বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ পূর্বাহ্ন

পরিবেশ তৈরির আগে নির্বাচন নয়

শাহ্জাহান সাজু:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অভিমত 
গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে দেশ অচল। অথচ নির্বাচন কমিশন যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপও করেছে। ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানালেও সংলাপে অংশ নেয় মাত্র ২৬টি দল। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ দলও আসেনি। আবার যারা সংলাপে অংশ নেন তাদেরও অনেকে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ঘোরতর সংশয় প্রকাশ করেছেন। কোথায় সিটি নির্বাচন স্থানীয় পুলিশের এসপি করে দিয়েছে, পুলিশ কিভাবে ভোট জালিয়াতি করে, পুলিশ ও দলীয় লাঠিয়ালরা ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যে থাকে না এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন সংলাপে অংশ নেয়া একাধিক নেতা। যে নেতারা পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট তাদের সন্তুষ্টির কারণ সহজে বোধগম্য। জাতীয় নির্বাচনে কিংস পার্টির ভূমিকা সবার জানা। দল ভেঙে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া এরশাদের সময়ে যেমন, ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময়ও দেখা গেছে। বর্তমান সরকারের সময়ও চেষ্টা হয়েছে প্রবলভাবে। বিএনপি ভেঙে নতুন দল হয়েছে, বিএনপির কিছু নেতাকে ভাগিয়ে নিয়ে নতুন দলে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চলছে জোরেশোরে। সুতরাং এবারের নির্বাচনেও কিছু কিংস পার্টি মাঠে নামবে সে তো জানা কথা।
নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ নেই স্বীকার করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক যে সংকটগুলো আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা সবসময় ইতিবাচক। কিন্তু সেই সংকট নিরসন করার সামর্থ্যটা আমাদের নেই বা আমাদের সেই ম্যান্ডেটও নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারাও নিজেদের মধ্যে চেষ্টা করতে পারতেন। নির্বাচন যথাসময়েই হবে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের আগে ইসি’র লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেটি এখনো তৈরি করতে পারেনি। যদিও বর্তমান কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে দুই বছর সময় পেয়েছে।
দেশের পরিবেশ নির্বাচনের অনুকূল নয়, এ কথা স্বীকার করে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এর মধ্যে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। বলেছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের সামর্থ্য ইসির নেই। এসব কথা তার দুর্বলতার দৃষ্টান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার ইসি সরকারি ও বিরোধী দলসহ সব দলকে নির্বাচনী বিধি মেনে নির্বাচন করাতে পেরেছে। বিধি লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, প্রশাসনে, পুলিশে রদবদল করতে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পেরেছে। ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে দিতে পেরেছেন। সে জন্য ওই নির্বাচনগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখন বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমান ইসি সরকারের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার; এমন অভিযোগ আছে আগে থেকে। কয়েক দিন আগে সিইসি বলেছেন, নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে হবে, আমাদের সামনে আর কোনো অপশন নেই। স্পষ্টত তিনি সরকারের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। সরকারি দলও বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এখনকার ইসি নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশও সৃষ্টি করতে পারেনি। তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে দেশজুড়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্বিচার গ্রেফতার, নির্যাতন চলছে। একের পর এক প্রতিহিংসামূলক মামলায় সাজা ঘোষণা করা হচ্ছে। সারা দেশে দলীয় অনুগতদের পুলিশ ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো হয়েছে। এসব কর্মকা- থেকে সরকারকে বিরত রাখা দূরের কথা, টুঁ শব্দটি করতে পারেনি ইসি; বরং নিজেদের ক্ষমতা খর্বের আইন তৈরিতে সহায়তা করেছে। এমনকি এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এমন নজিরও নেই। সব মিলিয়ে বলাই যায়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা এই কমিশনের কতটুকু রয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। সে ক্ষেত্রে অপারগতা স্বীকার করার একটি অপশন কিন্তু তাদের সামনে খোলা আছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত শনিবার আলোচনায় বসেছিল নির্বাচন কমিশন। সেখানে বিএনপিসহ ১৭টি দল ইসি’র ডাকে সাড়া দেয়নি। একটি দল আলোচনায় অংশ নিতে পারেনি দলীয় কর্মসূচির কারণে। এছাড়া অংশগ্রহণ করা দলগুলোর মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক দল মনে করছে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ দেশে বিরাজ করছে না। দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীনদের জোট শরিকরাও রয়েছে। অর্থাৎ নিবন্ধিত দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দলের ভোটের প্রতি আস্থা নেই। এদিকে সংকট নিরসন করার সামর্থ্য ইসি’র নেই জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে সংলাপ করে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন যথা সময়েই হবে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন এখন এমন কথা বললেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য নির্বাচন যথেষ্ট সময় পেয়েছে। কিন্তু তারা সেটি করতে পারেনি।
শনিবার নির্বাচন কমিশনে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা ২৬টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে ১৫টি রাজনৈতিক দল। যার মধ্যে অন্তত ১২টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ), তৃণমূল বিএনপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)। এ ছাড়া জাতীয় পার্টিও আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ যেসব দল যায়নি তারা বর্তমান কমিশনের পদত্যাগ চাইছে। এসব দল একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। পাশাপাশি সংসদ ভেঙে দেয়া ও সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন করছে। এসব দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করছে না। শুধুমাত্র কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দলীয় কর্মসূচির কারণে বৈঠকে অংশ নিতে পারেনি। তারা চিঠি দিয়ে কমিশনকে বিষয়টি জানিয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক বলেন, আমরা নির্বাচনে যাব। তবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে আমরা সেই পরিবেশ চাই।
নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় যায়নি বিএনপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-(এলডিপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-(বিএমএল), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণতন্ত্রী পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।
এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছিল এমন দলও এবারের আলোচনায় অংশ নেয়নি। ওই সময় ইসি’র রাজনৈতিক সংলাপে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ৩০টি অংশ নিয়েছিল। একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নির্বাচন নিয়ে এখনো অবস্থান পরিষ্কার করেনি। তবে তারা নির্বাচনের পরিবেশ নেই এমনটি বলে আসছে। সর্বশেষ গতকাল-লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে ভোট বর্জন করেন দলটির প্রার্থী।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, নির্বাচন যদি সঠিকভাবে হয়, তবেই আমরা অংশ নেবো। যদি আমরা মনে করি, সঠিকভাবে নির্বাচন হচ্ছে না, তখন আমরা ঘোষণা দিয়েই নির্বাচন বর্জন করবো।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া ইসি’র সঙ্গে আলোচনা শেষে বলেন, যেহেতু একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, সেই অস্থিরতা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা আছে। আমরা চাই, এই শঙ্কা থেকে দেশবাসী যেন মুক্তি পায়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, পোলিং, প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একটি পক্ষের হয়ে ভোটের দিন কাজ করলে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে জড়িত ১৩৭ জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছিলাম আমরা। তবে কমিশন এ নিয়ে কোনো কিছু জানায়নি। মরহুম ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গড়া দল তৃণমূল বিএনপি’র মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশনকে আরও কাজ করতে হবে। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আলম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যেভাবে দায়িত্ব চাপিয়েছেন, তাতে ফেরেশতারা ছাড়া আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী মোকাবিলা করে নির্বাচনে টিকে থাকা সম্ভব না।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন আর দেখতে চায় না। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) সভাপতি এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক করতে কমিশনকে বলা হয়েছে। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পরিবেশ দেশে নেই।
রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, পরিবেশ তৈরির আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার করলে দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তার দায় কমিশন এড়াতে পারবে না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com