মানবসমাজকে একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতির আওতায় আনার জন্যই রাষ্ট্র প্রয়োজন। আর এ কথা সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্রের পক্ষে শুধু বল প্রয়োগ করে মানুষকে নিয়ম-নীতির আওতায় আনা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন তাদের মানসিকভাবে প্রশিক্ষণ। আর এর সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে, মানুষের অন্তরে আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিতি ও নিজের সমস্ত কাজের জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি করা।
কারণ এই অনুভূতিই মানুষকে রাতের আঁধারে এবং নির্জনতায়ও নজরদারিতে রাখে। এই অনুভূতি সর্বদা জাগ্রত রাখার জন্য নিয়মিত সালাত আদায় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইসলামে রাজনীতি হোক, অর্থনীতি হোক অথবা ইহলৌকিক অন্য কোনো বিষয়ই হোক, সেটাকে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক এবং মানুষের আত্মিক দীক্ষা থেকে আলাদা করা যায় না। নামাজ মানুষের দিলে তার একেকটি কথা ও কাজ সেই সত্তার গোচরীভূত হওয়ার চিন্তা সৃষ্টি করে, যার কাছে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হবে।
এই চিন্তাই মানুষকে মানুষ বানায় এবং তার কর্মকা- নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দাচার থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বাধিক বড় বিষয়। আর যা কিছু তোমরা করো, তা আল্লাহ খুব ভালো জানেন।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৪৫)
এ আয়াতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, নামাজ যেহেতু আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং নামাজে নিয়মিত গুরুত্ব প্রদানকারী যেহেতু এই অনুভূতিতে মুহ্যমান থাকে যে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি কাজের ব্যাপারে অবগত আছেন, এ জন্য নামাজ তাকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (তাফসিরে রুহুল মাআনি ১০/৩৬৭)
এ জন্য নামাজ দুর্নীতি, অন্যায়, জুলুম-নির্যাতনসহ সব অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখে। এতে পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের স্বল্প ব্যবহার সত্ত্বেও সমাজব্যবস্থা নিরাপত্তার চাদরে আবৃত থাকে।
অনেকে নামাজ পড়া সত্ত্বেও পাপকাজে লিপ্ত কেন
এখন যারা উপরোক্ত কথাগুলো নৈতিকভাবে মানার পক্ষে নয়, তারা উদাহরণ দিতে আরম্ভ করে—অমুক ব্যক্তি নামাজের পাবন্দি সত্ত্বেও অমুক অমুক অনৈতিক কাজে লিপ্ত। এর উত্তরে প্রথম কথা হলো : এসব উদাহরণ দেওয়ার সময় সাধারণত মানুষের মধ্যে অতিরঞ্জনের প্রবণতা কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, যাকে আমরা দেখছি, নামাজ পড়া সত্ত্বেও পাপকাজে লিপ্ত, তার নামাজে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি রয়েছে, সে নিয়মিত সঠিক নিয়মে হক আদায় করে হয়তো নামাজ পড়ছে না। তা না হলে অবশ্যই সে শুধরে যেত। এক হাদিসে এসেছে, জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক ব্যক্তি নামাজ পড়া সত্ত্বেও তার চুরির অভ্যাস আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তার নামাজ তাকে শিগগিরই চুরি থেকে বিরত করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৯৭৭৮)
একটি বর্ণনায় এসেছে, সত্যিই পরে একসময় লোকটি তাওবা করে চুরির অভ্যাস থেকে ফিরে এসেছে।
তৃতীয়ত, নামাজি ও বেনামাজিদের মোকাবেলা একটি-দুটি উদাহরণের ভিত্তিতে নয়, বেশির ভাগের ভিত্তিতে করা বাঞ্ছনীয়। বাস্তব সত্য হচ্ছে, আজও যখন বেনামাজিদের মোকাবেলায় নামাজিদের অবস্থা জরিপ করা হয়, তখন নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় নামাজিদের মধ্যে ইনসাফ, আমানতদারি ও সত্যবাদিতা বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। অথচ অবস্থা এখন এমন যে মানুষের দ্বিনি দীক্ষাদানের রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। যখন রাষ্ট্রের অধীনে ইসলামী শরিয়তের প্রয়োগ হবে, তখন নামাজ কায়েমের সঙ্গে জনসাধারণের চরিত্রগত দীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। (দেখুন : তাফসিরে রুহুল মাআনি ১০/৩৬৭, ইসলাম আওর সিয়াসি নজরিয়াত, তাকি উসমানি পৃষ্ঠা ১৮৪)
সফল রাষ্ট্রনায়কদের নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ
ওপরোক্ত কারণেই কোরআনে কারিম রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে সবার আগে নামাজ কায়েমের কথা উল্লেখ করেছে। কোরআনে কারিমে এসেছে, ‘তারা ওই সব লোক, যদি আমি তাদের ভূপৃষ্ঠে ক্ষমতা অর্পণ করি, তাহলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে বারণ করবে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪১)
এজন্য সৎ শাসকদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজ কায়েমের কথা উল্লেখ হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজকে দ্বিনের স্তম্ভ বলেছেন। সাহাবায়ে কেরামের দীক্ষার বেলায় সবার আগে রেখেছেন নামাজকে। সর্বদা নিজে নামাজের ইমামতি করেছেন এবং জীবন-পরিক্রমার সর্বশেষ দিনে নিজে ইমামতি করতে পারছিলেন না; কিন্তু সিদ্দিকে আকবার (রা.)-এর নেতৃত্বে মানুষজনকে নামাজ পড়তে দেখে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর খুলাফায়ে রাশেদিন, যাঁদের হুকুমত রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ, তাঁদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্ব ছিল নামাজের। তাঁরাও নিজেরা নামাজের ইমামতি করতেন। রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে নামাজের ইমামতির বিষয়টি এমন আবশ্যিকভাবে জড়িয়ে গেছে যে রাষ্ট্রপ্রধানের পদবিও ‘ইমাম’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
ইসলামী বই-পুস্তকে নামাজের ইমামতিকে ‘ছোট ইমামত’ এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্বকে ‘বড় ইমামত’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এমনকি খুলাফায়ে রাশেদিন অধীনদের নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপের জন্য শুধু নির্দেশই দেননি, তাঁদের পদবিগত কর্তব্যগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সাব্যস্ত করেছেন। তৎকালীন অর্ধপৃথিবীর শাসক খলিফা ওমর (রা.) গভর্নরদের এই মর্মে চিঠি লিখেছিলেন—‘আপনাদের কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নামাজ। এ জন্য যে ব্যক্তি নামাজ হেফাজত করবে এবং তার পাবন্দি করবে, সে তার দ্বিন হেফাজত করবে, আর যে নামাজ বরবাদ করবে, তার অন্যান্য কাজ আরো বেশি বরবাদ হবে।’ (মুআত্তা মালেক, হাদিস : ৬)