দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদে একদিকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ, অন্যদিকে দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকায় ধান আবাদ করে লাভের মুখ দেখছেন না কৃষক। এ অবস্থায় কৃষক কেন এত টাকা খরচ করে বোরো আবাদ করবেন—সে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বোরো মৌসুমে চট্টগ্রাম কৃষি অ লে আবাদ হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এলেও বাইরে রয়েছে প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমি। অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে সেচে কৃষককে ডিজেলের ওপর নির্ভর হতে হচ্ছে। ডিজেলের দামে ভর্তুকি না দেয়া ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো চাষে কৃষককে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। অন্যদিকে এ অ লের অনেক জায়গায় পানি না থাকায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছেন কৃষক।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম কৃষি অ লের পাঁচ জেলায় (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী) চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে উফশী ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ হেক্টর, হাইব্রিড ১ লাখ ৩০ হাজার এবং স্থানীয় জাত আবাদের জন্য ৩৬৪ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, কক্সবাজারে ৫৪ হাজার ৭০০, নোয়াখালীতে ৯৩ হাজার ২০০, ফেনীতে ৩০ হাজার ৪৫০ এবং লক্ষ্মীপুরে ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। সর্বশেষ ২৬ ফেব্রুয়ারির তথ্য মতে, চট্টগ্রাম অ লে ২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৬ হেক্টর বা ৯৮ শতাংশ জমিতে বোরোর তিন জাতের (হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয়) জাতের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। অথচ গত মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৫ হেক্টরে। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় চলতি মৌসুমে ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। যার মধ্যে উফশী ৪০ হাজার ৯১০ এবং হাইব্রিড আবাদ হচ্ছে ২০ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে গত মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ৬০ হাজার ৮৭৫ হেক্টর। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে আবাদ বেড়েছে ৪ হাজার ২২৫ হেক্টর। কক্সবাজার জেলায় আবাদ ৫৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির বোরো আবাদ সম্পন্নের পথে। গত মৌসুমে যেখানে আবাদ হয়েছিল ৫১ হাজার হেক্টর, ফেনী জেলায় চলতি মৌসুমে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে ৩০ হাজার ৪৫০ হেক্টর। গত মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ২৯ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ এ জেলায় আবাদ বেড়েছে ৭৮৫ হেক্টর জমি।
চট্টগ্রাম অ লে বোরো ধানের সব থেকে বেশি আবাদ হয় নোয়াখালী জেলায়। চলতি মৌসুমে জেলাটিতে উফশী ও হাইব্রিড আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার ২০০ হেক্টর।
কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বেশকিছু জমিতে বোরো আবাদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ প্রায় সম্পন্নের পথে। গত মৌসুমে এ জেলায় আবাদ হয়েছিল ৩৫ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বোরো মৌসুমে চট্টগ্রাম অ লে বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত গভীর, অগভীর ও এলএলপি সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে ৪৩ হাজার ২৯৩টি। এর মধ্যে গভীর সেচযন্ত্র ১৪৭টি, অগভীর সেচযন্ত্র ১৮ হাজার ৩০৫টি, এলএলপি ২০ হাজার ২৮৫টি এবং অন্যান্য সেচযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ৪ হাজার ৫৫৬টি। এসব সেচযন্ত্র দিয়ে চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৭ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে কৃষি অ লে ২১ হাজার ১৯৩ হেক্টর জমি এখনো সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
কৃষক বলছেন, বোরো মৌসুম প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর হয়। সেচ দেয়া ছাড়া বেরো উৎপাদন সম্ভব নয়। মৌসুমের শুরুতেই অনেক জায়গায় পানির সংকট দেখা গেছে। সর্বশেষ বর্ষা মৌসুমে এ অ লে বর্ষা কম হওয়ায় নদী বা খালে পানির পরিমাণ এমনিতেই কম। তাছাড়া চট্টগ্রামের বেশির ভাগ উপজেলায় সারা বছরের মতো বোরো মৌসুমেও পানির সংকট থাকে তীব্র। গত মৌসুমে ডিজেল বাবদ বিঘাপ্রতি সেচে কৃষককে ব্যয় করতে হয়েছে ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। সাধারণ জমির দূরত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় বিঘাপ্রতি ২২-২৫ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। তবে ডিজেলের দাম বাড়ায় চলতি বোরো মৌসুমে বিঘাপ্রতি প্রতিজন কৃষককে ব্যয় করতে হচ্ছে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। সেচেই কৃষককে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
অশোক সরকার নামের এক কৃষক বলেন, ‘গত মৌসুম থেকে চলতি মৌসুমে শুধু ডিজেলের খরচে বেড়েছে বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা। তাছাড়া বিদ্যুৎ সংকট, ভূগর্ভস্থ পানির সংকট থাকার পরও ডিজেলচালিত যন্ত্রে আমাদের সেচ দিতে হচ্ছে। দেখা যায় সেচযন্ত্র থেকে এক কৃষকের জমি অনেক দূরে সেক্ষেত্রে তাকে আরো বেশি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। গত মৌসুমে বোরো ধান বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি গড়ে ১ হাজার ১০০ টাকা। তাছাড়া সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো ধান গত বছর থেকে অন্তত মণপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। নয় তো ধান বিক্রি করে লাভ হবে না।’
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, ‘চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। সেচযন্ত্রের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম অ লে আবাদ যতটুকু হচ্ছে সে হিসেবে সেচযন্ত্রের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার পরও যদি সম্পূর্ণ আওতায় না আসে তাহলে আমরা সেই সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করব। বোরোর আবাদ অনুযায়ী ৯০ শতাংশের বেশি জায়গা সেচযন্ত্রের আওতায় আনা গেছে। পানির সংকট সমাধানে খাল খনন, গভীর নলকূপ স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’