দেশের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্যাক্স রিটার্নসহ তাদের ‘সম্পদ ও দায়’-এর বিবরণী দাখিল করার বিধান রেখে উত্থাপিত হয়েছে নতুন আয়কর আইন-২০২৩। গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘আয়কর বিল ২০২৩’ জাতীয় সংসদে তোলেন। পরে বিলটি পাঁচ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে এতদিন কোনো আয়কর আইন ছিল না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আয়কর আরোপ, আদায়, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করা হতো ১৯২২ সালের ভারতীয় ইনকাম ট্যাক্স অনুযায়ী। পরে ১৯৮৪ সালে সেটি সংস্কার করে একটি ইনকাম ট্যাক্স অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যা এতদিন পর্যন্ত চালু আছে।
‘এই দাবি বহুদিন যাবত যে আমাদের নতুন আয়কর আইন লাগবে,’ বলছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘১৯২২ সালের ভারতীয় আইন যেটা পাকিস্তান আমলেও চলেছে। এরপর ১৯৮৪ সালে একটা অর্ডিন্যান্স হয়। কেননা তখন পার্লামেন্ট ছিল না। সেই থেকে একথা চলছে যে এটাকে আইন করতে হবে এবং সেটা বাংলায়।’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফেরও নির্দেশনা ছিল নতুন আয়কর আইন প্রণয়নের। অর্থমন্ত্রী এর আগে তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা কমিয়ে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজ করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় যুগপোযোগী ও আধুনিক করে আয়কর আইন-২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এ আইন প্রণয়নের আগে তা নিরপেক্ষভাবে যথেষ্ট যাচাই বাছাই করে দেখা হবে কি না তা নিয়ে অনেকের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এগুলো মধ্যে কয়েকটি দেখে নেয়া যাক : আয়কর রিটার্ন দাখিলের নতুন ৫টি খাত: গত ১ জুন বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, আয় না থাকলেও একজন টিআইএনধারী ব্যক্তিকে আয়কর সনদ নিতে হলে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।
এতদিন সেই সনদ দিয়ে ৩৮ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা নেয়া যেতে। যার মধ্যে আছে ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিট কার্ড, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, বিভিন্ন লাইসেন্স ইত্যাদি। নতুন আইনে এর সাথে নতুন করে আরো ৫টি খাত যুক্ত করা হয়েছে।
সেগুলো হলো : ১. রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, গাজীপুর ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে গঠিত কর্তৃপক্ষ বা অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিল।
২. স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে।
৩. ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও চালু রাখতে।
৪. নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের এবং
৫. নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সেবা বা পণ্য গ্রহণকালে ওই পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হবে।
কর নিবন্ধন বাতিল: নতুন আয়কর আইনে টিআইএন বাতিলের সুযোগও রাখা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আছে :
১) ব্যক্তি যদি পরপর তিন বছর করযোগ্য আয় শূন্য হন এবং শারীরিক অক্ষমতার কারণে বা অন্য কোনো কারণে ভবিষ্যতে তার আর করযোগ্য আয় হবে না
২) মারা গেলে বা কোনো কারণে অস্তিত্বহীন হলে
৩) স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ত্যাগ করলে এবং বাংলাদেশে কোনো আয় উপার্জক কোনো কর্মকা- না থাকলে
কোম্পানির সংজ্ঞায় পরিবর্তন: ১৯৯৪ সালে সবশেষ কোম্পানির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছিল, অর্থাৎ কাদের কোম্পানি বলা যাবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল।
বর্তমানে যেসব কোম্পানি বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উৎসে কর কাটে, তাদের বছরে দু’বার করের বিস্তারিত জানিয়ে এনবিআরে রিটার্ন জমা দিতে হয়। এখন থেকে বিদেশী অফিস বা বিদেশী ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সমিতি, সমবায় সমিতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ইত্যাদি কোম্পানি হিসেবে ঘোষিত হবে।
