সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ অপরাহ্ন

শিরক সবচেয়ে বড় পথভ্রষ্টতা

জাফর আহমাদ 
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৪

‘সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশি পথভ্রষ্ট কে যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব সত্তাকে ডাকে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম নয়। এমনকি আহ্বানকারী যে তাকে আহ্বান করছে সে বিষয়েও সে অজ্ঞ।’ (সূরা আহকাফ-৫)। যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য উপাস্যদের ডাকে, তাদের কাছে নালিশ বা সাহায্য প্রার্থনা করে, কিংবা তাদের কাছে দোয়া করে, অথচ তাদের আদৌ কোনো শক্তি ও কর্তৃত্ব নেই যে, তার আবেদনে কোনো প্রকার ইতিবাচক বা নেতিবাচক জবাব দেবে বা এ ব্যাপারে বাস্তব কোনো তৎপরতা চালাতে সক্ষম হবে। কিয়ামত পর্যন্ত তারা জবাব দিতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত এই পৃথিবী আছে ততদিন পর্যন্ত ব্যাপারটি স্থির থাকবে। অর্থাৎ সেসব উপাস্যের কাছ থেকে তাদের আবেদনের কোনো প্রকার জবাব পাওয়া যাবে না। কিন্তু যখন কিয়ামত হবে তখন ব্যাপারটি আরো অগ্রসর হয়ে এই দাঁড়াবে যে, সেসব উপাস্য উল্টো এসব উপাসনাকারীদের দুশমন হয়ে যাবে। পরের আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে।
আল্লাহকে বাদ দিয়ে এরা যাদেরকে ডাকে, এসব আহ্বানকারীর আহ্বান আদৌ তাদের কাছে পৌঁছে না। না তারা নিজের কানে তা শোনে, না অন্য কোনো সূত্রে তাদের কাছে এ খবর পৌঁছে যে, পৃথিবীতে কেউ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে। আল্লাহর এ বাণীকে আরো পরিষ্কার করে এভাবে বুঝুন : সারা পৃথিবীর মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া যেসব সত্তার কাছে প্রার্থনা করছে তারা তিন ভাগে বিভক্ত। এক. প্রাণহীন ও জ্ঞান-বুদ্ধিহীন সৃষ্টি; দুই. অতীতের বুজুুর্গ মানুষ; তিন. সেসব পথভ্রষ্ট মানুষ যারা নিজেরাও নষ্ট ছিল এবং অন্যদেরও নষ্ট করে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছিল। প্রথম প্রকারের উপাস্যদের তাদের উপাসনাকারীদের উপাসনা সম্পর্কে অনবহিত থাকা সুস্পষ্ট। এরপর থাকে দ্বিতীয় প্রকারের উপাস্য যারা ছিল আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী মানুষ। এদের অনবহিত থাকার কারণ দুটো। একটি কারণ হচ্ছে- তারা আল্লাহর কাছে এমন একটি জগতে আছে যেখানে মানুষের আওয়াজ সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছায় না। আরেকটি কারণ হচ্ছে- সারা জীবন যারা মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা শিখিয়েছেন তারাই এখন উল্টো তাদের কাছে প্রার্থনা করার জন্য মানুষকে বলবে। আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা তাদের কাছে এ খবর পৌঁছিয়ে দেন না। কারণ, তাদের কাছে এই খবরের চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ তাঁর সেই নেক বান্দাদের কষ্ট দেয়া কখনো পছন্দ করেন না। এরপর তৃতীয় প্রকারের উপাস্যদের সম্পর্কে যদি চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, তাদের অনবহিত থাকারও দু’টি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে- তারা আল্লাহর কাছে অপরাধী হিসেবে বিচারের অপেক্ষায় বন্দী। সেখানে দুনিয়ার কোনো আবেদন-নিবেদন পৌঁছে না। আরেকটি কারণ হচ্ছে- আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারাও তাদের এ খবর দেন না যে, পৃথিবীতে তোমাদের মিশন খুব সফলতা লাভ করেছে এবং তোমাদের মৃত্যুর পর মানুষ তোমাদেরকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। কারণ এ খবর তাদের জন্য খুশির কারণ হবে। অথচ আল্লাহ জালেমদের কখনো খুশি করতে চান না।

