বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বিভাগীয় শহর ব্যতীত বেশির ভাগ জেলা শহরে একটি করে সরকারি মহাবিদ্যালয় ছিল। এ সব মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা স্নাতক অবধি লেখাপড়া করতে পারত। সে সময় বেশির ভাগ জেলা শহরে মহিলাদের জন্য পৃথক কোনো সরকারি মহাবিদ্যালয় ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে প্রতিটি থানা পরবর্তীতে উপজেলা হিসেবে খ্যাত শহরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা মহাবিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যদিও ছাত্রদের মহাবিদ্যালয়ে মহিলাদের অধ্যয়ন বারিত নয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যাও সীমিত ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জেলা, থানা তথা উপজেলা শহরে দ্রুত বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের তুলনায় মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে শিক্ষার্থী অনেক বেশি। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মহাবিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে সম্মান (অনার্স) নিয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ মহাবিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বলা হয়।
বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ছয়টি। এর মধ্যে চারটি ছিল সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থীরা মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। অপর দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এ সবগুলোই সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত গণবিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বেশির ভাগ পুরনো জেলা শহরে সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত গণবিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
বিগত শতকের নব্বই দশক থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া হলে ধীরে ধীরে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বর্তমানে এমন কোনো জেলা শহর নেই যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা এর শাখার অস্তিত্ব নেই। রাজধানী ঢাকা শহরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অগণিত। বর্তমানে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করে বের হয় এর অতি অল্প সংখ্যকের চাকরির সাথে অধ্যয়নকৃত বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকে। তাছাড়া পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে পাস করা পরবর্তী দীর্ঘদিন চাকরির অপেক্ষায় থেকে দুর্বিষহ বেকার জীবন অতিবাহিত করতে হয়। শিক্ষা গ্রহণ পরবর্তী এমন অনেক শিক্ষার্থী ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে সফলতা পেতে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় পতিত হয়। আবার এরূপ অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায়। সেখানে তারা যেসব পেশায় কর্মে নিয়োজিত হয় তা তাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নয় এবং বেশির ভাগই অনেকটা বাধ্য হয়ে বেমানান কাজ করে জীবিকার পথ বেছে নেয়। এর বাইরে অগণিত সংখ্যক শিক্ষার্থী বিপুল অর্থ ব্যয়ে উচ্চা শিক্ষা গ্রহণ-পরবর্তী কোনো চাকরির ব্যবস্থা করতে না পেরে দেশের অভ্যন্তরে এমন পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয় যা কোনোভাবেই তার শিক্ষাজীবনে লব্ধ জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত নয়।জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করে পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ সফলতা পেয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হলো জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। এসব দেশে বিভিন্ন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করে বের হয় তাদের প্রত্যেককেই বিষয়ভিত্তিক পেশায় চাকরির সুযোগ করে দেয়া হয়। চীনে কোনো এক সময় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে চাকরির সুযোগ সৃষ্টিতে অন্তরায় দেখা দেয়। সে সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ বছরের জন্য উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ বারিত করা হয়েছিল। এ সব দেশে সাধারণ ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান লাভ পরবর্তী বিষয়ভিত্তিক পেশায় প্রবেশ করতে চাইলে অনায়াসে তাদের সে সুযোগ ঘটে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতি বছর যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এর তুলনায় যে সংখ্যক শিক্ষার্থী মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয় তা খুবই অপ্রতুল। এ সব শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান না থাকার কারণে তারা স্বউদ্যোগে কিছু করে উপার্জনক্ষম হওয়ার পথে সফলতা পেতে বাধার সম্মুখীন হয়। আবার বেশির ভাগেরই স্বউদ্যোগে কিছু করে উপার্জনক্ষম হওয়ার জন্য যে পুঁজির প্রয়োজন তার অভাব থাকে।
উচ্চ মাধ্যমিক অবধি অধ্যয়ন-পরবর্তী যে সব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাগ্রহণার্থে মহাবিদ্যালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এদের উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের পেছনে অভিভাবকরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এসব শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষানুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পেশায় চাকরি না পেলে সে শিক্ষা অনেকটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ সব শিক্ষার্থীকে কিছুটা কারিগরি জ্ঞান দিয়ে সাধারণ শিক্ষাগ্রহণে তাদের পেছনে ব্যয়িত অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা দেয়া হলে তাদের বেশির ভাগই যে সফলতার মুখ দেখতে পারবে এ বিষয়ে আমাদের অর্থনীতিবিদরা আশাবাদী। আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব বড় শিল্পগোষ্ঠী রয়েছে এদের গুটিকয়েক সাধারণ ভোগ্যপণ্য যেমন- চানাচুর, মসলা, মুড়ি, সরিষার তেল প্রভৃতির পাশাপাশি বড় ধরনের শিল্পপণ্য উৎপন্ন করে থাকে। আবার এদের অনেকে ভূমি ও আবাসন ব্যবসার সাথে জড়িত। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ছোট ভোগ্যপণ্য বা শিল্পপণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করলে ছোট বা ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়। বড় ধরনের শিল্পগোষ্ঠীগুলো ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় প্রবেশের আগে এসব ব্যবসায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল। বর্তমানে এসব ব্যবসায় টিকে থাকা এদের জন্য দুরূহ হয়ে দেখা দিয়েছে, অপর দিকে বড় শিল্পোদ্যোক্তারা এসব ব্যবসায় প্রায় তাদের নিরঙ্কুুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। মাধ্যমিক পূর্ববর্তী ও মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে থাকে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার কারণে ভর্তিচ্ছু অনেকেই অধ্যয়নের সুযোগ পায় না। এ ব্যাপারে আমাদের সরকার ও এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষানুরাগীকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে যেসব বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এগুলোর বেশির ভাগকেই প্রতিষ্ঠাকালীন জনহিতকর মর্মে আখ্যা দেয়ার প্রয়াস নেয়া হলেও কিছুকাল না যেতেই দেখা গেল ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে সামনে রেখেই অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি এগুলো প্রতিষ্ঠায় ব্রত হয়েছেন।
আমাদের দেশ ও বিদেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি লোক বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মে নিয়োজিত। এদের একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের বেশির ভাগই অদক্ষ। এরা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন বেমানান কাজে নিয়োজিত। এদের অনেকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এরা সেখানে বর্তমানে যে মজুরিতে কাজ করছেন তাতে বিদেশ গমনে ব্যয়িত অর্থ উপার্জনে অন্যূন দুই-চার বছর লেগে যায়। অথচ এ সব ব্যক্তি এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে নিজ দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায় শুরু করলে তাদের আয়-উপার্জন বিদেশের চেয়ে যে অধিক হতো তা অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমাদের দেশে বর্তমানে চার-পাঁচ লাখ ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন কারিগরি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, এরা প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে উপার্জিত যে পরিমাণ অর্থ তাদের নিজ দেশে প্রেরণ করে তা আমাদের দেশের বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের প্রেরিত অর্থের এক-চতুর্থাংশ। এ দেশে কর্মরত ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কানদের মতো সমযোগ্যতাসম্পন্ন এ দেশীয় লোকের অভাব নেই কিন্তু আমাদের এক শ্রেণীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের চেয়ে ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কানদের নিয়োগ দিতে পারলে নিজেদের গর্বিত মনে করেন। এদের দেশ্রপ্রেম-বিবর্জিত মানসিকতার কারণে দেশ আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন।
বাংলাদেশ জনবহুল দেশ এবং এখানে বেকার সমস্যা প্রকট। এ দু’টি বিষয়কে মাথায় রেখে আমাদের সরকার এমন ধরনের শিক্ষানীতি গ্রহণে সচেষ্ট হবে যাতে শিক্ষার্থীদের যে পর্যায়েই শিক্ষার সমাপ্তি ঘটুক না কেন, তা যেন শিক্ষানুযায়ী কর্মে প্রবেশের জন্য সহায়ক হয়। আমাদের যেকোনো শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের যে বিষয়টির ওপর প্রাধান্য দিতে হবে তা হলো শিক্ষার পেছনে ব্যয়, পরিবারের সামর্থ্য ও চাকরি প্রাপ্তির সক্ষমতা। যেসব পরিবারের পক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার ব্যয়ভার বহন সম্ভব নয় সে সব পরিবারের শিক্ষার্থীরা এ পর্যায়ে এসে কর্মে প্রবেশে সচেষ্ট হলে অথবা নিজ উদ্যোগে কিছু করার প্রয়াস নিলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতো তার চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করেই এরা স্বাবলম্বী হওয়ার পথে আত্মপ্রত্যয়ী হবে।
জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বা উপাদান ছোট ছোট শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। আমাদের বড় ও মাঝারি যে সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এরা সবাই যদি তাদের শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ ও উপাদান ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাহলে এ দেশে প্রতি বছর অগণিত সংখ্যক ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তার জন্ম হবে। আর তাই আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের দ্বার অবারিত রেখে বেকার সৃষ্টির পথ সুগম করা হবে নাকি কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করে শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা দেয়া হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক E-mail: iktederahmed@yahoo.com