আমরা মানুষেরা ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়ে পতিত হচ্ছি মহাক্ষতিগ্রস্ততায়। বিশেষ করে পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার শিকার হওয়ার মৌলিক কারণ যথাযথ ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং তা অবলম্বনে লিখিত সঠিক পুস্তকাদি বক্তব্য বা আলোচনা ইত্যাদি। বিশ্বের সব মানুষসহ সব প্রাণী মহাবিশ্বের স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক পালন করে তার বিধানাবলি। এ অবস্থার প্রধান কারণ ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। এ ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব একাধিক কারণে যথা- ১. অভিভাবকগণের চিন্তাধারা এবং পার্থিব জীবনকে পারলৌকিক জীবনের ওপর প্রাধান্যপ্রদান, ধোঁকাবাজ পৃথিবীর ধোঁকায় আক্রান্ত হয়ে। ২. সামাজিকপ্রথা যা আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্রিক যা সাধারণত ব্যয়বহুল ফলে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষামুখী দেশে-বিদেশে। পক্ষান্তরে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের অভিভাবকগণ সাধারণত তাদের সন্তানদের পাঠান ধর্মীয় শিক্ষা লাইনে পড়াশোনা করার জন্য যথা কওমি বা আলিয়া মাদরাসা। এ ধরনের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে লিল্লাহ বোর্ডিং-এর ব্যবস্থা থাকায় অনেক অভিভাবকই সন্তানদের তথায় ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ করতে আর্থিক দিক থেকে উৎসাহব্যঞ্জক হন কারণ তা ব্যয়বহুল নয়। তাই অসচ্ছল পরিবারের অভিভাবকগণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদেরকে ভর্তি করিয়ে থাকেন। আমাদের দেশেও অধিকাংশ আলেমগণ আর্থিক দিক থেকে তুলনামূলক অসচ্ছল। কারণ তারা সাধারণত সংযুক্ত থাকেন মসজিদ-মাদরাসায়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের ন্যায় অফিস-আদালত বা সরকারি চাকরিতে তাদের স্থান কদাচিৎ। পার্থিব জীবনে তারা আল্লাহমুখো এবং প্রাধান্য দেন পরকালকে পার্থিব জীবনের ওপর আল্লাহর বিধান মতে। তাই তারা অল্পে তুষ্ট, চাহিদা কম, মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই তাদের জীবনযাপন সীমাবদ্ধ। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম আছে যা কদাচিৎ। আলেমে দ্বীনগণ সত্যিকার সম্পদে সম্পদশালী অর্থাৎ তারা ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী। আমি বিশ্বাস করি ধর্মীয় জ্ঞান মানুষের সর্বোত্তম সম্পদ। জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:, সাহাবায়ে কেরামগণ, ইমাম আবু হানিফা র:, ইমাম আহাম্মদ ইবনে হাম্বল র:, ইমাম শাফেয়ী র:, ইমাম মালেক র:, তেমনি করে মুফাচ্ছিরে কুরআনগণ, ধর্মীয় বক্তাগণ, পীরে-কামেলগণ, মুফতিগণ, ড. জাকির নায়েক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, রাবেয়া বসরী, বিবি আছিয়া প্রমুখ। ইসলাম ধর্ম আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও মনোনীত ধর্ম অন্য কোনো ধর্ম নয় (৬১০ সালের পরে)। প্রমাণ আল্লাহর বাণী : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৯)।
এ জন্যই মহান আল্লাহ আদেশ করেছেন অর্থ: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের শত্রু’ (সূরা আল-বাকারা : ২০৮)।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীগণ ‘মুসলিম’ নামে পরিচিত। মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন যথাযথ আল্লাহভীরু বা মুত্তাকি হতে। প্রমাণ আল্লাহর বাণী : ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো যেমনিভাবে তাকে ভয় করা উচিত। তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’ (সূরা আলে-ইমরান : ১০২)।
