দীর্ঘদিন থেকে ইতিবাচক ধারায় নেই দেশের অর্থনীতির কোন সূচক। দেশের অর্থনীতির সূচক সাধারণত আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা ডলারের পর্যাপ্ততা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি-রফতানি, রাজস্ব আদায়, বিদেশি ঋণ, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থা, বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে। এর কোনটাই দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে ইতিবাচক ধারায় নেই। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সঙ্কট। কাগজে-কলমে ডলারের রেট ১১৭ টাকা। খোলাবাজারে কোথাও কোথাও ডলারপ্রতি ১২৮ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। একদিকে ডলারের সঙ্কট অন্যদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রিত আমদানি নীতির কারনে শিল্পের কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বন্ধের পথে। যার প্রভাবে শিল্পের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট শিল্প। কমছে কর্মসংস্থান। এদিকে কমে যাচ্ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধি। প্রভাব পড়েছে গার্মেন্টস-টেক্সটাইলসহ দেশের অন্যান্য শিল্প যেমন স্পিনিং, ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা, নিট পোশাক, সিমেন্ট, সিরামিক, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের শত শত কারখানা এই সঙ্কটের কবলে। বিদ্যুৎ-গ্যাস সঙ্কটে শিল্পের উৎপাদন এমনকি ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অনেকে ইতিমধ্যে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু বন্ধের পথে। ব্যবসায়ীরা সেফ এক্সিট পলিসি চাচ্ছেন। এর মধ্যে আর্থিক সংকট সামাল দিতে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি ও অগ্রগতিকে গতিহীন করে তুলবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ঢালাওভাবে কৃচ্ছ্রসাধন অর্থনীতির জন্য বিপদ টেনে আনবে। বর্তমান আর্থিক মন্দার মধ্যে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত সড়ক নির্মাণ, প্রয়োজনীয় স্থাপনা ও কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পের কাজের প্রসার ঘটানোয় গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাই অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে ঢালাওভাবে কৃচ্ছ্রসাধন করা হলে দীর্ঘ মেয়াদে কৃচ্ছ্রসাধনে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানোসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন প্রভাব পড়েনি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করলে উন্নত বিশ্বে মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে সরকার অর্থব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করছে। তবে ঢালাওভাবে না করে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক ব্যয় আছে। সেগুলোয় কৃচ্ছ্রসাধন করা গেলে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না।
গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা, ডলার সঙ্কট, রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে নি¤œমুখী হওয়া, টাকার মান গত দুই বছরে ৪৩ থেকে ৫৩ শতাংশ কমে যাওয়া, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নি¤œমুখী হওয়া, ব্যাংকে সরকারের ঋণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়া থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নি¤œগামী হওয়ায় দেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্তরা তাদের ব্যয়, খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। যা আগামীতে পুষ্টিহীন জাতি হিসেবে দেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আর এ জন্য অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ব্যাপকতর উন্নয়ন দরকার। অথচ নতুন অর্থবছরে ফের সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতে নতুন অর্থবছরে যে বরাদ্দ থাকছে, এর একটি অংশের ব্যয়ও স্থগিতের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, রাস্তা নির্মাণ, নতুন ভবন নির্মাণ, স্থাপনা ও কৃষিসহ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা। অথচ এসব খাতে ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে সরকার। খাদ্য, জ্বালানি ও সার আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার বেশি গুরুত্বের কথা বললেও অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলেছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে কৃচ্ছ্রসাধন দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে আরও বিপাকে ফেলবে। তারা বলেন, এই সময়ে সরকারকে বিলাসী হেলিকপ্টার বা অস্ত্র ক্রয় না করে অভ্যন্তরীন উৎসগুলোতে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের আর্থিকখাতকে শক্তিশালী করায় মনযোগ দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে কোন ধরণের কৃচ্ছতাসাধন না করার আহবান জানিয়েছেন তারা। কারণ এমনিতেই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ। এই সময়ে কৃচ্ছতা সাধন দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। যা অর্থনীতিকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢালাওভাবে কৃচ্ছ্রতাসাধন নয়; অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের মাধ্যমে উদ্যোক্তা মনোভাব জাগিয়ে তোলাই হওয়া উচিত বর্থমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সরকারের অন্যতম হাতিয়ার। ২০১৬-১৭-এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৯২ শতাংশ। গ্রাম ও মফস্বলে এখন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের সম্প্রসারণের ফলে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ব্যাপক অংশগ্রহণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও যার সুফল এখনও ভোগ করছে দেশ।
সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে এরই মধ্যে (২০২২-২৩) ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেকার সমস্যা ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। গ্রামা লে গ্রোথ সেন্টারের সম্প্রসারণ, কৃষির আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো সুবিধাদির কারণে মানুষ এখন ঝুঁকি সহনশীল ও বিনিয়োগপ্রবণ। বহুমুখী কৃষি কর্মকা- প্রসারিত হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের উন্নয়নের নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তীব্র গ্যাস-সঙ্কটে এ কারখানায় উৎপাদন নেমে এসেছে ৩০ শতাংশের নিচে। পরিস্থিতির চাপে মুষড়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজহার খান। বেশিকিছু বলার মতো মানসিক অবস্থায় নাই তিনি; শুধু বললেন, কী করব বুঝতে পারছি না। দোয়া করবেন, যেন শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারি। মিথিলা টেক্সটাইল টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে সচল থাকলেও নারায়ণগঞ্জের আরেকটি টেক্সটাইল কারখানা ইনটিমেট স্পিনিং মিল প্রায় বন্ধ অবস্থা। এ রকম পরিস্থিতি অধিকাংশ শিল্পের। দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট না থাকলেও অর্থনীতিসহ অন্যান্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক সংকটের অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম ও সরকারি বিভিন্ন সেবার দাম হু হু করে বাড়ছে। আর তাই এই মন্দা সময়ে দেশের প্রবৃদ্ধি সঠিক ধারায় অভ্যন্তরীন উন্নয়নের বিকল্প নেই।
অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এক নিবন্ধে বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভোক্তাদের আশাবাদ, ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি, উদীয়মান তরুণ শ্রমশক্তি, উচ্চ অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, ডিজিটাল উচ্চ গতিবেগ, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যক্তি খাতে দ্রুত বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দ্রুত বর্ধনশীল গিগ অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর মোট বিনিয়োগে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৮৫ শতাংশ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। যখন অষ্টম প বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে হাত দিই তখন বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল ৮৭ শতাংশ ও সরকারি বিনিয়োগ ছিল ১৭ শতাংশ। ভাবা যায় কি বিশাল পরিবর্তন! আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তিমত্তার এ এক সফল ভিত্তি।
প্রস্তাবিত বাজেটের (২০২৪-২৫) নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার কৃচ্ছ্র সাধনের আওতায় সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে ১৯টি খাতের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। চলতি অর্থবছরের ব্যয় ও বরাদ্দ স্থগিতের মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যা দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে জন্য বড় বাধা।
অর্থ বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জানিয়েছেন, সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। এছাড়া আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা পুরোপুরি অর্জন নিয়ে সন্দিহান আছে। এজন্য বছরের শুরু থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সহায়তা করতে পারে। যদিও তিনি বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করা ঠিক হবে না। কারণ, এতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা পড়বে। যেসব খাতে হ্রাস করলে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা হবে না, সে ব্যয় কাটছাঁট করা দরকার।