শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩২ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

মানবতার চরম শত্রু ধোঁকাবাজ শয়তান

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে লোকেরা! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিতভাবেই সত্য। কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে এবং সে প্রতারক যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যপারে ধোঁকা দিতে না পারে। আসলে শয়তান তোমাদের শুত্রু, তাই তোমরাও তাকে নিজেদের শত্রু মনে করো। সে তো নিজের অনুসারীদেরকে নিজের পথে এ জন্য ডাকছে যাতে তারা দোজখিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।’ (সূরা ফাতির : ৫-৬) বড় প্রতারক হচ্ছে শয়তান। আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকা দেয়ার অর্থ হচ্ছে- শয়তান লোকদেরকে বিভিন্নভাবে প্রতারিত করে। তার প্রতারণার জালে আটকানোর জন্য সে ব্যক্তির ধরন, ব্যক্তির আদত-অভ্যাস ও স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন ধরনের ধোঁকাবাজির অস্ত্র ব্যবহার করে। সে কখনো সবাইকে একই ডা-াবেড়ি পরায় না। নি¤েœ তার ধোঁকাবাজির কিছু কৌশল আপনাদের সামনে পেশ করা হলো : সে লোকদেরকে এ কথা বুঝায় যে, আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। কিছু লোককে এ বিভ্রান্তির শিকার করে যে, আল্লাহ একবার দুনিয়াটি চালিয়ে দিয়ে তারপর বসে আরাম করছেন, এখন তার সৃষ্ট এ বিশ্বের সাথে কার্যত তার কোনো সম্পর্ক নেই। আবার কিছু লোককে সে এভাবে ধোঁকা দেয় যে, আল্লাহ অবশ্যই এ বিশ্বের ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছেন; কিন্তু তিনি মানুষকে পথ দেখানোর কোনো দায়িত্ব নেননি। কাজেই এ ওহি ও রিসালাত নিছক একটি ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ ছলেবলে কৌশলে সে মানুষকে রিসালাত অস্বীকারকারী বানায়। কিছু লোককে সে এ মিথ্যা আশ্বাসও দিয়ে চলছে যে, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান, তোমরা যতই গুনাহ করো না কেন, তিনি সব মাফ করে দেবেন এবং তার এমন কিছু পিয়ারা বান্দা আছে যাদের আঁকড়ে ধরলেই তোমরা কামিয়াব হয়ে যাবে। যতই গুনাহ করো আল্লাহর এই পিয়ারা বান্দারা তোমদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে ছাড় করে নেবেন। সে লোকদেরকে এই বলে ধোঁকা দেয় যে, আখিরাত বা পুরস্কার-শাস্তি ও জান্নাত-জাহান্নাম বলে কিছুই নেই। মরে যাওয়ার পর আমরা সবাই মাটির সাথে মিশে যাবো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তুমি যাকে পারো তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে পদস্খলিত করো। তাদের ওপর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালাও, ধনসম্পদে ও সন্তানসন্ততিতে তাদের সাথে শরিক হয়ে যাও এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেলো, আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৬৪) আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে, ঈমানের ব্যাপারে যারা হালকা বা দুর্বল, শয়তান তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বা তাদের পা পিছলিয়ে দেয়। শয়তান ডাকাতের মতো, সে তার অশ্বারোহী ও পদাতিক ডাকাত বাহিনী নিয়ে একটি জনপদে আক্রমণ করে এবং সে তার অনুগতদেরকে হুকুম দিতে থাকে, এ দিকে লুটপাট করো, সাঁড়াশি আক্রমণ চালাও এবং সে দিকে ধ্বংস করো। শয়তানের অশ্বারোহী ও পদাতিক বলতে এমন অসংখ্য জিন ও মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যারা বিভিন্ন আকৃতিতে ও বিভিন্নভাবে ইবলিসের মানববিধ্বংসী অভিযানে সহযোগিতা করছে। এরপর শয়তান ও তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকা হয়েছে। যে ব্যক্তি অর্থ উপার্জন ও তা খরচ করার ব্যাপারে শয়তানের ইঙ্গিতে নড়াচড়া করে, তার সাথে যেন শয়তান বিনা অর্থ ব্যয়ে শরিক হয়ে গেছে। পরিশ্রমে তার কোনো অংশ নেই, অপরাধ, পাপ ও দুষ্কর্মের অশুভ পরিণতিতে সে অংশীদার নয়; কিন্তু তার ইঙ্গিতে এ নির্বোধ এমনভাবে চলছে যেন তার ব্যবসায়ে সে সমান অংশীদার; বরং বৃহত্তম অংশীদার। এভাবে সন্তান তো হয় মানুষের নিজের এবং তাকে লালনপালন করার জন্য সে নিজের সব যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও সম্পদ ব্যয়ে করে কিন্তু শয়তানের ইঙ্গিতে এ সন্তানকে সে এমনভাবে গোমরাহি ও নৈতিক চরিত্রহীনতার শিক্ষা দেয় যেন মনে হয় সে একা এ সন্তানের বাপ নয়; বরং তার পিতৃত্বে শয়তানেরও শরিকানা আছে। এরপর বলা হয়েছে, শয়তান তাদেরকে মিথ্যা আশার কুহকে ভুলিয়ে রাখে এবং মিথ্যার আকাশকুসুম রচনা করে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