আলোচ্য আল্লাহর বাণীসমূহ হতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, আমাদেরকে অবশ্যই হতে হবে মুত্তাকিন এবং পরিপূর্ণ মুসলিম। পাশাপাশি অবশ্যই হতে হবে পরিপূর্ণ মুমিন। প্রমাণ আল্লাহর আদেশ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ঈমান আন বা বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি (আল-কুরআনে প্রতি) যা তিনি তাঁর রাসূলের ওপর নাজিল করেছেন এবং সেসব কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাজিল করেছেন ( অর্থাৎ তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল তিনটি বড় কিতাব এবং ১০০ খানা ছোট কিতাবসহ মোট ১০৩ খানা পূর্ববর্তী কিতাব)’ (সূরা আন-নিসা : ১৩৬)। উল্লেখ্য, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধন এবং শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আল্লাহর স্বীকৃতি পাওয়ার শর্ত তিনটি : প্রমাণ আল্লাহর বাণী : ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে আবির্ভূত করা হয়েছে, ১. তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং ২. অসৎ কাজ হতে নিষেধ করো ও ৩. আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো’ (সূরা আলে-ইমরান : ১১০)। আলোচ্য আদেশ হতে অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম দায়িত্ব আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। সত্যিকার অর্থে আমরা অধিকাংশ মুমিন মুসলিমগণ নানারকম কথা-বার্তা, আলাপ-আলোচনা, আদেশ-উপদেশ শুনি কিন্তু সত্যিকার ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে ভ্রান্ত ধারণার শিকার হচ্ছি। তাছাড়া পথভ্রষ্ট হচ্ছি শয়তান, জিন এবং কুমন্ত্রণা বা কুপ্ররোচনায়। তাই আল্লাহ তায়ালা আমাদের দোয়া শিখিয়েছেন সূরায়ে ফাতিহায় এবং সূরায়ে আন-নাসে, যথা- ১. ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে প্রদর্শন করুন সঠিক পথ এবং তাদের পথ যারা আপনার বিশেষ নিয়ামতপ্রাপ্ত, তবে তাদের পথ নয় যারা অভিশপ্ত এবং পথভ্রষ্ট’ (সূরা ফাতিহা : ৬-৭)।
২. সূরায়ে নাছ : (হে রাসূল!) বলুন : আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট, মানুষের অধিপতির নিকট, মানুষের প্রভুর নিকট, তার অনিষ্ট হতে যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে বারবার এসে কুমন্ত্রণা দেয়, যে কুমন্ত্রণা দেয় অন্তরে, (এই কুমন্ত্রণা হচ্ছে) জিনের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।’
উপরোক্ত আলোচনা হতে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ‘আমরা মানবজাতি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত- প্রথম দল হলো সঠিক পথ, সঠিক ধারণা এবং সত্যিকার জ্ঞানপ্রাপ্ত। পক্ষান্তরে অন্য দল ভ্রান্ত পথ, ভ্রান্ত ধারণা ও ভ্রান্তজ্ঞানপ্রাপ্ত। ভ্রান্ত পথ যথা কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের চলার পথ।
প্রসঙ্গক্রমে আল্লাহর সে বাণীটি উল্লেখযোগ্য। যথা- মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রশ্ন করেছেন : ‘যারা (ধর্মীয় জ্ঞানে) জ্ঞানী পক্ষান্তরে যারা (ধর্মীয় জ্ঞানে) জ্ঞানী নয় তারা উভয় কি কখনো সমান হতে পারে’ (সূরা আয-যুমার : ০৯)? এ প্রশ্নের উত্তর হবে নিশ্চয়ই সমান নয় বরং তাদের মধ্যে আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য। ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানীগণ আলোকোজ্জ্বল পথের পথিক এবং স্বচ্ছন্দ্যে সঠিক পথের পথিক যে পথের শেষপ্রান্তে চিরস্থায়ী জান্নাত। অন্য দিকে ধর্মীয় জ্ঞানে অজ্ঞানীরা অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং দিশেহারা বরং ঘোর অন্ধকারে ঢাকা ভ্রান্ত পথের পথিক যার শেষপ্রান্তে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। বর্ণিত কারণে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে একটি দোয়া শিখিয়েছেন- আরবি ‘রাব্বী জিদনি ই‘লমান’ যার : ‘হে আমার প্রভু (দয়া করে) বৃদ্ধি করে দাও আমার (ধর্মীয়) জ্ঞান’ (সূরা তোয়াহ : ১১৪)।
ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানীগণ মানসিক শান্তিময় জীবনযাপন করবে পার্র্থিব জীবনে ধর্মীয় বিধানাবলী পালন করে এবং অর্জন করবে মহাসফলতা তথা চিরশান্তি জান্নাত পারলৌকিক জীবনে। পক্ষান্তরে ধর্মীয় জ্ঞানহীনেরা মানসিক অশান্তিময় জীবনযাপন করবে পার্থিব জীবনে ধর্ম পালন না করার কারণে ও অর্জন করবে মহা ব্যর্থতা এবং অবর্ণনীয় কঠিন শাস্তির স্থান জাহান্নাম চিরকালের জন্য। লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