বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় যেসব মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলস, দইয়ের পাত্র, খেলনা বা ভাপা পিঠার পাতিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিল, তা এখন প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের আধুনিক সামগ্রীর দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় কঠিন সময় পার করছেন দেশের হাজারো মৃৎশিল্পী। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, নুরনগর, কাশিমাড়ী, নওয়াবেকী, খানপুর ও শংকরকাটি গ্রামগুলোতে একসময় কুমারদের কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চরকা ঘুরিয়ে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, ফুলের টব, দইয়ের পাতিলসহ নানা সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন তারা। সেই চিত্র এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মৃৎশিল্পীদের অনেকেই বেকার হয়ে গেছেন, সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সরেজমিনে নুরনগর গ্রামের তৃষ্ণা রানীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, আগের মতো মাটির জিনিস তৈরির চাহিদা নেই। বাজারে এগুলোর দাম কম, অথচ লাকড়ি ও মাটির দাম বেড়েছে অনেকগুণ। আগে চরকা দিয়ে পণ্য বানানোর যে আনন্দ ছিল, তা এখন শুধুই স্মৃতি। মাটির জিনিস বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সাবিত্রী পালও একই দুর্দশার কথা জানালেন। তার একমাত্র মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়লেও টাকার অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি ও তার স্বামী গত ১৫-১৬ বছর ধরে মৃৎশিল্পের কাজ করলেও এখন আর তাতে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই তারা বিকল্প পেশার কথা ভাবছেন। সমীর পাল তার বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে মোটর গ্যারেজে কাজ শুরু করেছেন। তার ভাষায়, আগে ভালো আয় হতো, এখন মানুষ আর মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনে না। তাই সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে গ্যারেজে কাজ করছি।” একইভাবে স্বরসতী কর্মকারও মৃৎশিল্প ছেড়ে মোবাইল ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশের দোকান খুলেছেন। তার মতে, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের আধুনিক সামগ্রীর সহজলভ্যতা এবং কম খরচের কারণে মাটির জিনিসের কদর কমে গেছে। তাই জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পেশা বদলাতে হয়েছে। প্রযুক্তির বিকাশ, ভোক্তাদের পরিবর্তিত রুচি ও বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারার কারণে মৃৎশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটে। আধুনিক টেকসই পণ্যের দাপটে মাটির জিনিসের কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে ঘরে ঘরে মাটির হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহার করা হতো, এখন তার জায়গা নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের পাত্র। মৃৎশিল্পীরা মনে করেন, সরকারি সহায়তা পেলে হয়তো এই শিল্প কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, মাটি ও লাকড়ি কেনার খরচে ভর্তুকি এবং বিপণনের সুযোগ তৈরি করা হলে তাদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে। নুরনগর গ্রামের মাধুরি রানী আফসোস করে বলেন, সরকার যদি একটু সাহায্য করত, তাহলে হয়তো আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পেশা একদিন হারিয়ে যাবে। একসময়ের সমৃদ্ধ মৃৎশিল্প এখন নিঃশেষ হতে চলেছে। কুমারপাড়ার কর্মব্যস্ততা রূপ নিয়েছে নীরব হাহাকারে। বাংলার এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে এখনই প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। নতুবা কয়েক দশক পর মৃৎশিল্প শুধুই ইতিহাস হয়ে থাকবে।