এ প্রসঙ্গে এ কথাও বুঝতে হবে যে, আল্লাহ তাঁর সৎ বান্দাদের কাছে দুনিয়ার মানুষের সালাম এবং তাদের রহমত কামনায় দোয়া পৌঁছিয়ে দেন। কেননা, এসব তাদের খুশির কারণ হয়। একইভাবে তিনি অপরাধীদেরকে দুনিয়ার মানুষের অভিশাপ, ক্রোধ ও তিরস্কার সম্পর্কেও অবহিত করেন। কেননা, এসব তাদের কষ্টের কারণ হয়। যেমন একটি হাদিস অনুসারে বদর যুদ্ধে নিহত কাফেরদের নবী সা:-এর তিরস্কার শোনানো হয়েছিল। কারণ তা ছিল তাদের জন্য কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু যা নেককার বান্দাদের জন্য দুঃখ ও মনোকষ্টের এবং অপরাধীদের জন্য আনন্দের কারণ হয় সে রকম বিষয় তাদের কাছে পৌঁছানো হয় না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা তাঁর ছাড়া যাদের ইচ্ছা দাসত্ব করতে থাকো। বলো, প্রকৃত দেউলিয়া তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভালো করে শুনে নাও, এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দেউলিয়াপনা।’ (সূরা জুুমার-১৫) অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির কারবারে খাটানো সব পুঁজি যদি নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে তার পাওনাদারের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, নিজের সবকিছু দিয়েও সে দায়মুক্ত হতে পারে না তাহলে এরূপ অবস্থাকেই সাধারণভাবে দেউলিয়াত্ব বলে। এখানে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের জন্য এ রূপক ভাষাটিই ব্যবহার করেছেন। মানুষ এ পৃথিবীতে জীবন, আয়ু, জ্ঞান, বুদ্ধি, শরীর, শক্তি, যোগ্যতা উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা যত জিনিস লাভ করেছে তার সমষ্টি এমন একটি পুঁজি যা সে পার্থিব জীবনের কারবারে খাটায়। কেউ যদি এ পুঁজির সবটাই এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে খাটায় যে, কোনো ইলাহ নেই কিংবা অনেক ইলাহ আছে, আর সে তাদের বান্দা। তাকে কারো কাছে হিসাব দিতে হবে না, কিংবা হিসাব-নিকাশের সময় অন্য কেউ এসে তাকে রক্ষা করবে, তাহলে তার অর্থ হচ্ছে সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং নিজের সবকিছু খুইয়ে বসল। সে দেউলিয়া হয়ে পড়ল। এটি হচ্ছে প্রথম ক্ষতি। দ্বিতীয় ক্ষতি হচ্ছে, এই ভ্রান্ত অনুমানের ভিত্তিতে সে যত কাজই করল সেসব কাজের ক্ষেত্রে সে নিজেকেসহ দুনিয়ার বহু মানুষ, ভবিষ্যৎ বংশধর এবং আল্লাহর আরো বহু সৃষ্টির ওপর জীবনভর জুলুম করল। তাই তার বিরুদ্ধে অসংখ্য দাবি এলো। কিন্তু তার কাছে এমন কিছু নেই যে, সে এসব দাবি পূরণ করতে পারে। তা ছাড়া আরো একটি ক্ষতি হচ্ছে, সে নিজেরই শুধু ক্ষতি করল না; বরং নিজের সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব ও স্বজাতিকেও তার ভ্রান্ত শিক্ষা-দীক্ষা ও ভ্রান্ত চিন্তাচেতনা এবং দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রভাবিত করে তাদের ক্ষতি করল। এ তিনটি ক্ষতির সমষ্টিকে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ক্ষতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব ও স্বজাতি তার ভ্রান্ত শিক্ষা-দীক্ষা এবং ভ্রান্ত চিন্তাচেতনা ও দৃষ্টান্ত দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয় যে, এদের সামনে সুস্পষ্ট দলিল উপস্থাপন করলেও তারা