতেই আরবদের রাখা হয়। ২১৮ হিজরির পরে মুতাসিমের শাসনামলে সামরিক পদে তুর্কিরা নিযুক্ত হয়। কাজেই আরবদের পক্ষে একমাত্র ব্যবসায় ছাড়া আর কোনো সম্মানজনক জীবিকার পথ খোলা ছিল না।’আব্বাসীয় আমলে বসরা বন্দর নগরী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বসরা সম্পর্কে ইবনে ওয়াদিহ ইয়াকুবি তার কিতাবুল বুলদান গ্রন্থে উল্লেখ করেন: ‘সারা দুনিয়ার জিনিসপত্র ও সওদাগরি মালের এটা ছিল প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও রাজধানী।’ আরেকটি প্রধান বন্দর ছিল সিরাফ। ভারত ও চীনগামী সব আরব জাহাজ পারস্য উপসাগরের উপকূলে স্থাপিত বন্দরটিতে ভিড়ত। আব্বাসীয় আমলে ইয়েমেনের উপকূলবর্তী এডেনে বসতি বৃদ্ধি পায়। আব্বাসীয় আমলের ঐতিহাসিক বাশ্শারি মুকান্দাসি এডেনের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে লেখেন: ‘কোনো ব্যক্তি যদি এক হাজার দিরহাম নিয়ে এখানে আসেন, তাহলে তিনি এক হাজার দিনার নিয়ে ফিরে যান এবং একশ অবশ্যই পাঁচশ হয়ে যায়।’ এছাড়া সুহার, শিহর, কায়স, বাহরাইন, হরমুয, জেদ্দা, কুলযুম এবং আয়লাহ আব্বাসীয় খেলাফতকালের উল্লেখযোগ্য বন্দর ছিল। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী শহর তিউনিস। উমাইয়া খেলাফত থেকেই এটি গুরুত্বপূর্ণ নৌকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। আব্বাসীয় আমলেও সে তার গৌরব ধরে রেখেছিল। এ নৌঘাঁটি থেকেই তারা রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করত। আব্বাসীয়দের অধীনে আগলাবিরা আফ্রিকা শাসন করতেন। তারা ছিলেন নজদের বনু তামিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ৮০০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদ ইব্রাহিম ইবনে আল আগলাবকে আফ্রিকার আমির হিসেবে নিয়োগ দেন। ২১২ হিজরিতে তেমনই এক অভিযানে আগলাবি নৌ সেনাপতি কাজি আসাদ বিন ফুরাতের নেতৃত্বে সিসিলি দখল করে নেয় আব্বাসীয়রা। ৪৬৪ হিজরি পর্যন্ত এ দ্বীপ আরবদের অধীনে ছিল। তখন আরব নৌবহরের ক্রিয়াকা- আরো বিস্তৃতি লাভ করে। সৈয়দ সুলাইমান নদভী এ চিত্র খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তার লেখায়: ‘এ সময়ে সিসিলি এবং উত্তর আফ্রিকার উপকূল অঞ্চল আরব নৌবহরের ক্রিয়াকা-ের বড় বড় কেন্দ্র ছিল। আরবরা এই দুই-এর মধ্যবর্তী ভূভাগে খুবই ঘন ঘন যাতায়াত করত। এই দুই আফ্রিকীয় ও ইউরোপীয় উপকূল থেকে অগণিত জাহাজ রওনা হয়ে আলেকজান্দ্রিয়া যেত।’
নৌ-অভিযান: রোমানদের হাত ধরে গড়ে ওঠে বাইজেন্টাইনীয় সাম্রাজ্য। আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিমের খেলাফতকালে তাদের সঙ্গে বাইজেন্টাইনীয়দের কয়েকটি নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল মনসুর সাইপ্রাস দখল করে সেখানকার প্রশাসককে বন্দি করার উদ্দেশ্যে নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। ৭৯০ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন বাহিনী কয়েকজন মুসলিম সৈনিককে আটক করে। মুসলিম নৌবাহিনী তখন সাইপ্রাসে অবস্থান করছিল। খবর পেয়ে তারা এশিয়া মাইনরে অবস্থান নেয়। তৎকালীন রোমান সম্রাজ্ঞী আইরিনের নির্দেশে মুসলিম নৌবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে যায় বাইজেন্টাইন রণতরী। এ যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হয়। তুরস্কের সীমান্তে অবস্থিত মারমারা সাগর কৃষ্ণ সাগর ও ইজিয়ান সাগরকে মিলিত করেছে। খলিফা আল মাহদি তার পুত্র, মুসলিম স্বর্ণযুগের বিখ্যাত শাসক হারুন আল রশিদের নেতৃত্বে মারমারা সাগরে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানে মুসলমানরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম না হলেও হারুন আল রশিদ বাইজেন্টাইন সম্রাজ্ঞী আইরিনের সঙ্গে এক সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে তিন বছরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। খলিফা হারুন আল রশিদের সঙ্গে সর্বদা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা ছিল সম্রাজ্ঞী আইরিনের। এরই অংশ হিসেবে ৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার এক মন্ত্রী ইউথিমিয়াসকে বিপুল উপঢৌকনসহ খলিফার দরবারে প্রেরণ করেন। ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় মুসলমানরা বাইজেন্টাইনীয়দের পরাজিত করে। ৮৪১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল মুতাসিম এবং বাইজেন্টাইন সম্রাট থিওফিলাসের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। পরের বছরই আল মুতাসিম এ শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে কনস্টান্টিনোপল জয় করার জন্য নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। সেনাপতি আবু দিনারের নেতৃত্বে এ বাহিনীতে ৪০০ জন সৈন্য ছিল। দুর্ভাগ্যবশত ঝড়ের কবলে পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয় মুসলিম নৌবাহিনী। আব্বাসীয়দের সাতটি যুদ্ধজাহাজ কোনো রকমে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। দশম শতাব্দীর গোড়ার দিকে আব্বাসীয় নৌবাহিনী ইজিয়ান সাগরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ৯০৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তারা দ্বিতীয়বারের মতো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। আব্বাসীয়দের এ নৌবহরে ৫৪টি পালতোলা জাহাজ ছিল। নৌ কর্মকর্তা এবং ২০০ জন সুদক্ষ যোদ্ধার সমন্বয়ে সুসজ্জিত এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আব্বাসীয় আমলের সবচেয়ে সাহসী ও কৌশলী মুসলিম অ্যাডমিরাল রাশিদ আল ওয়ারদানি, যিনি গোলাম জুরাফা নামেও পরিচিত ছিলেন। খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনামলে আব্বাসীয় নৌবাহিনী ক্রিট দ্বীপে অভিযান চালায়। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হুমাইদ ইবনে মায়ুফ আল হামদানি। খলিফা আল মামুনের রাজত্বকালে আবু হাফস উমর ইবনে ঈসা আল আন্দালুসির নেতৃত্বে পুনরায় ক্রিট আক্রমণ করে মুসলিম নৌবাহিনী।
নৌবাহিনীর পদবিন্যাস: আব্বাসীয় আমলে নৌবাহিনীর কাঠামো সম্পর্কে সৈয়দ সুলাইমান নদভী লেখেন: ‘আব্বাসীয় আমলে জাহাজের নি¤œশ্রেণীর সাধারণ কর্মচারীগণকে বলা হতো মাল্লাহ্ ও খাল্লাসি আর উচ্চপদস্থ নাবিকদের বলা হতো রাউসা। এর একবচনে রূপ হলো রইস। পরবর্তীকালে জাহাজের কাপ্তানকে যে রিস বলা হতো তা এরই বিকৃত রূপ। নবম ও দশম শতকে জাহাজের কাপ্তানকে বলা হতো মুয়াল্লিম। শেষোক্তটি কম ব্যবহূত হলেও দুটি শব্দ দ্বারা একই অর্থ, অর্থাৎ কাপ্তান বোঝাত। এর আরো কয়েকটি রূপ ছিল, যথাÍরায, রাইয ও রিজ, সবই রোজ শব্দজাত, যার অর্থ হচ্ছে অভিজ্ঞ বা পারদর্শী।’ এর তথ্যসূত্র হিসেবে তিনি ‘লিসানুল আরব’ এবং ‘শাফাউল গালিল’ নামক দুটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন। শেষকথা: জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি মুসলিম নৌশক্তিতেও উৎকর্ষ সাধিত হয় আব্বাসীয় খেলাফতকালে। ভূমধ্যসাগর এবং মারমারা সাগরবক্ষে আব্বাসীয়দের এসব অভিযান ও বিজয় তাদের নৌবাহিনীর পরাক্রম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। নৌশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা আক্রমণ চালিয়েছিল বাইজেন্টাইনদের জলসীমায়। একই সঙ্গে সুসংহত রেখেছিল নিজেদের সার্বভৌমত্ব। বিস্তৃত হয়েছিল বাণিজ্য পরিধি। নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com