বর্ষা মৌসুমে আগ্রাসী হয়ে উঠে যমুনা। আর শুষ্ক মৌসুম মরুভূমির মতো। চারদিকে ধু-ধু বালুচর। যেখানে একমাত্র বাহন ঘোড়ার গাড়ি যেন মরুভূমির জাহাজ।
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পশ্চিমাংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বয়ে চলছে যমুনা নদী। উপজেলাটির ছয়টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এই নদী। বর্ষা মৌসুমে যমুনার আগ্রাসী থাবায় এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার জমাজমি, বসতভিটাসহ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। অনেক জমিদার পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। অনেকে ঢাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করছে। কেউ কেউ পৈত্রিক বসতভিটার মায়া ছাড়তে না পেরে যমুনার বুকে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরে বসতি স্থাপন করে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
উপজেলার মানচিত্রের তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ইসলামপুর উপজেলার পার্থশী ইউনিয়নের পশ্চিম শষারিয়াবাড়ি, খান পাড়া, কুলকান্দী ইউনিয়নের বেরকুশা, হরিণধরা, জিগাতলা, বেলগাছা ইউনিয়নের মন্নিয়া, চর মনিয়া, বরুল, কুতুবুল্লার চর, সিন্ধুতলী, চিনাডুলী ইউনিয়নের বীর নন্দনের পাড়া, চর নন্দনের পাড়া, কুকুরমারী, পশ্চিম গিলাবাড়ী, পশ্চিম বামনা, নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের কাজলা, কাঠমা, করিরতাইর এবং সাপধরী ইউনিয়নের সবগুলো গ্রাম যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে। এ সব গ্রাম যমুনার বুকে আবারো জেগে ওঠেছে। যমুনার বুকে জেগে ওঠা ওই সব চরাঞ্চল এখন ধু-ধু বালুরচর এবং ফসলের মাঠ। নতুন করে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। বর্ষা মৌসুমে ওই সব গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের একমাত্র ভরসা স্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকা এবং শুস্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি। বেলগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চর এলাকার একমাত্র বাহন। চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য, লোকজন এবং বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে এই ঘোড়ার গাড়ি একমাত্র ভরসা।
চিনাডুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম জানান, শত শত বিঘা জমির মালিক অসংখ্য পরিবার বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। বিশেষ করে তার ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত পালোয়ান পরিবারের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের কয়েক হাজার একর জমি এখন যমুনার বুকে বালুর চর। তারা কে কোথায় আছেন বলা মুশকিল। জামালপুর শহরে দেখা হয় ওই পরিবারের সদস্য স্ট্যালিং পালোয়ানের সাথে, তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বাপ-দাদার করা একটু জমি জামালপুর শহরে ছিল সেখানে কোনো রকমে বসবাস করছি। অথচ আমাদের পরিবারের বসতবাড়িসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমি যমুনা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই সব জমি শুষ্ক মৌসুমে চর হিসাবে জেগে উঠেলেও বর্ষা মৌসুমে পানিতে সাগরের রূপ ধারণ করে।
তিনি আরো বলেন, বড় পরিবারের অনেক সদস্য। কে কোথায় কী অবস্থায় আছেন জানি না।
সাপধরী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বিএসসি বলেন, আমার বাবার নাম রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার। আমার পরিবারের শত শত একর জমি সবগুলোই যমুনার গর্ভে। আমি এখন বেলগাছা ইউনিয়নে একটু জমি কিনে বসবাস করছি। শুধু তাই নয়, সাপধরী ইউনিয়নে সম্পূর্ণ ভূমি এখন যমুনার গর্ভে বিলীন। আমাদের মতো অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়ে বিভিন্ন এলাকায় কোনো রকমে জীবন চালাচ্ছে। সাপধরী ইউনিয়ন এখন উপজেলার মূলভূখ- থেকে বিছিন্ন এক চর। সেখানে আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি ঘটলে পুলিশ পৌঁছতে দিন পেরিয়ে যায়। তবে এখন নতুন করে হাটবাজার, স্কুল-মাদরাসা এবং গ্রাম স্থাপিত হয়েছে। বর্ষায় এই ইউনিয়নের মানুষের ভরসা নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ি চালিয়ে চরাঞ্চলের পাঁচ শতাধিক পরিবার তাদের জীবন জীবিকা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য পরিবহন ও লোকজন চলাচলের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘোড়ার গাড়ি। সরেজমিনে যমুনার চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, মরুভূমির জাহাজ উটের মতো যমুনার ধু-ধু বালুর চরে একমাত্র বাহন ঘোড়ার গাড়ি।
চালক আফছার আলী, আজিজল, আব্দুল মালেক, জিয়াউল ইসলাম ও আবুল কালামের সাথে তারা নয়াদিগন্তকে বলেন, আমাদের এই চরাঞ্চলে পাঁচ শ’র বেশি ঘোড়ার গাড়ি আছে। তারা তাদের এলাকার ভাষায় বলেন, ভাই শুংনে কালে বালুর চরের মধ্যে ঘোড়া গাড়ি ছাড়া কুলকিনার (উপায়) নাই। চরের কিসসি (ফসল), মানুষজোন, দোকানের সদাই-পাতি (মালামাল) মেয়ে ছাওয়াল (মহিলা) ইস্টি/সাগাই (মেহমান) যারা আহেনে তারা মাইলের পর মালই বালুর মধ্যে হাঁটা হাঁটতে পারে না। তাগরে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে সাগাই বাড়ি নিয়ে যাই। এইযে দেহেন ধর্মমন্ত্রী সাব আইছিলো তহে আমরা ঘোড়ার গাড়ি দিয়েই এলাকায় নিয়ে বেরাইছি। এই যে দেহেন নাও ও লন্ছ এহন শুইংনে পরি আছে।