সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সব কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল রোববার বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় প্রকাশ করেন। ২৭ পৃষ্ঠার এ পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেয়া হলো। সরকার চাইলে কোটার রেশিও পরিবর্তন-পরিবর্ধন, কমানো-বাড়াতে পারবে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান জামান বলেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে। এখনো আমরা (রাষ্ট্রপক্ষ) রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পাইনি। পেলে সঙ্গে সঙ্গে রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল ফাইল করা হবে।
এর আগে গত ১১ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেয়া হলো। একইসঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ যদি অন্য কোনো কোটা থাকে, তা বজায় রাখতে নির্দেশ দেয়া হলো। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব আদেশ পাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেয়া হলো। রায়ে আরও বলা হয়, সরকার চাইলে কোটার রেশিও পরিবর্তন-পরিবর্ধন, কমানো-বাড়াতে পারবে। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটা পূর্ণ না হলে কিংবা কাউকে না পাওয়া গেলে বা পদ শূণ্য থাকলে তা সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা যাবে। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্টের রায়ের মূল অংশটুকু প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, বিবাদীরা (সরকার) যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে কোটা রিডিউস (হ্রাস), ইনক্রিজ (বাড়ানো), দ্য রেশিও অব দ্য পার্সেন্টেজ (শতকরা হার) পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবে। কোনো পাবলিক পরীক্ষায় যদি কোটা থেকে চাকরিপ্রার্থী না পাওয়া যায়, তাহলে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে প্রার্থীর মাধ্যমে তা পূরণ করতে বিবাদীদের স্বাধীনতা থাকবে। এ রায় সরকারের পরিবর্তন-পরিবর্ধনে কোনো বাধা হবে না।
২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা। এই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ৬ বছর আগে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ২রা জুন একটি কমিটি করে সরকার। ২০১৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ওই কমিটি সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয়। ওই বছরের ৩রা অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হলে সেখানে কোটা বাতিলের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। পরের দিন ৪ঠা অক্টোবর কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করেন জনপ্রশাসন সচিব। পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে। ২০২১ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিলের এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন। রিটে প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ওই বছর ৭ই ডিসেম্বর রুল জারি করেন। সে রুলে চূড়ান্ত শুনানির পর গত ৫ই জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। গত ১১ই জুলাই রায়ের কার্যকরী ও নির্দেশনা অংশ প্রকাশের পর গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হলো। এ রায়ের পর ফের কোটা বিরোধী আন্দোলনে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চারকিপ্রত্যাশীরা। এদিকে এ রায় স্থগিত চেয়ে সরকার আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে। কিন্তু চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপ না করে আবেদনটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। সে ধারাবাহিকতায় গত ৪ঠা জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। শুনানির পর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ‘নো অর্ডার’ দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলেন। রাষ্ট্রপক্ষের এই লিভ টু আপিল করার অপেক্ষার মধ্যে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে গত মঙ্গলবার (৯ই জুলাই) আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। সে আবেদনে শুনানির পর কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর (২০১৮ সালে জারি করা কোটা বাতিলের পরিপত্র) ওপর স্থিথাবস্থা দেন সর্বোচ্চ আদালত।