সম্পদের বিবরণী: নতুন আইনে অন্যসব প্রস্তাবনার মধ্যে যাদের ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ আছে, তাদের ‘সম্পদ ও দায়’ এর বিবরণী বাধ্যতামূলকভাবে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বছরের যেকোনো সময় চিকিৎসা বা ধর্মীয় কারণ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পদবিবরণী জমা দিতে হবে। বছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে জীবনযাত্রার ব্যয়বিবরণীও জমা দিতে হবে। আর সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা আবশ্যিক করা হয়েছে। এছাড়া কোনো করদাতা যদি দেশের বাইরে সম্পদ কেনেন, তাহলেও তাকে সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। কোনো কোম্পানির শেয়ারধারী পরিচালক হলেও সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। উৎসে কর কর্তন সম্পর্কিত রিটার্ন: দেশে ব্যবসা পরিচালনা করার খরচের কথা মাথায় রেখে বর্তমান আইন থেকে প্রস্তাবিত আইনে কর্তনযোগ্য ব্যবসায়িক ব্যয়ের একটি বিস্তারিত তালিকা দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুসারে, মাত্র ১২টি উৎসে কর্তিত করের রিটার্ন জমা দিতে হবে, যা আগে ছিল ২৯টি।
এছাড়া পুরো প্রক্রিয়া সহজ করতে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর রিটার্ন দাখিল, রিটার্ন প্রসেস ও রিটার্ন অডিট সংক্রান্ত বিধানাবলীর আন্তর্জাতিক মানদ- নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে নতুন প্রস্তাবিত আইনে।
জরিমানার বিধান: প্রস্তাবিত আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে আয়কর ফাঁকি দিলে বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ-ের বিধান রাখা হচ্ছে। জরিমানার পরিধিও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এতে দেরিতে রিটার্ন দেয়ার জরিমানা বাড়ানো হচ্ছে।
এছাড়া দেশের কারো বিদেশে সম্পদ থাকলে, তা যদি কর কর্মকর্তারা প্রমাণসহ জানতে পারেন, তাহলে ওই সম্পদের বিপরীতে জরিমানা আরোপ করার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
আয়কর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব: অডিট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আনার জন্য এবং কর কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা কমানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বোর্ডের কর্মকর্তারা কী করতে পারবেন তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। একই সাথে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে আইনে। প্রস্তাবিত আয়কর আইন নিয়ে সমালোচনা: সরকার বলছে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই কর ফাঁকি ঠেকাতে এবং আদায়ের লক্ষ্য শতভাগ অর্জনে নতুন আইনে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে, এখন সেটি পাসের অপেক্ষায়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এ আইনটি অনুমোদনের আগে করদাতাদের মতামত মূল্যায়ন করা জরুরি ছিল। এটার সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে, ‘যারা আইনটি বাস্তবায়ন করবে সেই রাজস্ব বোর্ডই এই আইনটি তৈরি করেছে।’
‘যেহেতু এটা সর্বজনীন হবে। তাই এটা এনবিআর বা বিদেশী কাউকে দিয়ে করলে হবে না, তারা ড্রাফট করতে পারে, এরপর সেটাকে নিরপেক্ষ কোনো সংস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সার্বজনীন আইনে পরিণত করবে এটাই প্রত্যাশা,’ বলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ।
অনেকেরই প্রশ্ন, কোনো কারণে যদি কেউ এই আইনের জন্য অহেতুক ভোগান্তির শিকার হন, তাহলে এর দায় কে নেবে? মজিদ বলেন, এর সমস্ত দায় এনবিআরকেই নিতে হবে। ‘এটি যেন ভ্যাট আইনের মতো ভাগ্যবরণ না করে আর আর প্রতি বছর যাতে সংস্কার করতে না হয়। আইন বারবার পরিবর্তন করা হলে মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে। আপনারা ভালো জিনিস দেখাচ্ছেন কিন্তু খারাপাটা দেখাচ্ছেন না- এটা যাতে না হয়।’
আইনটি অনুমোদনের আগে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ ভোগান্তি এড়াতে আয়কর প্রদানের নিয়মও সহজ করার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। নয়ত এ আইন খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে বলে মত তাদের।
বৃহস্পতিবার সংসদে বিলটি উত্থাপন করে অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বিলটি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এরপরও সংসদীয় কমিটি ও সংসদে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বিলটি পাসের আগে সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা যাবে। বাংলায় খসড়া করা নতুন আয়কর আইন ১৯২২ সালের আয়কর আইন সংশোধন করে প্রণয়ন করা বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর স্থলাভিষিক্ত হবে। তবে একইসাথে এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করাটাও জরুরি মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা, যা বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) অংশীদারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তারা। সূত্র : বিবিসি