তা থেকে বিরত হয় না অথবা তাদের বিবেক-বুদ্ধি সত্যটুকু জানার পরও তারা তাদের দীক্ষাগুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ থেকে বিরত হয় না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ সেসব শিরক থেকে পবিত্র যা লোকেরা করে থাকে’। (সূরা হাশর-২৩) অর্থাৎ যারাই আল্লাহর ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও গুণাবলিতে কিংবা তাঁর সত্তায় অন্য কোনো সৃষ্টিকে অংশীদার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারা অতি বড় এক মিথ্যা বলছে। কোনো অর্থেই কেউ আল্লাহ তায়ালার শরিক বা অংশীদার নয়। তিনি তা থেকে পবিত্র।
আল্লাহ তিনি একাই রব। তাঁর ‘রুবুবিয়াতে’ কারো কোনো অংশ নেই। আর যেহেতু ইলাহ (মাবুদ) একমাত্র তিনিই হতে পারেন যিনি রব (মালিক ও প্রতিপালক) হন, তাই উলুহিয়াতেও কেউ তাঁর সাথে শরিক নেই। তিনিই একাই এ বিশ্বজাহানের স্রষ্টা। এ সৃষ্টিকর্মে কেউ তাঁর সাথে শরিক নয়। তিনি একাই পুরো বিশ্ব-রাজ্যের মালিক ও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি একাই বিশ্বব্যবস্থার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। নিজের পুরো সৃষ্টিজগতের রিজিক তিনি একাই দান করেন। সঙ্কটকালে তিনি একাই তাদের সাহায্য করেন ও ফরিয়াদ শোনেন। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের এসব কাজে আর কারো সামান্যতম কোনো অংশ নেই।
তিনি এক আল্লাহ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তাঁর আগে কেউ আল্লাহ ছিল না এবং তাঁরপরেও কেউ আল্লাহ হবে না। আল্লাহর এমন কোনো প্রজাতি নেই, যার সদস্য তিনি হতে পারেন; বরং তিনি একাই আল্লাহ এবং তাঁর সমগোত্রীয় ও সমজাতীয় কেউ নেই। তিনি এক, একক, যেখানে কোনো দিক দিয়ে একাধিক্যের সামান্যতম স্পর্শও নেই। তিনি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত কোনো সত্তা নন। তাঁর সত্তাকে দ্বিখ-িত করা যেতে পারে না। তাঁর কোনো আকার ও রূপ নেই। তিনি কোনো স্থানের গ-িতে আবদ্ধ নন এবং তাঁর মধ্যে জিনিস আবদ্ধ হতে পারে না। তাঁর কোনো বর্ণ নেই। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। কোনো দিক নেই। তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে না। সব প্রকার ধরন ও প্রকরণ মুক্ত এবং বিবর্জিত তিনি একমাত্র সত্তা, যা সবদিক দিয়েই আহাদ বা একক।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিজিক দেয়? এই শোনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীন বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্বব্যবস্থাপনা? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ। বলো, তবুও কি তোমরা সতর্ক হচ্ছো না? তাহলে তো এ আল্লাহই তোমাদের রব। কাজেই সত্যের পরে গোমরাহি ও বিভ্রান্তি ছাড়া আর কি বাকি আছে? সুতরাং তোমরা কোনদিকে চালিত হচ্ছো?’ (সূরা ইউনুস : ৩১-৩২) অর্থাৎ যদি এসবই আল্লাহর কাজ হয়ে থাকে, যেমন তোমরা নিজেরাও স্বীকার করে থাকো, তাহলে তো প্রমাণিত হলো যে, একমাত্র আল্লাহই তোমাদের প্রকৃত মালিক, প্রতিপালক প্রভু এবং তোমাদের বন্দেগি ও ইবাদতের হকদার। কাজেই অন্যেরা যাদের এসব কাজে কোনো অংশ নেই তারা কেমন করে রবের দায়িত্বে শরিক হয়ে গেল। সুতরাং বিভ্রান্তিকারী ব্যক্তি বা দল যারা লোকদেরকে সঠিক দিক থেকে টেনে নিয়ে ভুল দিকে ফিরিয়ে নেয়, তোমরা অন্ধ হয়ে ভুল পথপ্রদর্শনকারীদের পেছনে ছুটে চলো না। এ ব্যাপারে সজাগ থাকো। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com