বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশে ভঙ্গুর অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় ঝুঁকি

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

আল জাজিরার রিপোর্ট
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এরই মধ্যে বাংলাদেশের নড়বড়ে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে। এতে ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। অনলাইন আল জাজিরায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বিরোধী দল বিএনপি এবং তার মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন তদারকি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত গত দুটি নির্বাচন যথাক্রমে বর্জন করেছিল বিরোধী দল এবং মারাত্মক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ আছে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নারী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ক্ষমতার প্রায় ১৫ বছর সময়ে বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নৃশংস দমনপীড়ন চালানোর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
২০১১ সালে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এটি হলো নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন। তারা দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সামরিক স্বৈরাচারের কাছ থেকে দেশকে গণতন্ত্রে ফেরানোর জন্য কমপক্ষে চারটি নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই ক্ষমতায় এসেছে। কয়েক বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে বিএনপি। কিন্তু তাদের এ দাবির জবাব দেয়া হচ্ছে পুলিশি নৃশংসতা ও হাজার হাজার মামলার মাধ্যমে। এখন দলটি এবং তার মিত্ররা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচি দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। নভেম্বরের শুরু থেকে তারা দেশব্যাপী ধারাবাহিকভাবে অবরোধ ঘোষণা করছে। কিন্তু এসব রাজনৈতিক অচলাবস্থার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ বাংলাদেশিদেরই।
একটি ট্রাভেল এজেন্সির নির্বাহী রাহুল আমিনকে খুব কম বাস, অটোরিক্সা ও ট্যাক্সি চলার কারণে সাধারণ সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ ভাড়া দিতে হচ্ছে অফিসে যেতে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এমনিতেই গত বছর থেকে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে আমাদেরকে লড়াই করতে হচ্ছে। আর এখন এই রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির খড়গ পড়েছে বাজারে। তিনি আরও বলেন, বিরোধী দলের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির বিষয়টি আমি বুঝতে পারি। যদি এই অবরোধ অব্যাহত থাকে তাহলে পুরো অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে।
আল জাজিরা আরও লিখেছে, রাজনৈতিক উত্তেজনাকর অচলাবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই অর্থনীতি এমনিতেই কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকুচিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও শক্তিশালী মুদ্রাস্ফীতি সরকারকে এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ চাইতে চাপ দিয়েছে। সম্প্রতি এক পাবলিক ফোরামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন খুব কঠিন সময় পাড় করছি।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বছরের চতুর্থাংশ সময়কালে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি বেড়েছে ২.৮ বিলিয়ন ডলার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, পুজি এবং সেবাখাতের আমদানি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি। একই সময়ে এর কারেন্ট একাউন্ট ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৩৯ বিলিয়ন ডলার। যখন কোনো দেশ পাওয়ার চেয়ে বিদেশে বেশি অর্থ পাঠায় সেটা বুঝাতে এই টার্ম ব্যবহার করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৬৬ বিলিয়ন ডলারে। গত মাসে রপ্তানি আয়, যার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে, তা শতকরা ১৩.৬৪ ভাগ কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার। এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ২৬ মাসে এই পরিমাণ সর্বনি¤œ। রপ্তানি আয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক লাইফলাইন হলো বাইরে থেকে আসা রেমিট্যান্স। তা এ বছরের গত চতুর্ভাগে শতকরা ৪.৪ ভাগ কমে গেছে। এখন এফবিসিসি বলছে, অবরোধে প্রতিদিন বাংলাদেশের লোকসান হচ্ছে ৬৫০০ কোটি টাকা।
এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম আল জাজিরাকে বলেছেন, এই অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট-বড় সব ব্যবসা। এর আগেও আমরা দেখেছি নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক সহিংসতা কিভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করে। একই রকম সতর্কতা দিয়েছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ২০১৪ সালের মতো। ওই সময় দেশের অর্থনীতি ৭০০ কোটি ডলারে মতো ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু এখন এই ক্ষতি আরও বেশি হবে। এর কারণ, অর্থনীতি বড় এ জন্য নয়। কারণ হলো ‘বাফার’ খুব কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য শুধু রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে দায়ী করা যায় না। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলছে কমপক্ষে ১৫ মাস ধরে এবং তা চলছেই। যখন বৈশ্বিক চাপ এতে ভূমিকা রেখেছে, তখন দেশের অর্থনীতি, বিনিময় হার, আর্থিক ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়াও সহায়ক হয়নি।
করোনা মহামারির শুরু থেকে বাংলাদেশে গত জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে তিন বছর ঋণের হার শতকরা ৯ ভাগে সীমাবদ্ধ ছিল। এতে সুবিধা পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। তারা অর্থ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে রিয়েল ইন্টারেস্ট ছিল প্রায় শূন্য। ঋণের হার থেকে মুদ্রাস্ফীতি বাদ দিলে যা হয় তাকে রিয়েল ইন্টারেস্ট রেট বলা হয়। টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৃত্রিম মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতিকে। জাহিদ হোসেন বলেন, এখন রাজনৈতিক গভীর অচলাবস্থা এবং সহিংসতা হবে ক্ষতের ওপর লবণ দেয়ার মতো।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক জিয়া হাসান বলেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা স্পষ্টত অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টকে ঘিরে লড়াই এবং ডলার রিজার্ভের বিষয়টি বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর ও বহুমুখী অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করবে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থ বছরে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৯০০০ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে রপ্তানি করেছে ৫৫০০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বর্তমান অর্থনৈতিক পতনের জন্য এই শাসনামলে নিযুক্ত রাজনৈতিক অভিজাতদের একটি অভিজাততন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ব্যাংকিং, ব্যুরোক্রেসি এবং ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে।
বাংলাদেশি একটি থিংক ট্যাংক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির কারণে লোকসান হয়েছে ১০০০০ কোটি টাকা। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির ডাটা বলছে, বাংলাদেশ হারিয়েছে ৭.৫৩ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শতকরা ১৭.৯৫ ভাগ।
জিয়া হাসান আরও বলেন, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের জন্য অভিযুক্ত অভিজাতরা আর্থিক খাতে সংস্কারের বিরোধিতা করেছে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হুমকিতে না পড়ে। একটি রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া এসব অভিজাতদের নেটওয়ার্ককে বিলুপ্ত করে প্রকৃত একটি গণতন্ত্রে না ফিরলে, অর্থপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার না করলে সেই রাজনৈতিক মীমাংসা হবে না বা বাস্তবায়ন কার্যকর হবে না।
বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, ওলিগার্কিদের চক্রকে ভেঙে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করাতে তারা অবরোধ দিচ্ছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গত ১৫ বছরে সরকার এবং তার সুবিধাভোগীরা অস্বাভাবিকভাবে দুর্নীতি করেছে। এর জেরে পুরো অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং আত্মীয়করণের কারণে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে নিয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলকে এটা বোঝা উচিত যে, একগুয়েমি, নৃশংস শক্তির ব্যবহার, বিরোধদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া অপরাজেয়তা দিতে পারে। তা অর্থনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান দিতে পারে না। বিরোধী দল বা বৈশ্বিক অর্থনীতির দায় দিলে এর অবসান ঘটবে না। সমস্যাগুলোর উৎস সমাধান করা উচিত আওয়ামী লীগের। ভেঙে দিতে হবে বিভিন্ন সেক্টরে সুবিধাভোগী ছোট ছোট গ্রুপকে। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। শুধুমাত্র একটি নতুন রাজনৈতিক মীমাংসা ও জনপ্রিয় ম্যান্ডেট পারে এই কাজ করতে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com