ছোট একটি বালক । তার নাম লিওপোল্ড লুইস। পিতামহ থেকে নিয়ে কয়েক পুরুষ পর্যন্ত ইহুদী ধর্মগুরু রাব্বী তার পূর্ব পুরুষরা সবাই। রাব্বী বাবার ইচ্ছে তার ছেলে লুইস বড় হয়ে ব্যারিস্টার হবে। তাই বলে ধর্মকর্ম বাদ দিয়ে নয় ,তাই স্কুলে লেখাপড়ার সাথে সাথে তাকে বাড়িতে পড়ানো হয় হিব্রু ভাষা, সাহিত্য এবং ধর্ম গ্রন্থ ওল্ড টেস্টাম্যান্ট ও তালমুদ। তার মেধা শক্তি খুবই তীক্ষ্ণ সে মাত্র তের বছর বয়সে, হিব্রæভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। মনযোগের সাথে অধ্যয়ন করে ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু তার তৃপ্তি মেটে না। তার মনে হয় তাদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিশ্ব স্রষ্টা সার্বজনীন নন। তিনি যেন বিশেষ কোন গোষ্ঠির মঙ্গল অমঙ্গল করতে ব্যস্ত। বিশ্ব জাহানের স্রষ্টার সন্ধানে তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। স্কুল কলেজের পাঠ শেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি ভিনেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শিল্প দর্শনের ইতিহাস বিভাগে। তার মনের তৃষ্ণা মিটাতে ব্যর্থ হয় এ একাডেমিক লেখাপড়া। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চেষ্টা করেন অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। কিন্তু বাদসাধে তার বয়স, আঠার বছর পূর্ণ না হওয়ায় তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয় না। তার বিদ্রোহী মন ধর্মকর্মের অনুষ্ঠানিক আচার অনুষ্ঠান করা বাদ দিয়ে দেয়। চার বছর অপেক্ষার পর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলো। কিন্তু ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই যুদ্ধ শেষ হলো অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। তার সৈনিক জীবনেরও সমাপ্তি ঘটলো এখানেই।
লেখক হওযার অদম্য বাসনা নিয়ে তিনি ভিনেয়া ছেড়ে চলে আসেন, প্রাগে। সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় অস্থির বাবা তাকে খোঁজ করতে থাকেন কোথায় গেল তাদের লুইস। অবশেষে তিনি জানতে পারলেন, লুইস প্রাগে আছে, তিনি তার সন্তানের পকেট খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠালেন, এবং লিখেন,‘ আমি দেখতে পাচ্ছি যে,তুমি একজন ভবঘুরে হিসেবে মরে পড়ে আছো কোন এক নর্দমার পাশে। ’ তিনি তার বাবাকে লিখলেন, ‘দেখবেন, আমার স্থান নর্দমার পাশে নয়। আমি অবশ্যই সাফল্যে সুউচ্চ চূড়ায় উঠবো।’ লেখক হওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি নিজ শহর ভিয়েনা ছাড়েন। প্রাগ থেকে চলে আসেন বার্লিন। উদ্দেশ্য সাংবাদিক হিসেবে জীবন শুরু করা। পত্রিকা অফিসের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দেয়া শুরু করলেন। কিন্তু না কিছুতেই মনের মতো কিছু হচ্ছে না। দারুণ অর্থ কষ্টে পড়েলেন। তারপরও হাল ছাড়লেন না তিনি। তার অর্থ কষ্ট এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত না খেয়ে পায়ে হেটে বার্নিলের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন। জীবিকার তাগিদে তিনি এক চলচ্চিত্র প্রযোগের সহকারী হিসেবে চাকরি নেন। সাথে সাথে তিনি চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনী লেখাও শুরু করেন। অবশেষে ১৯২১ সালে তিনি তার স্বপ্নের রাজ্য পত্রিকার জগতে কাজ করার সুযোগ পান । জার্মান ক্যাথলিক সেন্ট্রার পার্টির প্রভাবশালী সদস্য ডর ডে মার্ট তাকে ইউনাইটেড টেলিগ্রাফ নামের একটি বার্তা সংস্থায় টেলিফোনিস্ট চাকরির সুযোগ করে দেন। এটি একটি ছোট চাকরি সাংবাদিক হিসেবে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ এখানে নেই। বিভিন্ন এলাকা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে সাংবাদিকরা টেলিফোনের মাধ্যমে অফিসে পাঠাতেন। তার কাজ ছিল টেলিফোনে পাঠানো সেই সব রিপোর্ট লেখা। কিন্তু তার মনে ছিল সত্যিকারে সাংবাদিক হওয়ার মানে রিপোর্টার হওয়ার অদম্য আশা। তিনি অন্যের পাঠানো রিপোর্ট লেখার কাজকে খুবই অপমানজনক মনে করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন নিজে রিপোর্ট সংগ্রহ করে তা ছাপতে। অফিস সময়ের বাইরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। বার্লিনের এক পাঁচ তারা হোটেলের নিরাপত্তা প্রহীর সাথে তিনি বন্ধুত্ব করেন। তার টেলিফোনিস্ট হিসেবে চাকরির এক মাসের মধ্যে সোনার হরিণ যেন তার হাতে এস ধরা দিলো। ১৯২১ সালে রাশিয়ায় দুর্র্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ জন্য রাশিয়ার জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। সে সময় জরুরি সাহায্য ফান্ড গঠনের কাজে গোপনে বার্লিন সফরে আসেন রাশিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি। এ খবর তিনি জানতে পারেন, হোটেলের নিরাপত্তা প্রহরী বন্ধুর মাধ্যমে তার সাহায্যে তিনি ম্যাক্সিম গোর্কির সাথে কথা বলাও সুযোগ পান। তিনি ম্যাক্সিম গোর্কির সাথে তার সাক্ষাৎকার ভিত্তিক রিপোর্টটি লিখে