শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

রাজা তৃতীয় চার্লসের বংশীয় পদবী

গাজী মিজানুর রহমান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

লুই মাউন্টব্যাটেনকে আমরা ভালোভাবে চিনি । তিনি ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় ছিলেন। ভারত ভেঙে দুই ভাগ করে তিনি কিছুদিন স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। পাকিস্তানের কাছেও অনুরূপ সম্মান পাওয়ার আশা ছিল তার। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন । জিন্নাহর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, মাউন্টব্যাটেন জমি ভাগের সময় ভারতের দিকে বেশি পক্ষপাতিত্ব করেছে । মাউন্টব্যাটেন নিজেও চাননি যে ভারত বিভক্ত হোক। তাই পরে এক সাক্ষাৎকারে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তিনি যদি জানতেন জিন্নাহ আর বেশিদিন বাঁচবেন না তাহলে কি ১৯৪৭ সালে তড়িঘড়ি করে দেশটাকে ভাগ করতেন ? তার উত্তর ছিল , অবশ্যই না ; তিনি ভাগবাটোয়ারা করতে দেরি করতেন ।
লুই মাউন্টব্যাটেন গ্রেট বৃটেনের বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস এর পিতা প্রিন্স ফিলিপের মামা । মাউন্টব্যাটেন পরিবারের আগের নাম ছিল ‘ব্যাটেনবার্গ’ । এরা জার্মান বংশোদ্ভূত রাজকীয় পরিবার ।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানির বিরুদ্ধে বৃটিশ জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে । তার ফলে মনস্তাত্ত্বিক চাপে ব্যাটেনবার্গ পরিবার ১৯১৭ সালে তাদের নাম রাখে ‘মাউন্টব্যাটেন’ । গ্রেট বৃটেনের সদ্যপ্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজবংশ ‘স্যাক্সে কোবার্গ এন্ড গোথা’ । ১৯১৭ সালে একই কারণে নাম পরিবর্তন করে এর নাম রাখা হয় ‘উইন্ডসর’ ।
মাউন্টব্যাটেন এবং উইন্ডসর পরিবার-দুটি আগে থেকেই আত্মীয় ছিল । মাউন্টব্যাটেন পরিবারের এক পূর্বসূরি রানি ভিক্টোরিয়ার কন্যা বিয়াত্রিসকে বিয়ে করেছিলেন । ইংল্যান্ডের সমাজ আমাদের দেশের মতোই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা বহন করলেও অনেক আগে থেকেই ইংল্যান্ড ভারতের চেয়ে অনেক বেশি নারী-বান্ধব। তাদের উত্তরাধিকার আইনে রাজার পুত্র থাকলে ছোট হোক আর বড় হোক তিনিই রাজা হন । কিন্তু পুত্র না থাকলে জ্যেষ্ঠা কন্যা হন রানি । সন্তানের অবর্তমানে ভ্রাতা হবেন রাজা। দু’একটা ক্ষেত্র ছাড়া এই উপমহাদেশে রানির শাসনের নজির কম। কিন্তু যখনই গ্রেট বৃটেনে কন্যা সন্তান রানি হয়েছে , আর তার সন্তান পরে রাজা-রানি হয়েছে , অথবা রানির সন্তান-সন্ততি না থাকলে সিংহাসনে অন্য একজন বসেছে , তখনই রাজবংশ বদল হয়ে গেছে । রানি ভিক্টোরিয়ার পর তার পুত্র সপ্তম এডওয়ার্ড রাজা হন । তিনি হ্যানোভার বংশের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার ‘উইন্ডসর’ বংশের রাজতন্ত্র সূচনা করেন । হ্যানোভার বংশও একইভাবে কুইন অ্যানের মৃত্যুর পর প্রথম জর্জের মাধ্যমে সিংহাসন পায় । তাদের আগে স্টুয়ার্ট রাজবংশ রাজা প্রথম জেমস এর মাধ্যমে টিউডর বংশের শেষ শাসক রানি প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করে । তবে টিউডরদের সময়ের আগে রাজবংশ বদল হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে । এভাবে ১০৬৬ সালে নরম্যানডির ডিউক উইলিয়াম ইংল্যান্ড দখল করে রাজা হন । তারপর প্লান্টাজেনেট , ল্যাংকেস্টারিয়ান , ইয়র্ক রাজবংশের মানুষেরা ইংল্যান্ডের সিংহাসন দখল করেছিল । রানি এলিজাবেথের সাথে সাথে শেষ হলো উইন্ডসর রাজবংশের শাসন । রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ খুবই বুদ্ধিমতী ও সুচতুর ছিলেন । স্বামী ফিলিপের কিছু আচরণে লাগাম টানতে হয়েছে রানিকে। আবার রাজপুত্র চার্লসকে নিয়েও প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর এক সংকটময় সময় পার করতে হয়েছে তাকে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক নখদন্তহীন বাঘের দেশে গণতন্ত্রের চাপে রাজপরিবারের সুনাম রাখতে বহু কায়দা-কানুন করে রানিকে নিজের অবস্থান সংহত রাখতে হয়েছে । রাজবংশের ভেতরে তার ও প্রিন্স ফিলিপের সন্তানদের একটা আলাদা পরিচয় দাঁড় করাতে ১৯৬০ সালে প্রিভি কাউন্সিলের এক ঘোষণায় তার পুত্র সন্তানদের পদবি তাদের বাবা-মা উভয়ের নাম জড়িয়ে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । সেই পদবি হচ্ছে মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর ।
রাজা চার্লসের পুরো নাম হচ্ছে ‘চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ’ । বর্তমান রাজবংশের যে নাম ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে যাবে তা হাইব্রিড ঘরানার রাজবংশ – মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর । মায়ের পরিবারের পদবি নিজ নামে অন্তর্ভূক্ত করার পূর্ব দৃষ্টান্ত স্বয়ং চার্লসের পিতা প্রিন্স ফিলিপ । ফিলিপ ছিলেন গ্রিসের রাজপরিবারের প্রিন্স । রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্কের পর উভয়ের বিয়ে হয় । ফিলিপ তখন গ্রিসের পারিবারিক খেতাব ত্যাগ করে তার নানার স্কটল্যান্ডের ‘মাউন্টব্যাটেন’ পরিবারিক পদবি গ্রহণ করেন । আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বংশের নামের মতই বর্তমান রাজার নিজের নামের মধ্যে মিশ্রণ রয়েছে। ‘চার্লস’ নামটা ছিল স্টুয়ার্ট রাজাদের নাম। তারা ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড উভয় দেশের রাজা হওয়ার আগে স্কটিশ রাজা ছিলেন। এ নামের সাথে স্কটল্যান্ডের নরম অনুভূতি জড়িত থাকতে পারে । অন্যদিকে রানি ভিক্টোরিয়ার হ্যনোভার পরিবারের প্রথম রাজার নাম জর্জ । স্কটল্যান্ড একবার স্বাধীনতার জন্য উদ্গ্রীব হয়েছিল, কিন্তু পরে পিছিয়ে গেছে । দুই দেশ এক রাখার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে রাজা চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ নিজের দাপ্তরিক নাম ঘোষণার সময় ‘জর্জ’ নামটি গ্রহণ না করে ‘চার্লস’ নামটা বেছে নিয়ে হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। যদিও অতীতের চার্লস নামের রাজাদের সাথে বহু দুর্ভাগ্যের ইতিহাস জড়িয়ে আছে ।
শুরু করেছিলাম ভারতবর্ষের কথা দিয়ে শেষ করি সেইভাবে । বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় লুই মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে দুটো দেশ বানিয়ে বৃটিশ রাজের ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছেন । দুই দেশ থেকে পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে তিনটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে । মাউন্টব্যাটেনকে আমাদের একপ্রকার কাছের লোক বলা যায় । তার নাতি রাজা তৃতীয় চার্লস একজন ভালো রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক এটা আমাদের কাম্য । বিশেষ করে গ্রেট বৃটেনের নাগরিকদের একটা বড় অংশ আমাদের দেশ থেকে ওই দেশে গিয়েছেন । তাদের শান্তির স্বার্থে গ্রেট বৃটেনের কল্যাণ কামনা করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। (গাজী মিজানুর রহমান -লেখক ও প্রবন্ধকার )




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com