আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরিফে বিভিন্ন নবী-রাসূলকে তাদের নামে ডাক দিয়েছেন। কুরআনের যে আয়াত সর্বপ্রথম নাজিল করা হয়েছে, সেখানেও আল্লাহ পাক নামের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-‘পড়ো, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ হজরত আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব, তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখো।’ (আবু দাউদ, বায়হাকি) কুরআন-হাদিসের আলোকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, নামকরণ দ্বারা মানুষের পরিচয়, শনাক্তকরণ ছাড়াও ইহকাল ও পরকালে নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই সন্তানের নামকরণ যেমন উত্তম হতে হবে, তেমনি তা হতে হবে ইসলামী ভাবধারায় পরিপূর্ণ, যাতে নামের দ্বারাই বুঝা যায় যে লোকটি মুসলমান।
মুসলমানদের জন্য আরবি নামের প্রয়োজনীয়তা : আল্লাহ তায়ালা সব ভাষারই মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একের উপর অন্যেক মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ বলেন-‘আমি তোমাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’। মানুষের মধ্যে একের উপর অন্যের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তদ্রƒপ ভাষার ক্ষেত্রেও আরবি ভাষার মর্যাদা সর্বাধিক এবং আরবি ভাষাকে আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তিনটি কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবাসবে। তা হচ্ছে কুরআনের ভাষা, জান্নাতের ভাষা এবং আমার ভাষা আরবি।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘এরূপেই আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়।’ প্রকৃত মুসলিম হতে হলে এবং ইবাদতের প্রয়োজনে আরবি জানতেই হবে। আরবি ভাষার মাধ্যমে গড়ে উঠে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। মুসলিম বিশ্বের যেকোনো দেশে যেকোনো অঞ্চলেই বাস করুন না কেন, তার নাম শুনেই বুঝা যায় সে মুসলমান। আরবি নাম গ্রহণের জন্যই তিনি পরিচিত হন মুসলিম হিসেবে এবং এরই বদৌলতে মজবুত হয় বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ।
পিতার নামেই সন্তানের পরিচয় : পিতাই সন্তানের প্রকৃত হকদার, তাই সন্তান পরিচিতি লাভ করবে পিতার নামে- এটিই স্বাভাবিক। তা ইসলামের নির্দেশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাকো, এটিই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত।’ (সূরা আহজাব-৫) হজরত আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব, তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখো।’ সন্তানের নামের সাথে পিতার নাম সংযুক্ত থাকলে শনাক্তকরণে সুবিধা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির নামের সাথে যদি পিতার নাম সংযুক্ত থাকে তাহলে তাকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। অধিকাংশ সাহাবির নামের সাথে পিতার নাম সংযুক্ত ছিল। যেমন-আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা:, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা:।
ভালো নাম রাখা পিতার উপর সন্তানের হক : সন্তানের জন্যে ভালো নাম রাখা ইসলামের দেয়া পিতার উপর এক আমানত। পিতার উচিত সে আমানতের খিয়ানত না করে তা সুন্দরভাবে পালন করা। হজরত আবু সাইদ খুদরি রা: এবং হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলূল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সে যেন তার সন্তানের নাম সুন্দর করে রাখে এবং তাকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দেয়।’ অর্থবোধক, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন ইসলামী নামকরণের দ্বারা মানুষের চিন্তাচেতনা ও মানসিকতার উন্নতি ঘটে। ভালো নামের বদৌলতে সন্তানের অনাগত দিনগুলোতে বয়ে আনতে পারে মঙ্গল ও কল্যাণ। তাই সন্তানের জন্যে ভালো এবং অর্থবহ নাম রাখা উচিত এবং এটি হচ্ছে পিতার কর্তব্য।
সন্তানের নামকরণের সময়কাল : সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে সন্তানের নামকরণ করা সুন্নাত। আবার কেউ কেউ সন্তানের নামকরণের বিলম্ব না করে সন্তান জন্মের পরই নামকরণ করা উত্তম বলে মত ব্যক্ত করেছেন। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: হজরত হাসান রা: ও হোসাইন রা:-এর আকিকা করেন জন্মের সপ্তম দিনে এবং তাদের দুজনের নাম রাখলেন। (ইবনে হিব্বান ও আল মুস্তাদরেকে হাকেম)। হজরত আমির ইবনে শুয়াইব রা: তার পিতার সূত্রে, দাদা থেকে বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে সন্তান জন্মের সপ্তম দিন নামকরণ করতে আদেশ দিয়েছেন। (তিরমিজি) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- সাতটি কাজ সুন্নাত : ১. জন্মের সপ্তম দিনে সন্তানের নামকরণ করা; ২. খাতনা করা; ৩. সন্তানের শরীরের ময়লা দূর করা; ৪. সন্তানের নামে আকিকা করা; ৫. তার মাথা মু-ন করা; ৬. চুলের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য সাদকাহ করা; ৭. জন্মের সাথে সাথে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত শুনানো।