পাঠিয়ে দেন বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড টেলিগ্রাফের গ্রাহক পত্রিকাগুলোতে। পরদিন লিড আইটেম হিসেবে ছাপানো হয়, এ রিপোর্ট। গোটা জার্মানিতে আলোড়ন শুরু হয়, বড় বড় পত্রিকার রিপোর্টাররা যে খবর জানে না ইউনাইটেড টেলিগ্রাফের কোন রিপোর্টার সে খবর সংগ্রহ করলো। পরে সবাই জানতে পারলো কোন রিপোর্টার নয়, একজন একজন টেলিফোনিস্ট এ রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে। এতদিন পর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো,লিওপোন্ড লুইস ( মুহাম্মদ আসাদ) হলেন একজন সত্যিকারে সাংবাদিক । তিনি বার্তা সংস্থায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেন। ১৯২২ সালে সুযোগ মিলনো সেই সময়কার বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ফ্রাংফুর্টার শাইটুম এর রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার। রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য তিনি মিশর ,ফিলিস্তিন, ট্রান্সজর্ডান, ইরাক, ইরান আফগানিস্তান সফরের সুযোগ পান। ফ্রাংফুর্টার শাইটুম পত্রিকার জেরুজালেম প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ। এ সময় তিনি ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৬ ইউরোপে ফিরে এসে সস্ত্রীক ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। লিওপোন্ড লুইস ইসলাম গ্রহণ করে হলেন, মুহাম্মদ আসাদ। ইসলাম কবুল করার পর তিনি প্রায় ছয় বছর সৌদি আরবে বসবাস করেন। আরবদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। সৌদি আরবের বাদশাহ ইবনে সউদ তাকে খুব আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করেন। আরব ছেড়ে চলে আসেন ভারতবর্ষে। এখানে তিনি মুসলিম দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবালের সাহচার্য্য লাভ করেন। তার চিন্তা ও দর্শন মুহাম্মদ আসাদকে ব্যাপক ভাবে আলোড়িত করে। তখন ভারতবর্ষে চলছিল ব্রিটিশদের শাসন ও শোষণ। ভারতের জনগণ ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করছে। ভারতের মুসলমানরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। কেমন হবে সে রাষ্ট্র ,কী হবে তার সংবিধান, কোন মৌলিক সূত্রে চলবে সে দেশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে তিনি ভারত বর্ষে থেকে যান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে, পাকিস্তান সরকার তাকে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দেন এবং ইসলামী পুণর্গঠন নামে একটি সংস্থা গঠন করে তার দাযিত্ব দেন তাঁকে। দুবছর এ সংস্থার দায়িত্ব পালনের পর তিনি কূটনীতিক হিসেবে পাকিস্তান ফরেন সাভির্সে যোগ দেন। তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভাগের প্রধান হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশনের মিনিস্টার প্লেনিপোটেনশিয়ারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালে শেষের দিকে তিনি সকল দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে লেখালিখিতে আত্মনিয়োগ করেন। ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায, তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় জার্মান ভাষায়, ১৯২২ সালে, , Unromantisches Morgenland এর ইংরেজি অনুবাদ Unromantic Orien প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। মুহাম্মদ আসাদের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ The Road to Mecca ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত এ বিখ্যাত গ্রন্থটি মূলত তার আত্মজীবনী। গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদবক অধ্যাপক শাহেদ আলী লিখেছেন, ‘মুহাম্মদ আসাদ একজন সাংবাদিক, চিন্তাবিদ, ইসলামের এক অনন্য ব্যাখ্যাদাতা- কিন্তু মূলত তিনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী সৃজনধর্মী এক প্রতিভা, ‘দি রোড টু মক্কা’ তাঁর এক অপূর্ব সৃষ্টি।’ তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে, , Islam at the Crossroads (1934) Sahih Al-Bukhari1935–1938),The Principles of State and Government in Islam (1961), The Message of The Qur’an (1980),This Law of Ours and Other Essays (1987), My Discovery of Islam , The Spirit of Islam.
রোড টু মক্কা গ্রন্থে তিনি তার ইসলাম কবুলের কাহিনী তুলে ধরেছেন। ইসলাম গ্রহণকে তিনি মনে করেছেন নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন হিসেবে।
শাহেদ আলী অনুদিত ‘দি রোড টু মক্কা ’ গ্রন্থে মুহাম্মদ আসাদের মৃত্যু ১৯৯৪ সালে উল্লেখ করা করা হলে Wikipedia, the free encyclopedia তে এবং ইন্টারনেটের অন্য একটি সূত্র The Guardian এর উদ্বৃতি দিয়ে ১৯৯২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তার ইন্তেকাল হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা কবুল করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।