আল্লাহ ভরসা। বাক্যটি ব্যাপক পরিচিত ও প্রচলিত। কোনো কাজ সম্পাদন করার সময়, কাউকে উজ্জীবিত করতে কিংবা সান্ত্বনা দিতে এই বাক্যটি আমাদের মুখ থেকে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারিত হয়। ঈমানদারদের শ্রেষ্ঠ গুণ আল্লাহর ওপর ভরসা করা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা অপরিহার্য।
তার কোনো আধিপত্য নেই তাদের উপর যারা ঈমান আনে ও তাদের রবের উপরই নির্ভর করে (সূরা নাহল-৯৯)।
সুফিয়ান সাওরী বলেন, যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদেরকে এমন গোনাহে লিপ্ত করতে পারে না যা থেকে সে তাওবাহ করে না। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ : যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদের কাছে কোনো প্রমাণ দিয়ে টিকে থাকতে পারে না।
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট (সূরা তালাক-৩)। হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে পাখির মতো রিজিক দান করতেন। পাখি সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে’ (মুসনাদে আহমাদ-১/৩০, তিরমিজি-২৩৪৪, ইবনে মাজাহ-৪১৬৪)। আর আমার কৃতকার্যতা তো শুধু আল্লাহরই সাহায্যে; আমি তাঁরই উপর ভরসা রাখি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী (সূরা হুদ-৮৮)। অর্থাৎ, সত্য পর্যন্ত পৌঁছানোর আমার যে প্রবল ইচ্ছা, তা একমাত্র আল্লাহর তাওফিক বা সাহায্যেই সম্ভব। এই জন্য প্রত্যেক কাজে আমি আল্লাহরই ওপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি (আহসানুল বায়ান)।
মুমিনদের উচিত আল্লাহরই ওপর ভরসা করা (সূরা ইব্রাহিম-১১)। এখানে ‘বিশ্বাসীদের’ বলে উদ্দেশ্য প্রথমত নবীগণ। অর্থাৎ আমাদের উচিত, আল্লাহর উপরেই সম্পূর্ণ ভরসা রাখা। যেমন পরবর্তী আয়াতে বলেছেন, ‘আর আমরা কেন আল্লাহর ওপর ভরসা করব না, অথচ তিনিই আমাদেরকে আমাদের পথের দিশা দিয়েছেন। আর তোমরা আমাদের যে কষ্ট দিচ্ছ, আমরা তাঁর ওপর অবশ্যই সবর করব। আর আল্লাহর উপরই যেন ভরসাকারীরা ভরসা করে’। ভরসা এই যে, তিনিই কাফেরদের বদমায়েশি ও মূর্খামি থেকে রক্ষাকারী। এই অর্থও হতে পারে যে, আমাদের কাছে মুজিজা তলব না করে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত। তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মুজিজা প্রকাশ করবেন, না হলে না (আহসানুল বায়ান)।
যদি তোমরা তাঁকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য না করো তাহলে আল্লাহই তাঁকে সাহায্য করবেন যেমন তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে যখন কাফেররা তাঁকে দেশান্তর করেছিল, যখন দু’জনের মধ্যে একজন ছিল সে, যে সময় উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে স্বীয় সঙ্গীকে (আবু বকরকে) বলেছিল : তুমি বিষণ্ন হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাকে শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফেরদের বাক্য নিচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণী সমুচ্চ রইল, আর আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল প্রজ্ঞাময় (সূরা তাওবাহ-৪০)। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর হিজরতের ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়ে দেয়া হয় যে, আল্লাহর রাসূল কোনো মানুষের সাহায্য-সহযোগিতার মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে গায়েব থেকে সাহায্য করতে সক্ষম। যেমন হিজরতের সময় করা হয়, যখন তার আপন গোত্র ও দেশবাসী তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সফরসঙ্গী হিসেবে একমাত্র সিদ্দীকে আকবর রা: ছাড়া আর কেউ ছিল না। পদব্রজী ও অশ্বারোহী শত্রুরা সর্বত্র তার খোঁজ করে ফিরছে। অথচ আশ্রয়স্থল কোনো মজবুত দুর্গ ছিল না। বরং তা এক গিরি গুহা, যার দ্বারপ্রান্তে পর্যন্ত পৌঁছেছিল তার শত্রুরা। তখন গুহা সঙ্গী আবু বকর রা:-এর চিন্তা নিজের জন্য ছিল না, বরং তিনি এই ভেবে সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন যে, হয়তো শত্রুরা তার বন্ধুর জীবননাশ করে দেবে, কিন্তু সে সময়ে রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন পাহাড়ের মতো অনড়, অটল ও নিশ্চিত। শুধু যে নিজের তা নয়, বরং সফর সঙ্গীকেও অভয় দিয়ে বলছিলেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন (অর্থাৎ তাঁর সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে)। আবু বকর রা: বলেন, আমি গিরি গুহায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে ছিলাম। তখন আমি কাফেরদের পদশব্দ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি পা উঁচিয়ে দেখে তবে আমাদের দেখতে পাবে। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, যে দু’জনের সাথে আল্লাহ তৃতীয়জন তাদের ব্যাপারে তোমার কী ধারণা (বুখারি-১৭৭)।
মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে ওঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে (সূরা আনফাল-২)। মুমিনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করবে। তাওয়াক্কুল অর্থ হলো আস্থা ও ভরসা। অর্থাৎ নিজের যাবতীয় কাজ-কর্ম ও অবস্থায় তার পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা থাকে শুধু একক সত্তা আল্লাহ তায়ালার উপর (ইবনে কাসির)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের কোনো এক ব্যক্তি বনী ইসরাইলের অপর ব্যক্তির নিকট এক হাজার দিনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আনো, আমি তাদের সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর ঋণদাতা বলল, তাহলে একজন জামিনদার উপস্থিত করো। সে বলল, জামিনদার হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যিই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাজার দিনার দিয়ে দিলো। তার পর ঋণগ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোনো যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাজার দিনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জানো, আমি অমুকের নিকট এক হাজার দিনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে জামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই জামিনদার হিসেবে যথেষ্ট। এতে সে রাজি হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম, সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। তাতে সে রাজি হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার কাছে সোপর্দ করলাম। এই বলে সে কাষ্ঠখণ্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখণ্ডটি সমুদ্রে প্রবেশ করল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়তো বা ঋণগ্রহীতা কোনো নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখণ্ডটির উপর পড়ল, যার ভেতরে মাল ছিল। সে কাষ্ঠখণ্ডটি তার পরিবারের জ্বালানির জন্য বাড়ি নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছু দিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাজার দিনার নিয়ে হাজির হলো এবং বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সবসময় যানবাহনের খোঁজে ছিলাম। কিন্তু আমি যে, নৌযানে এখন এলাম, তার আগে আর কোনো নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোনো নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হতে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাজার দিনার নিয়ে ফিরে চলে এলো’ (বুখারি-২২৯১, কিতাবুল কিফালাহ)।
বিপদে-মুসিবতে আল্লাহর ওপর ভরসাই রক্ষা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এই মানসিকতা আমাদের অন্তরে লালিত হওয়া উচিত। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, যখন ইবরাহিম আ:-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্ম বিধায়ক। এ কথা ইবরাহীম আ: বলেন, যখন তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়’ (বুখারি, রিয়াদুস সালেহিন, প্রথম খণ্ড-৭৬)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সব কিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। আমাদের হেফাজতকারী। তিনিই হায়াত-মউত ও রিজিকের মালিক। আসুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি। লেখক : সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিন