বিশ্বকাপ ফাইনালে স্বাগতিক ভারতকে স্তব্ধ করে রেকর্ড ষষ্ঠবার শিরোপা জয় করেছে অস্ট্রেলিয়া। গতকাল ফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে দিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অসিরা। ফাইনালে একতরফা খেলে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ৬ উইকেটের বড় ব্যবধানে। আগে ব্যাট করে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে বড় টার্গেট দিতে পারেনি স্বাগতিকরা। ভারত অলআউট হয় মাত্র ২৪০ রানে। ফলে জয়ের জন্য ২৪১ রানের সহজ টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ট্রাভিস হেডের সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়া ৪৩ ওভারে ৪ উইকেটে ২৪১ রান করে ম্যাচ জিতে নেয় ৬ উইকেটে। ফলে ভারতের মাটিতে ভারতকে কাঁদিয়ে শিরোপা জয়ের উৎসব করেছে অস্ট্রেলিয়ানরা। এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য দল ছিল ভারতই। লিগপর্বের প্রায় প্রত্যেকটি ম্যাচে তারা প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে-হয় ব্যাট হাতে কিংবা বল হাতে। কিন্তু ফাইনালে এসে চরমভাবে হোঁচট খায় স্বাগতিকরা। ২৪০ রানে অলআউট হয় আগে ব্যাট করা দলটি। ফলে বিশ্বকাপে রের্কড ষষ্ঠবার শিরোপা জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া পায় ২৪১ রানের সহজ টার্গেট। ফাইনালে এই সহজ টার্গেট পেয়ে স্বাগতিকদের বেদনার নীল সাগরে ডুবিয়ে শিরোপা জয় করে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ভারতের মাটিতে ফাইনালে ভারতকে এতো সহজে হারিয়ে শিরোপা জয় করাটা হয়তো চিন্তাও করেনি দলটি। কিন্তু ফাইনালে সেটাই হয়েছে। অবশ্য ফাইনালের আগের দিনই অধিনায়ক কামিন্স গ্যালারিতে ভারতের চিৎকার স্তব্ধ করে দেয়ার কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছেন অসি অধিনায়ক। ভারতকে স্তব্ধ করেই শিরোপা জিতে নিয়েছেন। ম্যান অব দ্য ফাইনাল হয়েছেন সেঞ্চুরিয়ান ট্র্যাভিস হেড। ফাইনালে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সামনে ২৪১ রানে টার্গেটটা সহজই ছিল। কিন্তু এই সহজ টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বেশি তাড়াহুড়া করে দলটি। ফলে মোহাম্মদ শামি-জাসপ্রিত বুমরাহরার বোলিং তোপে ৪৭ রান তুলতে ৩ উইকেট হারিয়ে বসেছে অসিরা। দলীয় ১৬ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় দলটি। ৩ বলে ৭ রান করে মোহাম্মদ শামির বলে খোঁচা দিতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ আউট হন ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার। দলীয় ৪১ রানে দলটি হারায় দ্বিতীয় উইকেট। ১৫ বলে ১৫ করে জাসপ্রিত বুমরাহর শিকার হন মিচেল মার্শ। ব্যাট করতে নেমে ভালো করতে পারেননি স্টিফেন স্মিথ। মাত্র ৪ রান করে স্টিভেন স্মিথও বুমরাহর বলে এলবিডব্লিউ হলে চাপে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া। ৪৭ রানে তিন উইকেট হারানো দলকে এগিয়ে জয়ের পথে এগিয়ে নিয়েছেন ট্রাভিস হেড-মার্নাস লাবুশেন জুটি। এই জুটির উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে যায় জয়ের দ্বারপ্রান্তে। ৫৮ বলে হাফসেঞ্চুরি করা হেড সেঞ্চুরি করেন ৯৫ বলে। দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিতে হেডকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন লাবুশেন। নিজেও তুলে নিয়েছেন ফিফটি। দলীয় ২৩৯ রানে অস্ট্রেলিয়া হারায় হেডের উইকেট। তবে হেড ও লাবুশেন দেড়শ ছাড়ানো জুটিতে জয়ের পথ তৈরি করে দেন। তারা দুজনেই দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ার পথে ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্য থেকে দুই রান দূরে থাকতে আউট হন হেড। ১২০ বলে ১৩৯ রান করেন তিনি। ১৯২ রানের জুটি গড়েন দু’জন। লাবুশেন ১১০ বল খেলে ৫৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। ম্যাক্সওয়েল দুই রান নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নেন। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ৪৩ ওভারে ৪ উইকেটে টার্গেট ২৪১ রান করে ম্যাচ জিতে ৬ উইকেটে। বুমরাহ ২টি আর সামি ও সিরাজ নেন একটি করে উইকেট।
