ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছেছেন। গতকাল শুক্রবার (১৪ জুলাই) বাস্তিল দিবসের প্যারেডে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রধানমন্ত্রী মোদির সম্মানে বিশেষ নৈশভোজেরও আয়োজন করছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদির এই ফ্রান্স সফরে বেশ কতগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রকে উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করেছে, ফ্রান্স থেকে আরো ২৬টি রাফাল জেট এবং তিনটি স্করপিওন ক্লাস সাবমেরিন কেনার প্রস্তাবে ভারতের ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল ইতোমধ্যেই সম্মতি দিয়েছে।
এই ২৬টি রাফাল জেটের মধ্যে ২২টি হবে একক আসনের রাফাল মেরিন এয়ারক্রাফট আর বাকি চারটি টুইন-সিটার ট্রেনার এয়ারক্রাফট। এর আগে ২০১৬ সালে ফ্রান্সের দাসো এভিয়েশন থেকে মোট ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। সেই চুক্তিতে বিরাট অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিল কংগ্রেসসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো কিন্তু পরে দেশের সুপ্রিম কোর্ট ওই অভিযোগ খারিজ করে দেয়। যদিও ফ্রান্সে এখনো ওই অভিযোগ নিয়ে সমান্তরাল তদন্ত চলছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের মোট যে ৩৬টি রাফাল জেট পাওয়ার কথা ছিল কয়েক কিস্তিতে তার সবগুলোরই ডেলিভারি হয়ে গেছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে যখন ৩৬তম তথা শেষ রাফালটি ভারতে পৌঁছায় তখন আমিরাতে সেটির রিফিউয়েলিংয়ের ছবি পোস্ট করে ভারতের বিমানবাহিনী টুইট করেছিল, ‘দ্য প্যাক ইজ কমপ্লিট!’ তবে শেষ ডেলিভারির মাত্র ছয়-সাত মাসের মধ্যেই ভারত আবার ফ্রান্স থেকে নতুন করে ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমানের অর্ডার দিতে যাচ্ছে-যে সিদ্ধান্তকে সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
‘এগুলো নৌবাহিনীর প্রয়োজন’: কেন ভারত নতুন করে আরো একপ্রস্ত রাফাল জেট কেনার সিদ্ধান্ত নিল, বিবিসি বাংলার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেটাই ব্যাখ্যা করেছেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, এয়ার চিফ মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) অরূপ রাহা। যখন ভারত সরকার ২০১৬ সালে ৩৬টি রাফাল কেনার জন্য চুক্তি করে, তখন তিনিই বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
অরূপ রাহা বলেন, ‘প্রথম যখন রাফাল জেট কেনার কথাবার্তা শুরু হয়, তখন তো ১২৬টা পাওয়ার কথা ছিল। সেই জায়গায় চুক্তি হয়েছে মাত্র ৩৬টার, ফলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজন এখনো পুরোটা মেটেনি। এখন এয়ারফোর্সকেও তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ফাইটার জেট দিতে হবে, সেটা রাফাল না-হলেও কোনো ফোর পয়েন্ট ফাইভ জেনারেশন অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট হতে হবে-যা দুনিয়ার সেরা। কিন্তু আপাতত এই যে নতুন ২৬টা রাফাল এগুলো এয়ারফোর্স নয়-কাজে লাগানো হবে ভারতের নৌবাহিনীতে।’
অর্থাৎ কিনা, এই রাফাল জেটগুলো নৌবাহিনীর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ডেক থেকে টেক-অফ বা ডেকে ল্যান্ডিং করতে পারবে। সামুদ্রিক পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হবে এগুলোর বডি আর ইঞ্জিন।
এয়ার চিফ মার্শাল অরূপ রাহার কথায়, ‘একটা নৌবাহিনীকে তখনই সত্যিকারের থ্রি-ডাইমেনশনাল ফোর্স বলা যায়, যখন সেটি ওয়ারশিপ (যুদ্ধজাহাজ), আন্ডার-ওয়াটার সাব (জলের তলায় সাবমেরিন) আর এয়ার এলিমেন্ট (আকাশে যুদ্ধ করার ক্ষমতা)-এই তিনটি বিভাগেই চূড়ান্ত পারদর্শিতা অর্জন করে।’ ভারতীয় নৌবাহিনীর বহরে রাফাল জেটের অন্তর্ভুক্তি-যেগুলো আইএনএস বিক্রান্ত বা আইএনএস বিক্রমাদিত্যের মতো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে অপারেট করতে পারবে-সেটিকেও পরিপূর্ণ একটি ‘ত্রিমাত্রিক বাহিনী’তে পরিণত করবে বলে তিনি মনে করছেন।
কিন্তু আবার রাফাল-ই কেন? ভারতের কাছে যুদ্ধবিমান বিক্রি করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশই যে আগ্রহী, প্রতিরক্ষা জগতে এ কথা সুবিদিত। রাফালের সাথে এক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৮-য়ের কিন্তু আপাতত এই রাউন্ডে রাফালই ভারতে বাজিমাত করতে চলেছে। এয়ার চিফ মার্শাল অরূপ রাহা মনে করেন, এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফ্যাক্টর রাফালের পক্ষে গেছে। এর একটা হল, আগে থেকেই ভারতের কাছে ৩৬টি রাফাল জেট আছে বলে ভারতীয় বাহিনী এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত। আর দ্বিতীয় কারণটা- ফ্রান্স রাফালের ক্ষেত্রে বহুলাংশে ভারতে ‘টেকনোলজি ট্রান্সফার’ বা প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছে।
বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু ৩৬টা রাফাল আগে থেকেই ভারতে আছে, তাই যখন সেগুলোরই নৌ-সংস্করণ আমরা কিনব তখন ‘ওয়েপন্স ম্যাচটা অনেক সহজ হবে।’ ‘অর্থাৎ কিনা রাফালে যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে, মোটামুটি সেগুলোরই রকমফের আমাদের নৌবাহিনীও ব্যবহার করতে পারবে।’
‘আসলে একটা ওয়েপন্স সিস্টেম কিনলেই তো শুধু হলো না সেটার রক্ষণাবেক্ষণ, সার্ভিসিং ও সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করাটাও ভীষণ জরুরি। এটাকেই বলে ‘ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট’, যা অনেক সময় ভীষণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে,’ বলছিলেন তিনি। ভারতীয় নৌবাহিনীও যদি রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে তাহলে আগের অভিজ্ঞতার সুবাদে এই ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টটা বেশ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
‘সোজা কথায় রাফাল থাকলে নৌবাহিনীর অস্ত্র বাছাই বা ওয়েপন সিলেকশনটা কমন পড়বে। যুদ্ধে তাদের যেটা অ্যান্টি-শিপিং রোল, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের জাহাজকে আক্রমণের ক্ষমতা-সেটা তাতে অনেক বৃদ্ধি পাবে,’ বলছিলেন অরূপ রাহা।
ভারতেই করা যাবে সার্ভিসিং: তবে ভারত সরকার যে আরো একবার রাফাল কেনার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পেছনে দ্বিতীয় কারণটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আর সেটা হলো ফ্রান্স এক্ষেত্রে ভারতের মাটিতে অনেকটা প্রযুক্তি হস্তান্তরে রাজি হয়েছে।
একটা দেশ যখন অন্য দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনে তখন সাথে তার প্রযুক্তিও হস্তান্তর করে কি না বা কতটা করে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। যা বহু কেনাকাটার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। ধরা যাক, আমেরিকা থেকে কোনো দেশ যদি এফ-সিক্সটিন কিনেও তার প্রযুক্তিতে অ্যাকসেস না পায়, তাহলে সেই যুদ্ধবিমানের অতি ছোটখাটো ত্রুটি সারাতেও মার্কিন মুলুক থেকে তাদের বিশেষজ্ঞদের উড়িয়ে আনতে হবে বা সেই জেটটাকেই আমেরিকা নিয়ে যেতে হবে। ‘ঠিক এখানেই রাফাল একটা বাড়তি সুবিধা পেয়েছে কারণ ভারতের মাটিতেই তাদের কমপক্ষে দুটা সার্ভিসিং ফেসিলিটি আছে। সেখানে রাফালের হ্যাঙ্গার, ফিক্সচারস, রিপেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা ও ল্যাবরেটরি সবই আছে,’ বলছিলেন অরূপ রাহা।
তিনি আরো জানাচ্ছেন, ‘রাফালের মতো এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলো এতটাই স্টেট অব দ্য আর্ট যে এগুলোর এলআরইউ (লাইন-রিপ্লেসেবল ইউনিট), রাডার বা ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টে সব কিছুর জন্যই হাতের কাছে তার ল্যাবস থাকাটা খুব দরকার।’ ভারতের মাটিতেই ফরাসি সংস্থা দাসো এভিয়েশন ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর সাথে মিলে সেটা গড়ে তুলেছে বলেই এই রাফাল জেটগুলোর ‘লাইফটাইম ম্যানেজমেন্ট’ অনেক সহজ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এয়ার চিফ মার্শাল অরূপ রাহার মতে, এটা অবশ্য এমনি এমনি হয়নি ক্রেতা হিসেবে ভারত তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়েই এই জিনিসটা সম্ভব করে তুলেছে।
তার কথায়, ‘দেখুন, সারা দুনিয়া জানে শত শত কোটি ডলার খরচ করে আমরা ওয়েপন্স সিস্টেম কিনতে বেরিয়েছি। এখন আমরা তো নিছক সাধারণ খদ্দের নই বরং এত বড় অঙ্কের ক্রেতা বলেই আমাদের একটা আলাদা লিভারেজ থাকতে হবে। আর এখানে ঠিক সেটাই হচ্ছে।‘ রাফাল যুদ্ধবিমানগুলোর ইঞ্জিন প্রযুক্তি, ওয়েপন্স প্রযুক্তি যখন পুরোপুরি হস্তান্তর হবে এবং ভারতেই সেগুলোর এমআরও (মেইনটেন্যান্স, রিপেয়ার, ওভারহলিং) হাব গড়ে উঠবে তখন ভারত আরো বেশি করে রাফাল কেনার দিকে ঝুঁকবে বলেই বিমানবাহিনীর এই সাবেক প্রধান মনে করছেন।
ভারতীয় সেনার প্রায় ৭০ বছর আগে রাশিয়ায় নির্মিত মিগ সিরিজের যুদ্ধবিমান কেনার মধ্যে দিয়ে তাদের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ৮০ দশকে ফ্রান্সে নির্মিত মিরাজ যুদ্ধবিমানের মধ্যে দিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ফরাসি সহযোগিতার পর্ব শুরু হয়। যা এখন দ্বিতীয় রাউন্ডের রাফাল জেট সমঝোতার মধ্যে দিয়ে আরো প্রসারিত হতে চলেছে। সূত্র : বিবিসি