আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বড় দুই দলের সংলাপের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে কর।ে আলোচনার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। তবে সেই আলোচনার উদ্যোগ কে নেবে, এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে যার যার অবস্থানে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এই অবস্থান একধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আলোচনা বা সংলাপের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। তবে সেই আলোচনার উদ্যোগ কে নেবে, এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে। সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করার কথা বলে আসছে বিএনপি। দলটি রাজপথেই ফয়সালার কথা বলছে। তবে গত গত শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা পথ বের করতে হবে। বিএনপি নেতার এই বক্তব্য দলটির আগের অবস্থান থেকে কিছুটা ভিন্ন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।
মির্জা ফখরুলকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা সংলাপ করতে রাজি আছেন কি না। এরপর আমরা বিবেচনা করব। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার সচিবালয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা সংলাপ করতে রাজি আছেন কি না। এরপর আমরা বিবেচনা করব। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রপতি একবার ডেকেছিলেন, নির্বাচন কমিশন দুইবার তাঁদের ডেকেছে, তাঁরা আসেননি। তাঁদের মনোভাবটা (অ্যাটিচিউড) কী, সেটা আগে জানান।’
দুই দলই আলোচনার দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে নিতে রাজি নয়। একে অপরের দিকে দায় চাপাতে চাইছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, মূলত আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-দুই দলের জন্যই একধরনের চাপ তৈরি করেছে ভিসা নীতি। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দলগুলোর চাপ আরও বাড়তে পারে, সেটা দুই দলই বিবেচনায় রেখেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও রাজনৈতিকভাবে তাঁরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে। এমন পরিস্থিতি বিএনপির জন্য সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেই কেবল আলোচনা হতে পারে। বিএনপির নেতারা বলছেন, এবার তাঁরা এই সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে চান না। সে জন্য রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার পক্ষপাতী তারাঁ। তবে আন্দোলনে সংঘাত বা সহিংতা এড়ানো যাবে কি না, এসব বিষয়ও তাঁদের আলোচনায় রয়েছে।
পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের বিষয়টিও বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের কারও কারও চিন্তায় রয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পদক্ষেপের কারণে সরকার বড় চাপে পড়েছে। ফলে সংকটের সমাধান না হলে সরকারের জন্য বিপদ আরও বাড়াতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে চাপ বাড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা যায় কি না, সে আলোচনাও বিএনপিতে রয়েছে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সংলাপে যোগ দিয়েছিল বিএনপি। সেই সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি—এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময় দলটির নেতারা করেছেন। পুরোনো সেই অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বিএনপি নেতাদের অনেকে সরকারের সঙ্গে এবার আর কোনো সংলাপ নয়-এমন অবস্থানে রয়েছেন। তবে দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আলোচনা হতে পারে। সেই আলোচনার ভিত্তি হবে নির্দলীয় সরকার।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সংকটের সমাধান করার দায়িত্ব এখন সরকারের। সরকারকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেই কেবল আলোচনা হতে পারে। সেই আলোচনায় নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা গঠন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা হতে পারে।
বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনুধাবন করলেও আগে তাদের দাবি মানার বিষয়টি সামনে এনেছে। অন্যদিকে সংবিধানের বাইরে আওয়ামী লীগ যাবে না, আগের সেই অবস্থানেই অটল রয়েছে দলটি। এ ছাড়া বিএনপি আলোচনায় আগ্রহের কথা না জানালে সরকার নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেবে না, মন্ত্রীরা এমন বক্তব্য ধারাবাহিকভাবেই দিয়ে আসছেন। গতকালও সাংবাদিকদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেছেন।
দুই দলের মধ্যে আলোচনার বিষয়ে লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটানোর মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি করতে পারেনি বিএনপি। ফলে আলোচনা এবং রাজপথে থাকা দুই পথেই থাকতে হবে দলটিকে। সংকটের সমাধান রাজপথে কতটা করা সম্ভব হবে, সেটি বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে সেটি আওয়ামী লীগকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে দলে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদককে এই বিষয়ে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিয়েছেন কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়। আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধানের ভেতরে থেকে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি আলোচনা বা সংলাপ চাইলে সেটা হতে পারে। তবে সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা সম্ভব না–ও হতে পারে, এমন আলোচনাও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে রয়েছে।