এর আগে, গতকাল ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৪০ রান করেছে স্বাগতিক ভারত। দলের পক্ষে বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল হাফ-সেঞ্চুরি করেন। রাহুল সর্বোচ্চ ৬৬ ও কোহলি ৫৪ রান করেন। অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিচেল স্টার্ক ৫৫ রানে ৩ উইকেট নেন। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে ওনোর শুভমান গিলকে নিয়ে ঝড়ো গতিতে ইনিংস শুরু করেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ৪ ওভারে দলকে ৩০ রান এনে দেন রোহিত-গিল। দলীয় ৩০ রানে ভাংগে উদ্বোধনী জুটি। মিচেল স্টার্কের বলে পুল করতে গিয়ে মিড অনে এডাম জাম্পাকে ক্যাচ দেন গিল। ৭ বল খেলে মাত্র ৪ রান করেন এই ওপেনার। গিল আউট হলেও দ্রুত রান তোলার চেস্টা করেছেন রোহিত ও বিরাট কোহলি। তবে দলীয় ৭৬ রানে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে কভার পয়েন্টে ট্রাভিস হেডের দারুন ক্যাচে বিদায় নেন ৪৭ রান করা রোহিত। আউট হওয়ার আগে এই বিশ^কাপে চতুর্থবারের মত হাফ-সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে থামলেন তিনি। ৩১ বল মোকাবেলায় ৪টি চার ও ৩টি ছক্কা মারেন ভারতীয় অধিনায়ক। দ্বিতীয় উইকেটে রোহিত কোহলি ৩২ বলে ৪৬ রান যোগ করেন। অধিনায়কের বিদায়ে উইকেটে এসে বাউন্ডারিতে রানের খাতা খুলেন গত দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করা শ্রেয়াস আইয়ার। কিন্তু আইয়ারকে এবার ৪ রানে থামান অসি দলপতি কামিন্স। ৫ বল ও ৫ রানের ব্যবধানে রোহিত ও আইয়ারকে হারিয়ে চাপে পড়ে ভারত। দলীয় ৮১ রানে প্রথম তিন ব্যাটারকে হারিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে জুটি বাঁধেন কোহলি ও লোকেশ রাহুল। উইকেট পতন ঠেকাতে সাবধানে খেলতে থাকেন তারা। এতে কিছুটা সফলও হয় দলটি। ওয়ানডেতে ৭২তম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান ৫৬ বল খেলা কোহলি। বিশ্বকাপের নক আউটের দুই ম্যাচে ৫০এর বেশি রান করার তালিকায় সপ্তম ব্যাটার হিসেবে নাম তুলেন কোহলি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে দ্বিতীয়বারের মত টানা পাঁচ ম্যাচে ৫০এর বেশি রানের ইনিংস খেললেন তিনি। এর আগে ২০১৯ আসরে এ রকের্ড গড়েছিলেন তিনি। তবে হাফ-সেঞ্চুরির পর ইনিংস বড় করতে পারেননি কোহলি। কামিন্সের বলে বোল্ড আউট হওয়ার আগে ৪টি চারে ৬৩ বল খেলে ৫৪ রানের ইনিংস। চতুর্থ উইকেটে ১০৯ বলে ৬৭ রান যোগ করেন কোহলি-রাহুল। বিশ^কাপে এবারের আসরে ১১ ইনিংসে ৭৬৫ রান করেছেন কোহলি। যা বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। কোহলির বিদায়ে উইকেটে আসেন রবীন্দ্র জাদেজা। আবারও জুটি গড়ার চেষ্টা করেন রাহুল ও জাদেজা। ওয়ানডেতে ১৭তম অর্ধশতক পূর্ণ করতে ৮৬ বল খেলেছেন রাহুল। রাহুলের অর্ধশতকের পর জাদেজার বিদায় নিশ্চিত করেন পেসার জশ হ্যাজেলউড। ২২ বলে ৯ রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন জাদেজা। রাহুল-জাদেজা জুটি ৪৪ বলে ৩০ রান যোগ করেন। এরপর সূর্যকুমার যাদবকে নিয়ে ভারতের রান ২শতে নেন রাহুল। দলের ২শতে পৌঁছানোর ওভারেই বিদায় নেন রাহুল। স্টার্কের অফ স্টাম্পের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি। মাত্র ১টি চারে ১০৭ বল খেলে ৬৬ রানের ইনিংস খেলেন রাহুল। এবারের বিশ্বকাপে ৫০এর বেশি রানের ইনিংস খেলা ব্যাটারদের মধ্যে যা সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেট। সূর্য-রাহুল ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২৫ রান যোগ করেন। দলীয় ২০৩ রানে ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে রাহুল ফেরার পর সূর্য ও টেল এন্ডারদের দৃঢ়তায় ৫০ ওভার খেলে সব উইকেট হারিয়ে ২৪০ রানের সংগ্রহ পায় ভারত। শেষ দিকে সূর্য ১৮, কুলদীপ ১০, মোহাম্মদ সিরাজ অপরাজিত ৯, মোহাম্মদ সামি ৬ ও জসপ্রিত বুমরাহ ১ রান করেন। অস্ট্রেলিয়া স্টার্ক ৫৫ রানে ৩টি, হ্যাজেলউড ৬০ রানে ও কামিন্স ৩৪ রানে ২টি ক্ের উইকেট নেন। ১টি করে উইকেট নেন ম্যাক্সওয়েল ও জাম্পা। এই প্রথম অলআউট হলো আয়োজকরা। ৫০ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে তারা করে ২৪০ রান। এই বিশ্বকাপে মোট ২৩ উইকেট শিকার করলেন জাম্পা। এর মাধ্যমে বিশ্বকাপের এক আসরে স্পিনার হিসেবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারে শ্রীলংকার মুত্তিয়া মুরলিধরনের রেকর্ড স্পর্শ করলেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত—২৪০/১০ (৫০ ওভার)
অস্ট্রেলিয়া—২৪১/৪ (৪৩ ওভার)
অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে জয়ী।