মোহাম্মদ শামি অবিশ্বাস্য সব রেকর্ড গড়েছেন, অথচ এই বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচে দলের একাদশে সুযোগ হয়নি তার। এরপর তিন ম্যাচ খেলেই শামি চলমান বিশ্বকাপের শীর্ষ উইকেট শিকারিদের দৌড়ে শামিল হয়ে গেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক হয়েছেন। সাবেক ফাস্ট বোলার জহির খান ও জাভাগাল শ্রীনাথের নেয়া ৪৪ উইকেট পার করে শামির উইকেট সংখ্যা এখন ৪৫। ৪৪ উইকেট নিতে জহির খান ও শ্রীনাথের লেগেছে যথাক্রমে ২৩ ও ৩৩ ইনিংস, শামি ৪৫ উইকেট নিয়েছেন ১৪ ইনিংস বল করে। এই ১৪ ইনিংসে শামি চারবার চার উইকেট ও তিনবার পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন।
সেরা বোলিং ফিগার ১৮ রানে পাঁচ উইকেট। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ১০ উইকেট শিকারির তালিকায় আছেন মোহাম্মদ শামি, এই ১০ জনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো গড় তারই, ১২.৯১।
চলমান ২০২৩ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে শামির গড় ৬.৭। শামির প্রশংসা এখন ভারতজুড়ে, গত ম্যাচের পর ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘শামির বল এখন খেলাই যাচ্ছে না, অবিশ্বাস্য।’ সাবেক ক্রিকেটার বীরেন্দ্র শেবাগের লেখেন, ‘ওয়াংখেডেকে ওয়াকা বানিয়ে দিয়েছে।’ ওয়াকা অস্ট্রেলিয়ার পার্থের বিখ্যাত মাঠ, ঐতিহাসিকভাবেই ফাস্ট বোলাররা সেখানে সুবিধা পেয়ে থাকে এবং ব্যাটারদের জন্য অস্বস্তিকর মুহূর্ত তৈরি হয় ওই মাঠে। গত বৃহস্পতিবার রাতে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের বিপক্ষে ভারতের বোলিং দেখে শেবাগের ওয়াকার কথা মনে পড়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রথম পাঁচজন ব্যাটার মিলে তুলেছেন ২ রান। ৩০২ রানের জয় পেয়েছে ভারত, ভারতের করা ৩৫৭ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা ৫৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। এটাই টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে কম রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ড।
দু’বছরে জীবন বদলে গেছে: মোহাম্মদ শামিকে ‘জেনুইন ম্যাচ উইনার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফ। ম্যাচ শেষে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা বলেন, ‘পরপর দু’ম্যাচে ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের সিম বোলাররা নিজেদের কোয়ালিটির প্রমাণ দিয়েছে। উইকেটে যদি সুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে তারা আরো ক্ষুরধার হয়ে যাবে।’
প্রথম তিন ম্যাচে একজন অতিরিক্ত ব্যাটারের জন্য শামিকে একাদশে রাখা হয়নি, ক্রিকবাজের আলোচনায় ভারতের সাবেক ক্রিকেটার পার্থিব পাটেল বলেন, ‘শামি, বুমরাহ, সিরাজ থাকলে অতিরিক্ত ব্যাটারের প্রয়োজন আপনি অনুভবই করবেন না।’ দু’বছর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মোহাম্মদ শামি গড়পড়তা পারফর্ম করার পরে ভারতের নেটিজেনদের একটা অংশ তার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছিল, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ধর্ম সম্পৃক্ত ঘৃণার বার্তা। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল, এরপর ভারতের দলে মোহাম্মদ শামিকে লক্ষ্যবস্তু করে অনলাইন আক্রমণ দেখা গিয়েছিল। অনেকেই লিখেন, শামিকে যেন ভারত থেকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
তখন ভারতের সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটাররা শামির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তৎকালীন অধিনায়ক ভিরাট কোহলি সংবাদ সম্মেলনে এসে শামিকে আগলে রাখার কথা বলেন এবং দলীয় পরাজয়ের দায় পুরো দলের বলে উল্লেখ করেন। কিংবদন্তী ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, ইরফান পাঠানদের সাথে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররাও মোহাম্মদ শামির পাশে দাঁড়ান, ভারতের সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন শামির প্রতি সম্মান দেখায়। আর ওই শামিই এখন ভারতের ক্রিকেটে সাফল্য উদযাপনের কেন্দ্রে আছেন।