শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::

স্মৃতি পটে শহীদ নজীর

॥পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ॥
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪

“… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরী পাইয়া কাজে যোগ দিয়াই মুসলিম হলের নৈশ-বিদ্যালয়ের প্রতি আমার মন আকৃষ্ট হয়। গোটা দশ পনেরো ছেলে রাত্রে লেখাপড়া করিতে আসে। অধিকাংশ ছাত্রই মুসলিম হলের আশে-পাশের কুলী-মজুরদের ছেলেরা। কেহ অল্পবয়স্ক, কাহারও বয়স বেশী। মুসলিম হলের ছাত্রেরা পালা করিয়া এক একজন এক একদিন তাহাদিগকে পড়াইতে আসে। একজন ছাত্র এইসব জনসেবার কাজের জন্য সম্পাদক নিযুক্ত হয়।
পরের বছর মুসলিম হলের এই নাইট স্কুলে যাইয়া দেখিলাম ছাত্র-সংখ্যা বাড়িয়া প্রায় পঞ্চাশ-ষাট এ দাঁড়াইয়াছে। অনুসন্ধান লইয়া জানিলাম নজীর নামক একটি ছাত্রের চেষ্টায় নাইট স্কুলের এই উন্নতি হইয়াছে। আমি নজীরের সঙ্গে পরিচিত হইবার জন্য সেদিনকার ছাত্র-শিক্ষকের কাছে আগ্রহ জানাইলাম। তাহাকে বারবার বলিয়া দিলাম নজীর যেন অবশ্য আমার সঙ্গে দেখা করে; কিন্তু নজীর আমার সহিত দেখা করিতে আসিল না। ছাত্রদের অনেক কাজে-কর্মে নজীরের কথা শুনি। নজীরের এই মত, সুতরাং এরূপ করা হইবে না, নজীর এইরূপ বলিয়াছে সুতরাং ওখানে যাইতে হইবে ইত্যাদি।
একদিন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে মুসলিম হলের তিন চারিটি পরিচিত ছাত্র আসিয়াছে। তাহাদের পরস্পরের নাম ধরিয়া আলাপ আলোচনায় কে নজীর চিনিতে পারিলাম। রঙ কালো তামাটে, পাতলা গঠন কিন্তু শরীরের স্বাস্থ্য ভাল। মুখে হাসিটি লাগিয়াই আছে। এই নজীর – ইউনিভারসিটিতে, মুসলিম হলে তাহাকে কতবার দেখিয়াছি। কিন্তু কোনদিনও তাহাকে একটা কেউকেটা বলিয়া মনে হয় নাই। নজীরকে ডাকিয়া বলিলাম : দেখ, মুসলিম হলের নাইট স্কুলে তোমার কাজ দেখিয়া আমার বড়ই আনন্দ হইয়াছে। আমি তোমাকে একটা পুরষ্কার দিতে চাই।
নজীর একটু লজ্জিত হাসিল। আমি বলিলাম: আচ্ছা বাড়িতে তোমার অবস্থা কেমন? নাজীর বলিল : স্যার। আমার অবস্থা মোটেই ভাল নয়। সবগুলি পাঠ্যবই এখনও কিনিতে পারি নাই। আমি বলিলাম : আচ্ছা তবে চার-পাঁচ টাকার মধ্যে আমি তোমাকে একখানা পাঠ্য-বই কিনিয়া দিব। তুমি যে কোন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার সঙ্গে অবশ্য দেখা করিও।
পাঠক মনে রাখিবেন সেটা ১৯৪১ সন। আমি মাত্র ১২৫ টাকা বেতন পাইতাম। নজীর অল্প একটু হাসিল। ইহার পরে টাকা লইবার জন্য নজীর আর কোনদিন আসে নাই। আমিও গরজ করিয়া তাহাকে কোন টাকা সাধি নাই। তাহার মত ব্যক্তিকে সাহায্য করিবার সেই ভাগ্য আমার হইল না।
পরে খবর লইয়া জানিয়াছিলাম ব্যক্তিগতভাবে খুব অভাবও তাহার ছিল না। তাহার এক চাচা তাহার পড়াশুনার খরচ চালাইতেন। সেই টাকার অল্পই নজীর নিজের জন্য ব্যয় করিত। অধিকাংশই গরীব বন্ধু-বান্ধবদের অভাব মিটাইবার কাজে লাগিত।
আমার নিজের দেশ ফরিদপুর। ঢাকা শহর হইতে তিন মাইল দূরে এক বাড়িতে আমাদের দেশের একটি ছাত্র অসুস্থ হইয়া পড়ে। সেখানে তাহার সেবা শুশ্রুষার বড়ই অভাব। নজীরকে ডাকিয়া বলিলাম : নজীর বল ত কি করা যায়? নজীর খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া উত্তর করিল : স্যার কোন চিন্তা নাই। মুসলিম হল হইতে দুইটি ছাত্র প্রতিদিন তাহাকে সেবা করিতে যাইবে। পরে জানিয়াছিলাম নজীরের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হইয়াছিল। নজীর ভাল বক্তৃতা করিতে পারিত না। মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের সভাপতি, সম্পাদক প্রভৃতি কোন পদই সে কোন দিন গ্রহণ করে নাই। কিন্তু এমন একটা কি যেন তাহার মধ্যে ছিল যে জন্য তাহার সমসাময়িক ছাত্রেরা চক্ষু মুদিয়া সে যখন যাহা বলিত তাহা পালন করিত। ফেণীতে বোমা পড়িতেছে। আমরা ঢাকা বসিয়াই আতঙ্কে অস্থির। ষ্টেশনে নজীরের সঙ্গে দেখা।
‘নজীর কোথায় যাইতেছ? সহাস্যমুখে সালাম করিয়া নজীর উত্তর করিল : যাই স্যার, দেখিয়া আসি ওখানকার লোকজনেরা কেমন আছে।
‘বল কি নজীর? তোমার ভয় করে না? শুনিলাম ফেণীতে প্রতিদিনই বোমা পড়িতেছে।
‘সেই জন্যই ত যাইতে হইবে স্যার। ভয় করিয়া কি করিব? মরিতে ত হইবেই। ফেণীর লোকগুলি কি অবস্থায় আছে একবার নিজের চোখে দেখিয়া আসি। (চলবে)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com