বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। টানা চার দিনের ছুটির শেষ দিনে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে সুন্দরবনে। কেউ এসেছেন পরিবারের সঙ্গে আবার কেউ এসেছেন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে।আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন।বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ঘিরে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই বনের সৌন্দর্য দেখতে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। তবে বন ঘিরে মানুষের যত আগ্রহ, কিছু অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা মেটাতে পারছেন না পর্যটকরা। এগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নিলে পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণ আরও আনন্দের হবে। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশ হলে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি ও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। যদিও এখন পর্যটন মৌসুম নয়, কিন্তু পূজার ছুটিতে অনেক পর্যটকের সমাগম হয়েছে সুন্দরবন। মূলত শীতকালে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। বাকি সময়টাতে স্বল্পসংখ্যক পর্যটকের দেখা মেলে সুন্দরবনে। আর বছরের বিভিন্ন ছুটির দিনেও বাড়ে পর্যটক। পূজার ছুটি কাটাতে অনেকে বেছে নিয়েছেন সুন্দরবন ভ্রমণকে। তারা বনের হিংস্র প্রাণীর ভয়কে জয় করে মেতে উঠছেন নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগে। বনের গাছপালা ও প্রাণী দেখে বিমোহিত দর্শনার্থীরা। করমজল পর্যটনকেন্দ্রে এসেছেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা শিক্ষিকা জাহানারা আফরোজ। তিনি বলেন, ‘খোলা বনে বন্যপ্রাণীর আক্রমণের ভয় তো লাগছেই। বানর, হরিণ, কুমিরসহ অনেক প্রাণী দেখেছি, খুব ভালো লেগেছে।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী আতাউর রহমান বলেন, ‘এবার নিয়ে সুন্দরবনে দুবার আসা হলো। প্রকৃতির টানে ছুটে এসেছি। প্রাণ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে খুব ভালো লাগছে।’ কুমিল্লা থেকে আসা স্কুল শিক্ষার্থী জান্নাত বৃষ্টি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাঘ দেখতে পারিনি, দেখতে পারলে ভালো লাগতো। বাঘ ছাড়া অন্যান্য পশুপাখি দেখছি।’ এদিকে, সুন্দরবন ভ্রমণে এসে আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি নানান সমস্যার দিকগুলোও তুলে ধরছেন পর্যটকরা। চাঁদপুর থেকে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস ও আমিনুল দম্পতি বলেন, ‘সুন্দরবনের স্পটগুলোতে বিদ্যুৎ নেই, তাই গরমে কষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া খাবার পানিরও কোনও ব্যবস্থা নেই, নেই হাত-মুখ ধোয়ার পানির ব্যবস্থাও। তাই আনন্দ অনেকটা নিরানন্দে পরিণত হয়েছে।’ গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর থেকে আসা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখানকার ব্যবস্থাপনা মোটামুটি, তবে আরো ভালো হতে পারতো।’ করমজল পর্যটন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটায় সুন্দরবনের পর্যটকদের আগমন বাড়তে শুরু করেছে। আর পূজার ছুটিতে পর্যটকের আগমন আরও বেশি। আমরা আগত পর্যটকদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছি। যারা একবার আসবেন, তারা বারবারই আসতে চাইবেন এখানে।পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর লাখো পর্যটক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দেখতে যান। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এ সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় দায়িত্বশীলদের সঠিক কর্মপরিকল্পনা, বন বিভাগ ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে বারবার হোঁচট খাচ্ছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন। এতে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নও ব্যাহত হয়। পর্যটকরা বলছেন, পর্যটনের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘদিনেও পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। সুন্দরবনের সড়কপথে চলাচলের তেমন কোনও ভালো ব্যবস্থা নেই। বনের ভেতর ঘুরে দেখার জন্য ওয়াকওয়ের অবস্থা তেমন ভালো না। এসব কারণেই ঠিক ওভাবে পর্যটক টানতে পারছে না সুন্দরবন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু সুন্দরবনের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই এখানে ইকোট্যুরিজমের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। যা তৈরিতে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের বিকাশে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জীববৈচিত্র্যের প্রাণ-প্রাচুর্যের কারণে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে রয?েল বেঙ্গল টাইগারের নাম। এ ছাড়া বনে আছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রাল হরিণ, কুমির, ডলফিনসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। তাই সুন্দরবন ঘিরে গড়ে তুলতে হবে ইকোট্যুরিজম। তবেই এটি বিনোদনের পাশাপাশি গবেষণার স্থান হয়ে উঠবে। বাড়বে প্রসার। পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনকে যদি সুন্দর করে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালনা করা যায় তাহলে এটি বিরাট সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে। এ ছাড়া সুন্দরবনে পর্যটককেন্দ্রিক যেসব নৌযান আছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা গেলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে না। তখন পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণ আরও আনন্দের হবে।