কিন্তু আল্লাহর প্রকৃত সচেতন বান্দার ওপর শয়তানের প্রভাব খাটে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চিতভাবেই আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবে না এবং ভরসা করার জন্য তোমার রবই যথেষ্ট।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৬৫) অর্থাৎ মানুষের ওপর শয়তান এমন কর্তৃত্ব লাভ করবে না, যার ফলে তাদেরকে জবরদস্তি নিজের পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে। শয়তান নিছক প্ররোচিত করতে ও ফুসলাতে এবং ভুল পরামর্শ দিতে ও মিথ্যা ওয়াদা করতে পারে। কিন্তু কথা গ্রহণ করা বা না করা হবে বান্দার নিজের কাজ। তারা তার পথে যেতে চাইলে বা না চাইলেও হাত ধরে তাদেরকে নিজের পথে টেনে নিয়ে যাবে… শয়তানের এমন ধরনের কোনো কর্তৃত্ব তাদের ওপর থাকবে না। দুর্বল ও শক্তিহীন সংকল্পধারী লোকেরা নিশ্চয়ই শয়তানের প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত হবে।
কিন্তু যারা আল্লাহর বন্দেগিতে অবিচল থাকবে তারা কখনো শয়তানের নিয়ন্ত্রণে আসবে না। যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং যারা পথনির্দেশনা, সুযোগ দান ও সাহায্যের ওপর আস্থা রাখবে, তাদের আস্থা ভুল প্রমাণিত হবে না। তাদের অন্য কোনো সহায় ও নির্ভরের প্রযোজ্য হবে না। তাদের পথ দেখানোর এবং হাত ধরার ও সাহায্য করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হবেন। তবে যারা নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা করে অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভর করে তারা এ পরীক্ষা পর্ব সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সে বলল : তুমি যেমন আমাকে গোমরাহিতে নিক্ষেপ করেছ তেমনি আমিও এখন তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্য ওঁৎপেতে বসে থাকব। সামনে-পেছনে ডানে-বাঁয়ে, সবদিক থেকে ঘিরে ধরব এবং এদের অধিকাংশকে তুমি শোকরগুজার পাবে না।’ (সূরা আরাফ : ১৬-১৭) এটি ইবলিসের চ্যালেঞ্জ। সে আল্লাহকে এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে এসেছে। তার এ বক্তব্যের অর্থ এই যে, তুমি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত এই যে অবকাশ দিয়েছ তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে আমি এ কথা প্রমাণ করার জন্য পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করব যে, তুমি মানুষকে মোকাবেলায় যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছ সে তার যোগ্য নয়। মানুষ যে কত বড় নাফরমান, নিমক হারাম ও অকৃজ্ঞ তা আমি দেখিয়ে দেবো।
আর শয়তান যে এখানে আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, তুমিই আমাকে গোমরাহির মধ্যে নিক্ষেপ করেছ, এর অর্থ হচ্ছে এই যে- শয়তান নিজের গুনাহের দায়দায়িত্ব আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। তার অভিযোগ হচ্ছে, আদমের সামনে সিজদা করার হুকুম দিয়ে তুমি আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছ এবং আমার আত্মাভিমান ও আত্মম্ভরিতায় আঘাত দিয়ে আমাকে এমন অবস্থার সম্মুখীন করেছ যার ফলে আমি তোমার নাফরমানি করেছি। অন্য কথায় বলা যায়, নির্বোধ শয়তান চাচ্ছিল, তার মনের গোপন ইচ্ছা যেন ধরা না পড়ে; বরং যে মিথ্যা অহমিকা ও বিদ্রোহ সে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, তাকে সে পর্দার অন্তরালে সংগোপন করে রাখতে চাচ্ছিল। এটি ছিল একটি হীন ও নির্বোধসুলভ আচরণ। এহেন আচরণের জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই মহান আল্লাহ তার এ অভিযোগের আদৌ কোনো গুরুত্বই দেননি। কিন্তু ধোঁকাবাজ শয়তান কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালত থেকে ফয়সালা শুনিয়ে দেয়ার পর তার অনুসারী মানুষদের বলবে- ‘আর যখন সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, সত্যি বলতে কী, আল্লাহ তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা সব সত্যি ছিল এবং আমি যেসব ওয়াদা করেছিলাম তার মধ্য থেকে একটিও পুরা করেনি। তোমাদের ওপর তো আমার কোনো জোর ছিল না, আমি তোমাদের আমার পথে আহ্বান ছাড়া আর কিছুই করিনি এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। এখন আমার নিন্দাবাদ করো না, নিজেরাই নিজেদের নিন্দাবাদ করো। এখানে না আমি তোমাদের অভিযোগের প্রতিকার করতে পারি আর না তোমরা আমার। ইতঃপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে শরিক করেছিলে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, এ ধরনের জালেমদের জন্য তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবধারিত।’ (সূরা ইবরাহিম-২২)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে।’ (সূরা ইনফিতার-৬) তার কারণ সম্পর্কে দুই আয়াত পরের আয়াতে বলেন, ‘কখনো না, বরং (আসল কথা হচ্ছে এই যে) তোমার শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা মনে করেছ।’ (সূরা ইনফিতার-৯) অর্থাৎ এ ধরনের ধোঁকা খেয়ে যাওয়ার অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কারণ মানুষের আমিত্ব নিজেই ঘোষণা করছে যে, তা নিজেই সৃষ্টি হয়ে যায়নি। তাদের মা-বাবাও সৃষ্টি করেনি। মানুষের মধ্যে যেসব উপাদান আছে সেগুলো নিজে নিজে একত্র হয়ে যাওয়ার ফলেও ঘটনাক্রমে তারা মানুষ হিসেবে সৃষ্টি হয়ে যায়নি; বরং এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ এই পূর্ণাঙ্গ মানবিক আকৃতি দান করেছেন। পৃথিবীতে তাদের সামনে কত রকমের প্রাণী রয়েছে, তাদের মোকাবেলায় মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর শারীরিক কাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ ও উন্নত শক্তি একেবারেই সুস্পষ্ট। সুতরাং বুদ্ধির দাবি ছিল, এসব দেখে মানুষ কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে দেবে এবং সেই রবের মোকাবেলায় কখনো নাফরমানি করার দুঃসাহস করবে না। মানুষ এ-ও জানে যে, তাদের রব কেবল রহিম ও করিম করুণাময় ও অনুগ্রহশীলই নন, তিনি জাব্বার ও কাহহার- মহাপরাক্রমশালী এবং কঠোর শাস্তি দানকারীও। এ-ও জানে যে, তাদের রব মূর্খ অজ্ঞ নন; বরং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ। জ্ঞান ও বিজ্ঞতার অপরিহার্য দাবি হচ্ছে এই যে, যাকে বুদ্ধিজ্ঞান দান করা হবে তাকে তার কাজের জন্য দায়ীও করতে হবে। যে ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দেয়া হবে সেই ক্ষমতা ইখতিয়ার সে কিভাবে ব্যবহার করেছে তার হিসাবও নেয়া হবে। সৎ-অসৎ কাজের জন্য বিচার, পুরস্কার-তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকা ইনসাফের দাবি। এসব সত্য মানুষের কাছে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। এরপরও শয়তানের ধোঁকায় পড়া মানে, পরকাল, বিচার দিবস, জান্নাত-জাহান্নাম তথা অখিরাতকেই অস্বীকার করার শামিল। কারো অধীনস্থ কর্মচারী যদি তার ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের ভদ্রতা ও কোমলতাকে দুর্বল ভেবে তার মাথায় চড়ে বসে, তখন তাকে নীচ প্রকৃতির বলে মনে করা হয়। কাজেই মানুষের প্রকৃতি এ কথা সাক্ষ্য দেয় যে, প্রভুর দয়া, করুণা ও মহানুভবতার কারণে তার চাকর ও কর্মচারীরা কখনো তার মোকাবেলায় দুঃসাহসী হয়ে যাওয়া উচিত নয়। যে জিনিসটি তাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে তার পেছনে আসলে কোনো শক্তিশালী যুক্তি নেই; বরং দুনিয়ার এই কর্মজগতের পরে আর কোনো কর্মফল জগৎ নেই, নিছক মানুষের এ নির্বোধ ধারণাই এর পেছনে কাজ করছে। এ বিভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণাই তাদেরকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে দিয়েছে। শয়তান তাদের এ গাফিলতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। ফলে তারা এখন আল্লাহর ন্যায়বিচারে ভীত হয় না এবং এটিই তাদের নৈতিক আচরণকে দায়িত্বহীন বানিয়ে দিয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com