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্ক: শুধু সমর্থকদের দুয়োধ্বনি ও ভালোবাসা নয়, শামির ক্যারিয়ারজুড়েই বিতর্ক ও নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল সঙ্গী। ২০১৬ সালে শামি তার তৎকালীন স্ত্রীর সাথে তোলা একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘সুন্দর কিছু মুহূর্ত।’ কিন্তু এ ছবিটির ওপর কিছু লোক তাদের মন্তব্যে শামিকে ‘ইসলাম অনুসরণ করার’ এবং ‘তার স্ত্রী যেন হিজাব এবং শালীন পোশাক পরেন তা নিশ্চিত করার’ পরামর্শ দেন। এরপর ক্ষুব্ধ ক্রিকেটার জবাব দেন, ‘আমি জানি আমার পরিবারের জন্য আমাকে কী করতে বা না করতে হবে।’ পরবর্তীতে একটা সময় শামির স্ত্রী হাসিন জাহানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, শামির স্ত্রী শামির বিরুদ্ধে নির্যাতন ও ব্যাভিচারের অভিযোগ তুলেছিলেন ২০১৮ সালে।
হাসিন জাহান যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই সময় অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। একই সাথে মোহাম্মদ শামি সাথে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন মেয়ের কথোপকথনের স্ক্রিনশট ও তাদের ছবিও প্রমাণ হিসেবে দিয়েছিলেন। ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে হাসিন জাহান আরো জানিয়েছিলেন, তার ওপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার এখন এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি রাস্তা নেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। তখন শামি একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। পরে ২০১৯ সালে শামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, তবে ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (বিসিসিআই) কখনোই এই বিষয়ে শামির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৮ সাল থেকে চলমান এই মামলা এখনো ভারতের কোর্টে চলছে, এই বিশ্বকাপের এক মাস আগে সেপ্টেম্বরেও শামি কোর্টে গিয়ে জামিন নিয়ে এসেছেন ভারতীয় মুদ্রায় দুই হাজার রুপিতে।
‘ভারত ক্ষিপ্র একটা দল’: চলতি বিশ্বকাপের টানা সাত ম্যাচেই জয় পেয়েছে ভারত। ২০১৫ থেকে ২০২৩- তিন বিশ্বকাপে মাত্র তিনটি হার, সব মিলিয়েই ভারত ওয়ানডে ফরম্যাটে গত দেড় দশকের শীর্ষ দলগুলোর একটি। তবে এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের আলাদাভাবেই মেলে ধরেছে ভারত।
যেমন ভারতকে মনে করা হয়ে ঐতিহাসিকভাবেই ব্যাটিং নির্ভর দল, কিন্তু এই দলের বোলাররাও বিশ্ব মানের, বিশ্বসেরা বললেও বাড়াবাড়ি হবে না বলছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার শোয়েব আখতার।
শোয়েব আখতার ভারতীয় সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এবার তোমরা তোমাদের বোলারদের নিয়ে কথা বলো, ব্যাটারদের নিয়ে তো সবসময়ই বলো।’ শোয়েব আখতারের মতে, ভারত এখন ক্ষিপ্র একটা দল।
গত ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১২৯ রানে অলআউট করে দেয়ার পর এবার শ্রীলঙ্কাকে ভারত ৫৫ রানে অলআউট করেছে। ২০২৩ সালেই শ্রীলঙ্কা ভারতের বিপক্ষে জানুয়ারি মাসে ৭৩, সেপ্টেম্বর মাসে ৫০ এবং নভেম্বর মাসে ৫৫ রানে অলআউট হলো। বলিউড তারকা আয়ুষ্মান খুরানা বৃহস্পতিবার ম্যাচ দেখতে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেডে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন, তিনি শ্রীলঙ্কার এই দশা দেখে কষ্ট পেয়েছেন বলে যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন। তিনি লেখেন, ‘১৯৯৬ সালে জয়সুরিয়া ও কালু (কালুউইথারানা) শ্রীলঙ্কাকে উড়ন্ত শুরু এনে দিতেন প্রথম ১৫ ওভারে। ভারত দু’বার খুব বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, একবার কোটলায় প্রভাকর ফাস্ট বোলিং থেকে স্পিন করা শুরু করলেন, বেদম ব্যাটিং থেকে বাঁচতে।’
আয়ুষ্মান খুরানা মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৬ সালে ভারত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এতটাই খারাপ খেলেছিল যে সেমিফাইনালে ইডেন গার্ডেন্সে ম্যাচ বন্ধ রাখতে হয়েছিল একটা পর্যায়ে, সমর্থকরা মেনে নিতে পারছিল না ভারত এত খারাপ খেলছিল। খুরানার মতে, ২০২৩ সালে সেটার মুদ্রার বিপরীত পার্শ্ব দেখতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। তিনি মনে করেন, শ্রীলঙ্কার এই দলটার রদবদল প্রয়োজন অনেক। সূত্র : বিবিসি