দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের বড় প্রাদুর্ভাব হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। তবে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু মৃত্যু নয়, আক্রান্তেও আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর ডেঙ্গুর এই প্রকোপ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু, তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। ডব্লিউএইচও জানায়, প্রতি বছর বিশ্বের ১০০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের দিক থেকে সবার শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় অবস্থানে পেরু, আর তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। তবে আক্রান্তে বাংলাদেশ তৃতীয় হলেও মৃত্যুতে শীর্ষে অবস্থান করছে।
২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি জানায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিলে। ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে ২৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর মৃত্যু হয়েছে ৯১২ জনের। সে হিসাবে মৃত্যুহার ০.০৪ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পেরুতে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৯ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৪২৪ জন। এতে দেশটির মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ০.২ শতাংশে।
এই তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা দেশ বাংলাদেশে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দুই লাখ ৪০ হাজার ৯৭ জন আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ২১৪ জনের। এতে করে মৃত্যুর সংখ্যা ও হারে সবার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে মৃত্যুহার ০.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের পর মৃত্যুহার বেশি ফিলিপাইনে। দেশটিতে ৮০ হাজার ৩১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের বিপরীতে মৃত্যু হয়েছে ২৯৯ জনের। মৃত্যুহার ০.৪ শতাংশ।
এশিয়া, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, আফ্রিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে ডেঙ্গু আঞ্চলিক (বহফবসরপ) রোগ হিসেবে পরিচিত। এই রোগের বিস্তৃতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া এবং পশ্চিম প্যাসিফিক অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটেছে। তবে শুধু মধ্যে এশিয়াতেই বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী। এদিকে শীতের আগমনে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমেছে ঢাকায়। তবে ঢাকার বাইরে এখনো ঢাকার তুলনায় তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুতে এক হাজার ৪১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৭৯৪ জন ডেঙ্গুরোগী। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৮১ হাজার ৬৯৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক লাখ এক হাজার ৫৬৭ জন, আর ঢাকার বাইরের এক লাখ ৮১ হাজার ১৩১ জন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে তিন কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। এক. আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুহার নির্ণয় করা হয়নি। দুই. প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে না পারা। তিন. মেডিকেল কলেজের বাইরে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি।
টিআইবি জানায়, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রতিবারই ডেঙ্গুর মৌসুম বর্ষাকাল এলে সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নেয়। তবে কার্যকরী উদ্যোগ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে ডেঙ্গুকে মৌসুমি ধরা হলেও গত বছর থেকে এবছর বিরতিহীনভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশের মানুষ। তাই সামনের বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের বড় ধরনের ঝুঁকি আসার আগেই সারাদেশে ডেঙ্গু নিধন কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। পৃথিবীর নানা দেশ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশা নিধনের জন্য কমিটি রয়েছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্রতি ওয়ার্ডে ২৫০ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ার্ড কমিটির ওপরে থাকা বরো কমিটির অধীনে দুটি করে র্যাপিড অ্যাকশন টিম রয়েছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় সফল ওলবাকিয়া প্রযুক্তি। ব্রাজিলে আছে তথ্যভা-ার ‘সিনান’, ভিয়েতনামের ‘ই-ডেঙ্গু’ সফটওয়্যার, সিঙ্গাপুরে নির্মাণকাজ তদারকি করা হয়। তবে বাংলাদেশে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনাও উপেক্ষিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত সমন্বিত ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ নির্দেশনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে চারটি পদ্ধতির কথা বলা হয়। সেগুলো হলো- জৈবিক ব্যবস্থাপনা: ব্যাকটেরিয়া, উলবাকিয়া মশার মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ। রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগ। যান্ত্রিক প্রদ্ধতি: মশা মারার ট্রাপ প্রায়োগ। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা: মশার প্রজননস্থল ধবংস করা। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমলেও পরবর্তী বছরের জন্য কী করা উচিত- জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শীতকাল আসায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেকটা কমেছে। তবে এতে খুশি হওয়ার কারণ নেই। সামনের বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়লে এবং ডেঙ্গুর নতুন ধরনে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে। তাই প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মশা জরিপ, হটস্পট চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া, ডেঙ্গু সার্ভেইল্যান্স প্রক্রিয়া সম্পর্কিত নির্দেশনা আরও জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘শীতকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে না- এমনটিই ধারণা করা হয়। কিন্তু বিগত বছরে দেখা যায় শীতকালেও রোগী পাওয়া গেছে। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ধারণা করা হলেও এখন সারাবছর ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। সামনের বছর এটি আরও বাড়তে পারে। তবে সামনে বছরও ডেঙ্গুর একই ধরনে (সেরোটাইপ-২) আক্রান্ত হলে রোগী কমে যাবে। কিন্তু ধরন বদলে সেরোটাইপ-১ বা সেরোটাইপ ৪ দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে।’-জাগোনিউজ২৪.কম