স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি, শোষীত মানুষের পক্ষের প্রথম দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম এ জলিলের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মুক্তিযুদ্ধের অকুতভয় বীর সেনানী ৯নং সেক্টর কমান্ডার এবং জাসদের প্রতিষ্ঠাতা মেজর এম,এ জলিল। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা। দেশের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই এম এ জলিলের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমৃত্যু কেবল দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ পূর্ণ মেয়াদে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরেও লেখক হিসেবে মেজর জলিল উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ছাত্রজীবনেই তাঁর লেখালেখির অভ্যাস ছিল। স্বাধীনতার পরে সরকারী বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের পরও অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ ছিল সোচ্চার। সরকারবিরোধী রাজপথের নানা আন্দোলনে মেজর জলিল ছিলেন সম্মুখ সারির নেতা।।অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন নেতা। মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮৯ সালের আজকের দিনে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থানকালে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অকুতভয় বীর সেনানীর মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও রূহের মাগফিরাত কামনায় গণমাধ্যমকর্মী নিবন্ধটি নূর মোহাম্মদ নূরুর লেখাটি পত্রস্থ করা করা হলো।-বার্তা সম্পাদক
১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার উজিরপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল জলিল। যিনি মেজর এম এ জলিল নামেই সমাধিক পরিচিত। তাঁর পিতা জোনাব আলী চৌধুরী ও মা রাবেয়া খাতুন। তার জন্মের তিন মাস আগেই তার পিতা জোনাব আলী মৃত্যুবরণ করেন। এম এ জলিলের শৈশব ও কৈশোর কাটে উজিরপুরে। তিনি উজিরপুর ডব্লিউবি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টে কিছুদিন চাকরি করেন। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে পড়াশুনা করতে পশ্চিম পাকিস্তানে যান তিনি। ১৯৬১ সালে সেখানকার মারি ইয়ং ক্যাডেট ইনস্টিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পাশাপাশি গ্রহণ করেন সামরিক শিক্ষা। এরপরই আব্দুল জলিল ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ট্রেনি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি বি.এ. পাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১২নং ট্যাঙ্ক ক্যাভারলি রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে তৎকালীন পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে যুদ্ধবিরতির পর পাকিস্তান একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। পরে মুলতানে কর্মরত থাকাকালে তিনি ইতিহাসে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুর হলে তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মায়ের অসুস্থতার জন্য এক মাসের ছুটি নিয়ে বরিশালে আসেন এবং মার্চে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইতিপূর্বে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার আম্রকাননে মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এম এ জি ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধের হাইকমান্ড থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুরের একাংশ, পটুয়াখালী-বরগুনাসহ ৯নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করে মেজর জলিলকে ওই সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় টরকির হাসনাবাদে। হিঙ্গলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে সেক্টর অপারেশন ক্যাম্প এবং শমসের নগরে একটা নজরদারি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। ১৮ এপ্রিলের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মেজর জলিল একটি বড় বাহিনী গড়ে তোলেন।
গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও মেজর জলিলের আরেক সৈনিকের নাম ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’। সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি ৯নং সেক্টরের কলম সৈনিক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর প্রথম প্রকাশ ৪ আগস্ট ১৯৭১। সম্পাদক নুরুল আলম ফরিদ। ৯নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারের আনুকূল্যে ও সহায়তায় বসিরহাটের হাসনাবাদ থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে এটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুজিবনগর হেড কোয়ার্টার, ৯নং সেক্টরের মুক্ত এলাকাসহ সেক্টরভূক্ত সকল ক্যাম্প ও স্থাপনায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী মানুষগুলোর জন্য একটা প্রেরণার উৎস ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত সকল এমএনএ ও এমসিএসহ সকল স্তরের জনগণ এ পত্রিকার পাঠক ছিলেন। শত আর্থিক অসুবিধার মধ্যেও ফরিদসহ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকগণ বহু শ্রম ব্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের কলমসৈনিক হিসেবে ৯নং সেক্টরের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ নিয়মিত প্রকাশ করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখ থেকে ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ বরিশাল থেকে প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে এবং পরে ১৯৯৬ সালে এটি দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ তখন একটি সাব সেক্টরের মতো ভূমিকা পালন করে। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হলে স্থানীয় লোকজন তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। লোকজন নানাভাবে আতিথ্য দেখিয়ে জলিল ও তাঁর বাহিনীকে মুগ্ধ করল। তবে দেশ স্বাধীন হলেও ব্যক্তি জলিল ভোগ করতে পারেননি স্বাধীনতার স্বাদ। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয়। ভারতীয় সেনাদের লুটপাট ও খুলনা সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশের সম্পদ পাচারের তীব্র প্রতিবাদ করাই ছিল তাঁর অপরাধ। তাঁকে ধরে প্রথমে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অবস্থিত সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে কার্যত নজরবন্দি করে রাখা হয়। মেজর জলিল ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি। ১৯৭২ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্ত হন এ বন্দিদশা থেকে। এর পরে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ দলীয় কর্মীদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন ঘেরাও অভিযানকালে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। পরে ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি লাভ করেন। তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁর বিরদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টার অভিযোগ আনে। তৎকালীন সামরিক সরকার কর্তৃক ২৫ নভেম্বর পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন। বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৮ জুলাই আদালতের দেয়া রায়ে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হন। তবে ১৯৮০ সালের ২৪ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের পর মেজর জলিল রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন এ দলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। ২৬ ডিসেম্বর দলের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তিনিই ছিলেন জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে জাসদ দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। সরকার বিরোধী রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়। মেজর জলিল ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এ নির্বাচনে সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। কিন্তু কোনো আসনেই তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। এছাড়াও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দলের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিদলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেজর জলিল ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১৯৮২ সালে ঘাটাইলের (টাঙ্গাইল) আখতারুজ্জামান খান ও মাহমুদা আখতারের তনয়া সায়মার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন মেজর জলিল। মেজর জলিলের দুই মেয়ে সারাহ জলিল ও ফারাহ জলিল। সারাহ আইন পেশায় নিয়োজিত। ফারাহ জলিলও আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। মেজর জলিলের স্ত্রী সায়মা জলিল রাজনীতির সাথে জড়িত। মেজর জলিল ১৯৮৪ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন এবং এই দলের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। লিবিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামিক সম্মেলনে তিনি যোগ দেন। লেখক হিসেবে মেজর জলিল উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। স্কুল জীবনে তিনি ‘পথের কাঙ্গাল’ ও ‘রীতি’ নামে দুটি উপন্যাস লেখেন। কিন্তু পরে এ পান্ডুলিপি দুটি হারিয়ে যায়। একটু অবসর পেলেই তিনি বই পড়তেন। স্ত্রী ও সন্তানদের সর্বদা বই পড়ার উপদেশ দিতেন। পরবর্তীতে তিনি মূলত রাজনৈতিক বিষয়েই লেখালেখি করেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর বইগুলো ছিল প্রামাণ্য রচনা। তাঁর রচিত রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ :১। সীমাহীন সমর (১৯৭৬), ২। দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন, সূর্যোদয় (১৯৮২), ৩। অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা (১৯৮৯), ৪। Bangladesh Nationalist Movement for Unity: A Historical Necessity। এছাড়া তিনি বেশকিছু কবিতাও লিখেছেন।
অকুতভয় এই বীর মুক্তি যোদ্ধা ১৯৮৯ সালের ১৯ নভেম্বর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে মৃত্যুবরণ করেন৷ ১৯৮৯ সালের ৫ নভেম্বর একটি ইসলামিক কনফারেন্সে যোগ দিতে মেজর জলিল পাকিস্তান যান। ১০, ১১ ও ১৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯ নভেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থানকালেই তিনি হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। পরে ২২ নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং সামরিক মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন করা হয়। ঝাঁকড়া চুলের টকবগে সেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। উল্লেখ্য, মেজর (অবঃ) জলিলই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার লাশ দাফনের মাধ্যমেই মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন শুরু হয়েছে।
সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মেজর এম এ জলিল সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পড়তেন। ধনদৌলতের প্রতি তাঁর ছিল না কোনো মোহ। দেশ, দেশের মাটি ও দেশের জনগণই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ। মেজর জলিল তাঁর জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা পাননি। এমনকি রাষ্ট্র কর্তৃক তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তবে তাঁর মৃত্যুর পরে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ন অবদানের জন্য মেজর এম এ জলিলের নামে ঢাকা মহানগরীর একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বরিশালের উজিরপুরের শিকারপুর ব্রিজটি মেজর জলিলের নামে করা হয়েছে।এ ছাড়া নগরীর কাঁটাবন মোড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কটি এখন থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল সড়ক নামে পরিচিত হচ্ছে। বরিশাল শহরেও তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা ছাড়াও বরিশালে একটি অডিটোরিয়াম ও তাঁর একটি ভাস্কর্য রয়েছে।
১৯৭১ এর রণাঙ্গনে বীরোচিত আত্মোৎসর্গের জন্য সাতজনকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সেক্টর কমান্ডাররা ভূষিত হয়েছেন ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে। বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর উত্তম উপাধিপ্রাপ্তরা প্রত্যেকেই সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপ্রতি জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি (এম এ জি) ওসমানী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ভূষিত হয়েছেন ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে। এর পাশাপাশি রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক মিলিয়ে আরো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ‘বীর বিক্রম’ ও ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে একমাত্র মেজর (অব.) এম এ জলিল রাষ্ট্রীয় পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর এই চৌকস কর্মকর্তা শুধু ৯ নং সেক্টরের কমান্ডারই ছিলেন না; বঙ্গোপসাগরের একাংশ ও সমগ্র সুন্দরবনসহ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলা (বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল) দখলমুক্ত রাখতে দক্ষ ও বীরোচিত নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
মেজর জলিলের রণকৌশলের কাছে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনী; যা যুদ্ধ চলাকালে বহুবার বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে জীবনবাজি রেখে ৯ মাস রণাঙ্গনে রক্ত-ঘাম ঝরালেও তাঁর ললাটে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদক। এই বেদনা নিয়েই দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান ও খ্যাতিমান এই সমর-নায়ক ১৯৮৯ সালের ১৯ নভেম্বর পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় গঠিত দেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মেজর জলিল। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় দলের মধ্যে মতবিরোধসহ নিজেকে সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে জাসদ থেকে বিদায় নেন তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদানকে খাঁটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। পরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে ১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর তিনি আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী (রহ) এর নেতৃত্বে গঠিত সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালের আজকের দিন ( ১৯ নভেম্বর) এ তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থানকালে মৃত্যুবরণ করেন।