শিরক ও আপত্তিকর নাম : ১. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর নামের সাথে আবদ যুক্ত করে নামকরণ করা একপ্রকার শিরক। কারণ আবদ শব্দটি কেবল আল্লাহ পাকের নামের সাথেই যুক্ত হতে পারে। মানুষ একমাত্র আল্লাহরই গোলাম, সুতরাং গায়রুল্লাহর সাথে আবদ সংযুক্ত নাম অবশ্যই পরিহার করা দরকার। ২. হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নামের সাথেও আবদ সংযুক্ত করে নামকরণ করা শিরক। মুহাম্মদ সা: নিজেই নিজেকে আল্লাহর গোলাম বলে স্বীকার করেছেন, কাজেই কেউ গোলামের গোলাম হতে পারে না। ৩. ইসলামের ইতিহাসে ঘৃণিত নামগুলো পরিত্যাগ করা উচিত। যেমন- ফিরাউন, নমরুদ, শয়তান, শাদ্দাদ, কারুন, আবু জাহিল, আবু লাহাব ইত্যাদি। ৪. যেসব নাম শুনে বুঝা যায় না যে, সে মুসলিম না অমুসলিম, ছেলে না মেয়ে, মানুষ বা পশু, সেসব নামও পরিহার করা উচিত।
শিশুদের একাধিক নামকরণ : আমাদের দেশে অনেকেই শিশুদের একাধিক নাম রাখেন, আবার অনেকের প্রশ্ন একাধিক নাম রাখা যায় কি না? আমরা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার একাধিক নাম দেখতে পাই, যেমন- রাহমান, রাহিম ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহর অনেক সুন্দর নাম রয়েছে, তোমরা সেসব নামে তাঁকে ডাকো।’ (সূরা আরাফ-১৮০) হজরত মুহাম্মদ সা:-এরও একাধিক গুণবাচক নাম পবিত্র কুরআন শরিফে পাওয়া যায়, যেমন-আহমদ, মুহাম্মদ, আলআমিন, আস সাদিক, মুজাম্মিল, মুদ্দাসসির ইত্যাদি। তাই কোনো শিশুর একাধিক নামকরণ করা যেতে পারে কিন্তু শর্ত হলো- আসল বা ডাক নাম উভয়ই অর্থবহ ইসলামী হতে হবে।
ভালো নামের সুফল : মানব জীবনে নাম ও নামের অর্থ গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ভালো নাম জীবনকে যেমন সুন্দর করে, তেমনি খারাপ নাম মানব জীবনে অনেক ক্ষেত্রে বয়ে আনে দুঃখ-দুর্দশা ও অশুভ পরিণতি। ভালো নামের বদৌলতে অনেক সময় মানুষের চরিত্র, চালচলন ও আচার-ব্যবহার হয় উন্নত। একটি ঘটনায় উল্লেখ আছে, একদিন প্রিয় নবী সা: একটি দুগ্ধবতী ছাগল দোহন করার জন্য বললেন, কে এটিকে দোহন করবে? এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, আমি, হুজুর! তৎক্ষণাৎ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? সে উত্তর দিলো মুররাহ (তিক্ত)। তিনি তাকে বললেন, বসো। আবারো জিজ্ঞেস করলেন, কে এটিকে দোহন করবে? অপর এক ব্যক্তি দাঁড়াল। তাকে নাম জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিলো, হারব (যুদ্ধ-বিগ্রহ)। তাকে বললেন, বসো। আবার জিজ্ঞেস করলেন, কে এটিকে দোহন করবে? এক ব্যক্তি দাঁড়াল। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? সে উত্তর দিলো, ইয়ায়িশ (সে বাঁচবে) রাসূল সা: তাকে দুগ্ধ দোহনের অনুমতি দিলেন।
মন্দ নামের পরিণতি : মন্দ নাম মানব জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে আনে এর একটি ঘটনা উল্লেখ রয়েছে ইমাম মালেক রহ.-এর মুয়াত্তা নামক গ্রন্থে। হজরত ইয়াহিয়া বিন সাইদ রা: বর্ণনা করেন, হজরত ওমর বিন খাত্তাব রা: জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? সে বলল, জামরাত (অগ্নিস্ফুলিঙ্গ)। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার ছেলে? সে উত্তর দিলো, ইবনে শিহাব (অগ্নিশিখার পুত্র)। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়? সে উত্তর দিলো, বাহরুন নার (অগ্নিগর্ভে)। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কোন অংশে? সে উত্তর দিলো, বিজাতিল লাজা (শিখাময় অংশে)। হজরত ওমর রা: তাকে বললেন, যাও, তোমার গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে দেখো, তারা ভস্মীভূত হয়েছে। লোকটি বলেন, তাদের কাছে এসে দেখলাম যে, সত্যিই তারা ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
নাম পরিবর্তন করা যায় কি না : নাম যদি ভালো, সুন্দর ও অর্থসহ না হয়, তাহলে তা অবশ্যই পরিবর্তন করে ইসলামী নাম রাখা উচিত। রাসূলুল্লাহ সা: সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম পছন্দ করতেন। কেউ তাঁর কাছে এলে তিনি নাম জিজ্ঞেস করতেন। নাম পছন্দ হলে তিনি খুশি হতেন। আর অপছন্দ ও অর্থহীন হলে তিনি সাথে সাথে নাম পরিবর্তন করে দিতেন। রায়তা বিনতে মুসলিম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে ছিলাম। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলে বললাম, গুরাব (কাক)। তিনি বললেন, না; তুমি মুসলিম। হিজরতের আগে মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব (দোষ দেয়া)। রাসূলুল্লাহ সা: হিজরত করে মদিনায় আসার পর নাম রাখা হয় মদিনাতুন নবী, অর্থাৎ- নবীর শহর। লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট